3

তার মৃত্যুর পর শুরু হলো এক অচেনা যুদ্ধ 

Share

তৌহিদা নিনা

আমার বেড়ে ওঠা ছিমছাম সাজানো এক শহরে । পাহাড়ের মাঝ দিয়ে একে বেকে চলা রাস্তায় দুরন্তপনা, সন্ধ্যার মৃদু-মন্দ বাতাসে ভাই বোনদের হাত ধরে হেঁটে চলা পাহাড়ী সে রাস্তায় । বলছিলাম আমার শৈশব- কৈশোরের বেড়ে ওঠা শহর চট্টগ্রামের কথা । বাবার বাসা ছিল পাহাড়তলিতে । 

এখনকার মতো অসংখ্য মানুষের বাস ছিল না এ শহরে তখন। ছিল না অসহনীয় যানজটও । আমার চোখের সামনে এখনও ভাসে ছিমছাম সাজানো গোছানো এক শহর । পাহাড়ের গায়ে গায়ে যখন সন্ধ্যার বাতিগুলো জ্বলে উঠতো, মনে হতো মায়াবী এক শহর । রাতে ঝিঁঝি পোকার ডাক মুগ্ধ করতো আমাকে । সকালে পাখি ডাক দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিতো । এ সব কিছুতেই আমার মুগ্ধতা ছড়িয়ে থাকতো ।

শৈশবে শুরু হওয়া সে মুগ্ধতা কৈশোর পর্যন্ত স্থায়ী ছিলো । সেই মুগ্ধতায় ছেদ পরে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারী । আমার বয়স তখন কতই বা হবে, পনেরো বা ষোল। সবে শেষ করেছি ম্যাট্রিক।চোখে মুখে কত স্বপ্ন, এর মধ্যেই আসে বিয়ের প্রস্তাব । ওহ, বিয়ের গল্পের আগে আমার পরিবারের গল্প বলি । বাবা-মা, সাত ভাই বোন,দুই ভাবী,তাদের বাচ্চা…সব নিয়েই ছিল আমার জগৎ । 

বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন ।বাবা-মায়ের পরিবারে আমি সবার ছোট ছিলাম ।এ জন্য আদরটাও একটু বেশি ছিল আমার । আর একটি কারনও ছিল মনে হয় । এটা আমার ধারনা ছিল যে, আমার সব ভাই বোনদের গায়ের রঙ ছিল শ্যামলা। একমাত্র আমিই ছিলাম ফর্সা । এ কারনেই হয়তো আমার আদর বেশি ছিল। 

বাবা আমার জন্য দামি দামি সাবান শ্যাম্পু,ক্রিম নিয়ে আসতেন । নিজেকে রাজকন্যা মনে হতো । যদিও কোনদিন জানতে পারিনি,আমার এত আদর কেন ছিল। দুই একবার মনে হয়েছে..বাবাকে জিজ্ঞেস করি..কিন্তু করা হয়নি, লজ্জায় ।মনে হয়েছে থাক নিজের সৌন্দর্যের কথা জানতে চাওয়ার দরকার কি ।

এবার বিয়ের গল্পে আসি ।হঠাৎ করেই বাবা একদিন এসে জানালেন আমাকে দেখতে আসবে । তখন আমি সবে ম্যাট্রিক শেষ করেছি। বিয়ে চুড়ান্ত হয়ে গেল । ৭২ সালের ১ মার্চ আমার বিয়ে হয়ে গেল । স্বামী সরকারি চাকরিজীবী । সুদর্শন এক যুবকের সাথে শুরু করলাম নতুন যাত্রা ।

একটা দুরন্ত কিশোরীর শুরু হলো সংসার যাত্রা । অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করতো বিয়ের পর । স্বামী-সংসার নিয়ে নারীদের প্রচলিত যে ভাবনা তা পরিবর্তন হলো আমার জীবনে ।আমার শাশুড়ি আমাকে নিজের মেয়ের মতো করে ভালোবাসতেন । আগলে রাখতেন সব সময় । আর আমার স্বামী তার ভালোবাসার অন্ত ছিলো না । স্বর্গ কেমন দেখিনি,কিন্তু সে সময়টায় আমার মনে হতো আমার এই ঘরই আমার স্বর্গ ।

১৯৭৩ সালের কথা। এতো ভালোবাসার মাঝে আমার বুকজুড়ে এলো আমাদের ভালোবাসার বড় উপহার আমার প্রথম সন্তান । ফুটফুটে এক রাজপুত্র । রাসেল –আমার বড় ছেলে । সে এখন কানাডায় বড় একটি সরকারি চাকুরি করে । 

বাকি সন্তানদের কথায় পরে আসি। আমার প্রথম সন্তান হওয়ার পর আমার মনে হলো তাদের মানুষের মতো মানুষ করতে হবে । চলে এলাম ঢাকায় । বাসা নিলাম বাসাবো । ঢাকায় বাসা নেওয়ার পর সারাদিন ঘরময় ঘুরে বেড়াতাম । মনে হতো এই আমার স্বর্গ। আমার নিজের সংসার । 

