0

লীলাবতীর একদিন (পর্ব-৩)

Share

শিউলী সুকন্যা

যেহেতু তার নির্দিষ্ট কোন সিট নেই তাই আলাদা করে বগি খোঁজার কিছু নেই। সে প্রথম বগিটাতেই উঠে গেল। উঠে একটা সিটে বসলো। একটু পর তাকে সেখান থেকে উঠে যেতে হলো কার সেই সিটের মালিক চলে এসেছেন। লীলা পাশে সিটে যাবে ভাবছে এমন সময় হুড়মুড় করে গোটা ১০-১২ জনের একটা দল এসে লীলা কে দ্রুত সিট ছাড়তে বলল। উঠে দাঁড়িয়ে যখন সে ট্রেনের বগিতে নজর বুলিয়ে নিচ্ছিল দেখতে পেলো তিল ধারণের জায়গাটুকু নেই আর। সে দাঁড়িয়ে একটু সরে ট্রেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। মনস্থির করলো এখানে দাঁড়িয়েই যাবে। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে যাওয়ার। আর আজ দায়ে পরে আকস্মিকভাবে তার মনের আশা পূর্ণ হয়ে গেল। 

ভালভাবে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক তাকাতে গিয়ে দেখতে পেলো তার সাথে দাঁড়ানো আছে দিনার নামের সেই লোক। লীলাকে একটা হাসি উপহার দিয়ে সে জানালো সিট নেই তাই এখানেই দাঁড়ালাম। আরও বলল “আপনার সাথে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছি তাই আপনাকেও আর একা রেখে গেলাম না”। ট্রেন চলতে শুরু করলো এক সময়। লীলার ভালই লাগছে সকালের মিস্টি রোদের ভেতর ট্রেনের দ্রুত চলা এর মাঝে তার অগোছালো চুলের উড়তে থাকা। ট্রেনের দরজায় দাড়িয়ে বাইরের দিকে মুখ করে নিজের জগতে ভেসে গেলো। তার সুন্দর জগৎটা শুধুই তার। কারও কোন স্থান নেই সেখানে। একটু নিষ্ঠুর নিষ্ঠুর শোনা যায় কিন্তু এটাই বাস্তবতা। তার এই কল্পনার জগতে সে ভেসে চলে অন্যরকম ভাবে। লীলাকে একেবারেই অবাক করে দিয়ে দিনার সাহেব জানতে চাইলো “একটা মানুষের এক সাথে এত কিছু থাকতে হবে কেন?”। 

লীলা কিছুটা বিরক্ত! তার ভাবনার জগতে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য। কিন্তু সেটা বুঝতে দিল না। হাসি দিয়ে পাল্টা সংক্ষিপ্ত প্রশ্নে জানতে চাইলো “কি?” ভদ্রলোক লীলার দিকে এক নজর দেখে বলতে আরম্ভ করলো “একটা মানুষ দেখতে এত সুন্দর!, শিক্ষিত! নমনীয় ব্যবহার!, বুদ্ধিমতী, …আর কি লাগে?” লীলা বুঝতে পারলো এই প্যান প্যানানি থেকে আর মুক্তি নেই। সে কানে হেড ফোনটা লাগিয়ে নিল উত্তর না দিয়ে। গান যে শুনছে না ভদ্রলোকতো আর তা জানে না। আপাতত ভদ্রলোকের কাছে আর নিজের প্রশংসা শুনতে হবে না, এতেই শান্তি। কোন এক অজ্ঞাত কারনে লীলা তার ব্যাপারে কোন প্রশংসা বিশ্বাস করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত দিনার সাহেব কে চুপ করাতে সফল হলো লীলা। যদিও মাঝে মাঝেই কিছু প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। 

