(প্রথম পর্ব)
শিউলী সুকন্যা
লীলাবতী বাস থেকে নেমেই একটা রিকশা ডেকে নিল। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশে সূর্যের কড়াকড়ি শাসন। এমনিতেই লীলার গরম বেশি। তবে গরম যতটুকু না লাগে তার চেয়ে বেশি ঘেমে যায়, এই ব্যাপারটাই তাকে অস্বস্তিতে ফেলে সব সময়। মাঝে মাঝে তার খুব হিংসা হয় অন্য মেয়েদের দেখে। যে সময়টাতে অন্য মেয়েরা থাকে স্নিগ্ধ, সজীব সেই সময়েও লীলা ঘেমে নেয়ে একাকার। আর এখন তো পুরোপুরি গরমের উপর গরম। ইদানিং গরমটাও বেশি। পড়বে নাই বা কেন, গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার ফলে জলবায়ুর যে পরিবর্তন তাতে শীতে বৃষ্টি নেমে আসলেও গরমে বৃষ্টির টিকিটিও পাওয়া যায়না। বাদলের কদম গ্রীষ্মে আর শরতের শিউলি বর্ষায়! এসবই এলোমেলো মনে ভাবতে থাকে লীলাবতী।
লীলার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। রোদে তাই সে মোটামুটি কানা টাইপ, ভাল করে তাকাতেই পারেনা। ইদানিং বাইরে বের হলেই রোদ চশমাটা পরে নেয়। তবে যতবারই রোদচশমা চোখে দিয়ে বের হয় সে এতটাই বিব্রত থাকে যে, মনে হয় সবাই তার দিকে আজব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যদিও তেমনটা হওয়ার কোন কারণ নেই। রোদের কারনে এই সময়ে সবাই কমবেশি রোদ চশমার সাহায্য নেয় তাই আলাদা করে তাকে দেখার কারই বা এত সময় পড়ে আছে।হাত দিয়ে ইশারা করে একটা রিকশা ডেকে নিয়ে তাতে চড়ে বসলো লীলা। রিকশাচালককে তার গন্তব্য বলে দিলো।
রিক্সায় বসেই সে তার যাত্রা পথের একটা নকশা করে ফেলল। কমলাপুর স্টেশনে যাওয়ার আগে একবার বাস কাউন্টারে দেখে নেবে। যদি বাস পেয়ে যায় তাহলে আর ট্রেনে যাবে না বলে মনস্থির করল। বাসের কাউন্টারে গিয়ে দেখল সেখানে প্রচন্ড ভিড়। ভিড় ঠেলে ভেতরে যাও ঢুকতে পারল কিন্তু আবারও তাকে ট্রেনের দিকেই ছুটতে হলো। কারণ এরই মধ্যে বাসের সকল টিকেটই বুকড। এমনিতেই ঈদের ছুটির সময় ভিড় বেশি হয় আর এবার পূজা এবং ঈদের ছুটি একসাথে হওয়ায় এই বাড়তি চাপ। রেল স্টেশনে আসার পর তার খেয়াল হলো এই যা, সময় কত হয়েছে সেটা মাথাতেই আসেনি এতক্ষণ । তাড়াতাড়ি আগে মোবাইলটা বের করল ব্যাগ থেকে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে লীলার কান্না প্রায় অবস্থা। ঘড়িতে এখন বাজে সকাল আটটা ত্রিশ মিনিট। তার ট্রেন স্টেশন ছাড়ার কথা আটটা দশ এ। এর মধ্যে আবার মোবাইলের ব্যাটারির চার্জ যায় যায় অবস্থা।
তাদের এলাকায় যাওয়ার ট্রেনটা মাঝখানে এতোটা সময় মেনে চলতো না, কিন্তু এখন একেবারে কাঁটায় কাঁটায় ট্রেন ছেড়ে দেয়। যদিও লীলা আশা করছে ঈদের কারনে হয়তো বা পেলেও পেতে পারে। যেই ভাবনা সেই কাজ। ক্ষীণ আশা নিয়ে দৌড়ে গেল টিকিট কাউন্টারে, যদি জুটে যায় একটা টিকেট সেই ভরসায়। যদিও ট্রেন ছাড়ার সময় পার হয়ে গেছে। কাউন্টারে লোকের ভিড় চোখে পড়ার মতো। তবে এ ভিড় খুবই স্বাভাবিক কারণ সব মানুষ যে শুধু আজকেই যাবেন তা নয়, বাড়িতে যাবার আগাম টিকেটও কাটতে এসেছেন অনেকে। ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল লীলা। আশেপাশের মানুষগুলো ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে, যদিও লীলার তা আমলে নেওয়ার সময় নেই। একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারনে খুব সহজেই কাউন্টারের ভদ্রমহিলার সাথে আই কন্ট্রাক্ট করতে পারল। লীলা যখন ট্রেনের কথা জানতে চাইলো তখন কাউন্টারে থাকা ভদ্রমহিলা জানিয়ে দিলেন এগারসিন্ধুর নামক কিশোরগঞ্জগামী ট্রেনটি কিছুক্ষণ আগে স্টেশন ছেড়ে গেছে।