ছেলে ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো । স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম তাকে নিয়ে । ইঞ্জিনিয়ার বানাতে হবে । ছেলেও যেন মায়ের মনের কথা বুঝতে পারল । ভর্তি হলো মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে।

এর মধ্যেই আমার কোলজুড়ে এলো আমার আরেক সন্তান রিয়া। বাবা আর ভাইয়ের মতো সেও ট্যালেন্ট ছিল পড়াশোনায় । আর একটা গুণ নিয়েই সে বড় হতো লাগল সেটা হলো ছোটবেলা থেকেই সবাইকে আগলে রাখার এক অদ্ভুত গুণ ছিল তার মধ্যে । 

এরপর একে একে আমার কোলজুড়ে আসল আমার মেজো মেয়ে রিপা আর ছোট মেয়ে টুম্পা ।এরাও আগের দুইজনের পথ ধরেই এগুতে লাগল । বিশেষ করে পড়াশোনায় তারা ছিলো অসম্ভব মেধাবী । তিন মেয়েও চান্স পেল মতিঝিল আইডিয়ালে । 

আমার সুখের সংসার । অফিস শেষে স্বামীর বাসায় ফেরা,সন্তানদের সাথে গল্প করা..আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম আমার চাঁদের হাটের দিকে । কিন্তু আমি তখনও বুঝিনি আমার সংসারে কালো ছায়া নেমে আসছে ।

আমার বড় ছেলে যখন এইচএসসি পাশ করে মাদ্রাজ আইআইটিতে চান্স পেয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে,তখন থেকেই আমার স্বামীর শরীরটা একটু একটু করে খারাপ হতে শুরু করল । বড় ছেলে মাদ্রাজ যাওয়ার ১৫ দিন পরই এক রাতে তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ল । নেয়া হলো হাসপাতালে, তখন কিছুই ধরে পারেনি ডাক্তার। 

কিন্তু তারপরও শরীর ভাল না হওয়ায় নেয়া হল ভারতে । ধরা পরলো ব্লকেজ । তিন বছর ঔষধে চলল। আমার তখন দিন যায় মাস যায় নানা দোলাচলে । স্বামীর অসুস্থতা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো সব সময় সময় । 

১৯৯৫ সাল। শত চিন্তার মাঝেও আমার জীবনের স্বরণীয় দিন। মেজো মেয়ে রিপা এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে প্রথম হয়ে স্ট্যান্ড করল । সারাদিন টিভি-পত্রিকার সাংবাদিকরা ছুটে আসছে আমার বাসায় । রিপার ইন্টারভিউ নিচ্ছে,আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছে । এর মধ্যেই তাদের জন্য নাস্তা রেডি করছি । বাকি দুই মেয়ে রিয়া, টুম্পাও ছুটাছুটি করছে এ ঘর ও ঘর ।

আমার সংসারে এত খুশি মনে হয় বিধাতার সহ্য হলো না । ১৯৯৬ সালে ৩০ অক্টোবর, আমার কাছ থেকে নিয়ে গেল আমার স্বামীকে । বাবা হারা হলো আমার চার সন্তান। শরীরে ক্যানসার ধরা পরার মাত্র নয় মাসের মাথায় চলে গেলেন আল্লাহর কাছে । আমার স্বামীর মৃত্যুর দিনটায় আরেকটি বড় কষ্ট এখনও কুড়ে কুড়ে খায় ।

বাবা-মা যেমন সন্তানের মনের কথা বোঝে,সন্তানরাও মনে হয় অনেক কিছু বুঝতে পারে । আমার এখনও তাই মনে হয় । আমার স্বামী যেদিন মারা যান,ঠিক তার কিছুক্ষণ পরই আমার বড় ছেলে রাসেল মাদ্রাজ থেকে ফোন করে । বাবার খবর জানতে চায় । কিন্তু কি বলব তাকে !

সেদিন মিথ্যা বলেছিলাম রাসেলকে ।বলেছিলাম তোর বাবা ভাল আছে । এই মিথ্যাটা বলেছিলাম এ কারনে যে,না হলে সেদিন রাসেল তার ফাইনাল পরীক্ষা ফেলে চলে আসতো । মাফ করে দিস রাসেল সেদিন তোকে মিথ্যা বলার জন্য ।

আনোয়ার হোসেন, আমার স্বামীর নাম। এতক্ষণ এত কিছু বলছি এই মানুষটাকে নিয়ে অথচ তার নামটাই বলা হয়নি । এত ভালো মানুষ আমি আমার জীবনে কমই দেখেছি । তার মৃত্যুর পর আমি চারদিকে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম । আমার চার সন্তানকে কিভাবে মানুষ করব এই আমি । শুরু হলো আমার নতুন যুদ্ধ, এক অচেনা যুদ্ধ । 

