0

সংকোচ নয়, সচেতন হোন

Share

ডা: শাহনাজ চৌধুরী

নারীদের মাঝে প্রধানত যে দুটি ক্যান্সারের প্রবণতা দেখা যায় তার মাঝে স্তন ক্যান্সার অন্যতম। সারাবিশ্বের নারীদের প্রতি ৮ জনের মধ্যে ১ জন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত। বাংলাদেশেও প্রতিবছর প্রায় ২২ হাজার নারী নতুনভাবে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং প্রায় ১৭ হাজার নারী স্তন ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুবরণ করছেন। তাই স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ ও প্রতিকারে মনোযোগী হওয়ার এখনই সময়। নতুবা ঘাতক ব্যাধিটির ব্যাপকতা নিশ্চিতভাবেই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যান্সার অনেক ক্ষুদ্রাকৃতির থাকে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে না পড়ে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে। তাই প্রাথমিক অবস্থায় রোগটি শনাক্ত করা গেলে সুস্থতার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে এ রোগের কারনে মৃত্যুহারও অনেকটা কমে আসে। স্তনকোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে স্তনে চাকা বা পিন্ডের উৎপত্তি হলে তাকে স্তন টিউমার বলে। জীবনঘাতী ক্ষতিকর টিউমারগুলোকে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বলা হয়। আর যে টিউমারগুলো সাধারণত ক্ষতিকর নয় এবং শরীরের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে না সেগুলোকে বেনাইন টিউমার বলা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুগ্ধনালি বা মিল্ক ডাক্টের কোষ থেকে স্তন ক্যান্সারের উৎপত্তি হয়। এ ধরনের ক্যান্সারকে বলা হয় ডাক্টাল কারসিনোমা। আবার যেসব কোষের মধ্যে দুগ্ধ উৎপাদন হয় সেসব কোষ থেকেও ক্যান্সারের জন্ম হতে পারে যা লোবিউলার কারসিনোমা বলে পরিচিত। এই দুই ধরনের ক্যান্সার যখন স্তনের অন্যান্য অঞ্চলে সম্প্রসারিত হয় তখন তাকে বলে ইনভেসিভ কারসিনোমা।

যেকোনো নারী তথা যে কোনো ব্যক্তিই স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে কিছু কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকি রয়েছে যা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। যেমন লিঙ্গ। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মাঝে স্তন ক্যান্সারের হার বেশি। তবে পুরুষরাও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঝুঁকিও বাড়ে। সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলাদের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা বেশি থাকে। একজন নারীর মা, বোন, মেয়ে বা খালা এরকম কোনো নিকটাত্মীয় যদি স্তন ক্যান্সারের রোগী হন তাহলে ঐ নারীর স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। তবে পারিবারিক ইতিহাস না থাকলেও স্তন ক্যান্সার হতে পারে। এছাড়া বিআরসিএ-১ এবং বিআরসিএ-২ জিন দুটির বিবর্তন বা মিউটেশনের কারণেও স্তন ক্যান্সার হতে পারে। একজন নারীর এক স্তনে ক্যান্সার হলে অপর স্তনেও ক্যান্সার হবার আশঙ্কা থাকে। যেসব নারীর স্তনে কোষের ঘনত্ব বেশি তাদের স্তন ক্যান্সার হবার আশঙ্কাও বেশি। ১২ বছর বয়সের আগে মাসিক শুরু হলে এবং ৫৫ বছর বয়সের পরেও মাসিক বন্ধ (মেনোপজ) না হলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। আবার কোনো নারী নিঃসন্তান হলে বা ৩০ বছর বয়সের পর প্রথম সন্তান ধারণ করলে স্তন ক্যান্সারের আশঙ্কা বেশি থাকে। মেনোপজের পর ৫ বছরের অধিক কাল যদি হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি গ্রহন করা হয় তাহলে তা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম না করা, কায়িক পরিশ্রম থেকে বিরত থাকা, অনিয়ন্ত্রিত অস্বাস্থ্যকর শারীরিক ওজন এবং ধূমপান ও মদ্যপানের মত অভ্যাসগুলো স্তন ক্যান্সারের কারন হতে পারে। তাই স্তন ক্যান্সার থেকে রক্ষা পেতে সচেতন থাকতে হবে এবং নিয়মিত স্ক্রিনিং করতে হবে। ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের একটি লাইফ প্ল্যান বা পরিকল্পনা তুলে ধরা হলো।

২০-৩৯ বছর

২০ বছর বয়স থেকে প্রত্যেক মহিলার উচিত স্তনের সুস্থতা সম্পর্কে সচেতন থাকা। এজন্য প্রতি মাসে মাসিক শেষ হবার পর পঞ্চম-সপ্তম দিনের যেকোনো দিন তাকে আয়নার সামনে বা গোসলের সময় নিজের স্তন ও কাঁধের নিচের অংশ পরীক্ষা করতে হবে। কোনো সমস্যা পেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

৪০-৪৯ বছর

৪০ বছর বয়স হয়ে গেলেই প্রত্যেক মহিলাকে বছরে একবার ম্যামোগ্রাম নামক স্তনের বিশেষ পরীক্ষাটি করাতে হবে। সম্ভব না হলে স্তনের আল্ট্রাসনোগ্রাম করা যেতে পারে। এছাড়া এ বয়সকালে বছরে অন্তত একবার চিকিৎসক দ্বারা স্তন পরীক্ষা করা উচিত।

৫০-৬৯ বছর

৫০ বছর বয়স থেকে দুই বছর পরপর ম্যামোগ্রাম করাতে হবে এবং প্রতিবছর অন্তত একবার চিকিৎসক দ্বারা স্তন পরীক্ষা করাতে হবে।

৭০ এর বেশি

৭০ বছর বয়স হয়ে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ম্যামোগ্রাম করা যেতে পারে। স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে প্রত্যেক নারীকেই সচেতন থাকতে হবে। নিয়মিত নিজের স্তন ও বগলের নিচে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে কোনো চাকা বা পিন্ডের অস্তিত্ব আছে কিনা। এছাড়া স্তনের বোঁটা ভেতরে ঢুকে গেলে, বোঁটা থেকে রস বের হলে, স্তনের ত্বকের কোনো পরিবর্তন ঘটলে বা দুই স্তনের আকার-আকৃতির মাঝে লক্ষণীয় অসমতা দেখা দিলে সংকোচ না করে দ্রততম সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

নিয়ন্ত্রিত ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, নিয়মিত স্তন পরীক্ষা এবং নির্দেশনা অনুযায়ী ম্যামোগ্রাম করলে স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ ও প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় সম্ভব হয়, যা নিশ্চিত করে স্তনের স্বাস্থ্য সুরক্ষা। সংকোচ নয়, সচেতন হোন। প্রতিকার নয়, প্রতিরোধ করুন।

ডা: শাহনাজ চৌধুরী (ডায়গোনোস্টিক মেডিকেল সনোগ্রাফার) কানাডা, (প্রাক্তন সহযোগী অধ্যাপক, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়