লীলাবতী বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে বা তার কি করা উচিৎ! নির্বিকার এবং অসহায় দৃষ্টিতে সে মহিলার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, আর কোন ট্রেন আছে নাকি? যে ট্রেন দুপুর সাড়ে বারোটার মধ্যে ভৈরব পৌঁছুবে? ভদ্রমহিলা লীলার কথা বুঝল কিনা টের পেলো না কারন তিনি ভ্রু কুচকে কিছুটা আজব দৃষ্টিতে একবার লীলার দিকে তারপর অন্য যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে আবার মনিটরের দিকে মনোযোগ দিলেন। লীলা প্রায় যখন আশা ছেড়ে দিল তখন ভদ্রমহিলা তাকে অবাক করে দিয়েই জানালেন, চট্টগ্রামের দুটো ট্রেন আছে যা সাড়ে বারোটার কাছাকাছি সময় ভৈরব পৌঁছুবে। দুটো ট্রেন যথারীতি দশটা ত্রিশ এবং এগারোটা ত্রিশ এ কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে যাবে।
লীলাবতীর বাড়ি যাওয়াটা যে এখন খুব যে জরুরি ছিল তা নয়, কিন্তু মা-কে সারপ্রাইজ এবং খুশি করার জন্যই যাচ্ছে সে। অনেকদিন ধরেই তার মা বলছিলেন “অনেক বছর দাদার বাড়ি যাস না। এভাবে বাড়ির মানুষ তো ভুলে যাবেই আর তোরাও দাদা বাড়ির রাস্তা ভুলে যাবি”। কিছুদিন আগে এমনিতেই কথার ছলে মা-কে বলেছিল লীলা “এরপর যে ছুটিটা একটু বেশি সময়ের জন্য পাব তখনই চলে যাব বাড়িতে”। ছুটি পেয়েছিলও সে। কিন্তু বাবা-মা তখন ঢাকাতেই ছিলেন বলে আর যাওয়া হয়নি। বাবা-মা যখন মাঝে মাঝে বাড়িতে যান তখনই কেবল সে যেতে পারবে বাড়িতে। তাই ছুটি পেয়ে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তখন যেতে পারেনি। কিন্তু এবার সবকিছুই কেমন মিলে গেলো! ঈদ আর পুজোর ছুটি পড়েছে একই সাথে। তার উপর এবার বাবা-মা এই সময় বাড়িতে। ঈদের সময় ছাড়া এতদিনের ছুটি পাওয়া যায় না। তাই আজকের মধ্যে যেতে না পারলে এবারেও আর যাওয়াটা হবেনা। কারণ ঈদের পরপরই বাবা-মা ঢাকা চলে আসবেন। সে বাড়ি গিয়ে ঈদ শেষে বাবা-মা সহ একসাথে ঢাকায় ফিরবে, এই ছিল তার পরিকল্পনা।
মায়ের সাথে কথাও হয়েছে সেভাবে। যদিও মাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য কোন পাকা কথা দেয়নি লীলা। কাউন্টারের ভদ্রমহিলার কাছে ট্রেনের সিডিউল জানার পর সে জিজ্ঞেস করলো কোন ট্রেনটা আগে পৌঁছুবে? তবে উত্তরের অপেক্ষা না করেই লীলা সাড়ে দশটার টিকেট দিতে বলল। যদিও সে জানেনা কোন ট্রেনটা আগে পৌঁছুবে। ভদ্রমহিলা লীলার কাছ থেকে টিকিটের টাকাটা বুঝে নিয়ে তাকে টিকিট দিয়ে ট্রেনের সময় সম্পর্কে আবারও অবগত করলেন। ধন্যবাদ দিয়ে লীলা সেখানে থাকা একজনের কাছে ট্রেনটা কোথায় আছে জানার পর ট্রেনের দিকে ছুটে চলল। সে কিছুটা শংকিত, কারণ তার এই ট্রেন সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। এতে আগে কখনও যাওয়া তো দূরের কথা, এ ট্রেনের নামই সে কখনও শুনেছে বলে মনে পড়ছেনা। তবে যেহেতু ডিসিশান নিয়েই ফেলেছে এবার বাড়ি যাবে, তাই আর বাড়তি কথা ভেবে লাভ নেই। লীলা ট্রেনটাকে খুঁজে পেলো অবশেষে। ট্রেনের নাম জেনে নিশ্চিত হয়ে পাশেই বসার জন্য় একটা জায়গা করে নিলো। যেহেতু এখনও অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে ট্রেনের জন্য। ( চলবে)