এই আমি ঘর সংসার আগলে রাখা মানুষ শুরু করলাম অফিসে দৌড়ানো । স্বামীর পেনশনের টাকা উঠানো। এর মধ্যে বড় ছেলে রাসেল মাদ্রাজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরল। চাকুরী পেল একটা ফার্মে। তিন মেয়েই পড়াশোনা করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়। ভাবলাম শুধু রাসেলের চাকরিতে তো হবে না । নিজেকেই কিছু করতে হবে । 

শুরু করলাম স্বামীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া। পার্টনারশীপের ব্যবসা ছিল তার । এ্যাপারেলস ফ্যাক্টরী । সেখানে জয়েন করার পর পরই আমাকে ম্যানেজিং ডিরেক্টর বানিয়ে দেয়া হয় । প্রতিবন্ধকতা যে ছিল না তা নয়। সেখানেও শুনতে হয়েছে মেয়ে মানুষ পারবেন তো সামলাতে । সব কিছু উপেক্ষা করে আমি সবই সামলিয়েছি । নারী উদ্যেক্তা হিসেবে পেয়েছি ‘সি আর দাস’ গোল্ড মেডেল । 

ব্যবসায় ঢোকার পর আমার আর দিনরাত মনে থাকতো না । সকাল থেকে ব্যবসা সামলানো,সংসার সামলানো। সব কিছু করে যখন বসতাম, মাঝে মাঝে দেখতাম গভীর রাত । সে সময় সেই মানুষটাকে বড্ড মিস করতাম । এই ভেবে যে, তুমি থাকলে আমাকে শক্তি যোগাতে, সাহস জোগাতে । কত রাত কেঁদেছি একা একা ।

এর পর আমার বড় ছেলে বিদেশে পাড়ি জমালো । সেটা ২০০০ সালের কথা । তার বিয়ে হলো । এখন দুই কন্যা সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে সুখের সংসার তার, থাকে কানাডার ক্যালগিরিতে। বড় ছেলের আগেই বিয়ে হয় আমার বড় মেয়ের। স্বামী নামকরা আইনজীবী।

সেও এখন স্বামী আর দুই কন্যা নিয়ে থাকে কানাডার এডমন্টনে । রিয়া এখানে একটা ভাল প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ।আমার বড় মেয়ে রিয়া কানাডায় আসার আগে দেশেও একজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক ছিল। প্রায় এগারো বছর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল –চ্যানেল আই তে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিল সে। 

এরপর বিয়ে হয়ে যায় মেজো মেয়ে রিপার। টুম্পার বিয়ে হয় আরও পরে । রিপা এখন দুই ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে নিউইয়র্কে বাস করছে । ছোট মেয়ে টুম্পা এক ছেলে,এক মেয়ে আর স্বামী নিয়ে থাকে কানাডার এডমন্টনে। টুম্পা সরকারি কর্মকর্তা । 

একটা কথা বলা জরুরি, এক হাতেই আমি চার সন্তানের বিয়ে দিয়েছি। আমার কানাডা আসার গল্পটা বলা হয়নি । রাসেল কানাডা যাওয়ার পাঁচ বছরের মাথায় আমাকেও তার কাছে নিয়ে আসে।যেহেতু ছোট মেয়ে টুম্পার বিয়ে হয়নি তখনও তাই সেও আমার সাথে কানাডা চলে আসে তখন । 

পেছেনে রেখে আসি বড় মেয়ে রিয়াকে, একা। পড়াশোনা করার সময়েই আমার তিন কন্যার বিয়ে দিয়েছিলাম, বাবা হারা তিন বোন । সুপাত্রে দিতে পারব কি না, সে চিন্তা তাড়া করতো সবসময় । এ কারনে যখন ভাল পাত্র পেয়েছি, তখন আর দেরী করি নাই । 

এখন আমার তিন মেয়ের জামাই আমার এক একটি ছেলে । আমার এখন সুখেই দিন কাটে । রিয়া আর টুম্পার বাসা এডমন্টনে, পাশাপাশি । আমি বড় মেয়ের সঙ্গেই থাকি । কিন্তু আমাকে একবেলা না দেখলে যেন ঘুম হয় না আমার ছোট মেয়ে টুম্পার । 

তাই নানা অজুহাতে আমাকে দেখতে ছুটে আসে সকাল বিকাল। নাতি-নাতনীরা তো নানু বলতে পাগল । বড় ছেলেও নানা উৎসবে ক্যালগিরী থেকে ছুটে আসে এখানে । আমার এখন আনন্দেই দিন কাটে । নিজেকে গর্বিত মা মনে হয় । 

সবাইকে মানুষের মতো মানুষ করেছি, এটা গভীর আনন্দ দেয় । আর না বলা কষ্টটা মাঝে মাঝে বুকের গভীরে উঁকি দেয়। যার জন্য আমার এই পথচলা সহজ হয়েছে, সেই আনোয়ার কিছুই দেখে যেতে পারলো না । আজ আনোয়ার বেঁচে থাকলে দেখতো, তার সন্তানেরা কিভাবে শত প্রতিকূলতা কাটিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সবার মাঝে।

তৌহিদা নিনা, এডমন্টন,কানাডা