সময়টা বেশ যাচ্ছে। লীলা যে সিট টাতে সল্প সময়ের জন্য বসেছিল তাকে উঠিয়ে হুড়মুড় করে যে দশ বারোজন উঠেছিল তাদের কে দেখতে লাগলো সে। বিশাল ফ্যামিলি, মা-বাবা, বাচ্চা,নাতনি সমেত। তারা ট্রেনের আটটা সিট কেটেছে আর তাদের সদস্য সংখ্যা ১২ থেকে ১৩ জন। পুরো পরিবারটার কার্যকলাপে লীলা ভালই মজা পাচ্ছে। শুরু থেকেই বসা নিয়ে গন্ডগোল হলো। নিজ বাড়ি চট্টগ্রামে যাচ্ছে সবাই মিলে ঈদ করতে। বোঝা যাচ্ছে ছোট্ট বোনটা খুব আদরের। তার ব্যাপারে সব কিছু মেনে নেয়ার প্রবনতা দেখে লীলা এমনটাই ধারনা করলো। কিন্তু তাদের বসা নিয়ে যাদের মধ্যে গন্ডগোল হচ্ছে তারা হলো এই পরিবারের প্রায় সম বয়সী তিন ভাইয়ের মধ্যে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। এই সবার মাঝে আর একজন আছে খুব আদুরে এবং সে সবার ছোট। বোধকরি এই পরিবারের একমাত্র তৃতীয় প্রজন্ম। এই পরিবারের বড় সন্তানের কন্যা। বড় ভাইয়ের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত তারা বসল শান্ত হয়ে। 

বসেই শুরু হয়ে গেল খাবার-দাবারের আয়োজন। কিছু সময় আগে যে তারা বসা নিয়ে ঝামেলা করছিল তা এখন আর দেখে কারো মনে হবে না। ট্রেন চলছে কিন্তু গতি খুব ধীর। প্রায় এক ঘন্টা হতে চলল কিন্তু এখনো ট্রেন বিমানবন্দর স্টেশন পৌঁছাতে পারেনি। সময়ের সাথে পাল্লাা দিয়ে সূর্যের উত্তাপও যেন বেড়ে চলল। দেখতে দেখতে বিমান বন্দর স্টেশনে এসে পৌছালো ট্রেন। যাত্রীর সংখ্যা আগের চেয়ে আরও দিগুণ হলো। যেখানেএকটু আগে হাল্কা আরাম করে দাঁড়ানো যাচ্ছিলো এখন সেখানে লীলা গা বাঁচিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।

লীলা যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড় পরিবারটার কর্মকান্ড দেখছিল তখন নিজেকে তার সিনেমার ভুত বলে মনে হচ্ছিল। এমনটা তার প্রায়শই মনে হয়। সে সবার গল্পের মাঝে বসে থাকে বটে তবে সে কারও অক্ষিগোচর হয় না। আহ এবার যেন ভালো লাগাটা সত্যি উবে যাচ্ছে। দাঁড়ানোর সমস্যাতো আছেই এর সাথে বাড়তি যোগ হয়েছে সূর্যের কড়া শাসন। বেলা বাড়তে থাকায় সূর্যের তীব্রতা সহ্যেও সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। আর চট্টলা নামক অচেনা ট্রেনটির অমায়িক ব্যবহারে সে শঙ্কিত হবে না কি অবাক হবে তা ভেবে পাচ্ছিল না।

কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পর বিমান বন্দর স্টেশনে পৌঁছুতে এতটাই সময় লাগলো যে লীলার শংকা হতে লাগলো সে ১২ টার ট্রেন আদৌ ধরতে পারবে কিনা !ঘড়ির কাটা ইতোমধ্যে দুপুর বারোটা ছুঁই ছুঁই।লীলাবতীর বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তার সাথে কি ঘটনা ঘটতে চলেছে। তার জানা মতে (খুবই আবছা ভাবে জানা) দুপুর বারোটা, দুইটা এবং চারটা এই তিন সময়ে লঞ্চ পাওয়ার কথা তাদের ভৈরব লঞ্চঘাটে। যেহেতু ঘড়ির কাটা প্রায় বারোটা, তাই সে মনে মনে প্রথম ধাপের লঞ্চের আশা ছেড়ে দিয়েছে। আবার সে চিন্তা ছেড়ে নিজের মতো ভাবনার জগতে হারিয়ে যাবে ভেবে যখন ট্রেনের দরজার কাছে পা টা রাখতে যাবে সেখানে সে এক পথ শিশুর দেখা পেলো। কিছুক্ষণ সে ছেলেটিকে পরখ করে দেখে নিল। মজার ব্যাপার হলো ছোট্ট ছেলেটি লীলাকে দেখানোর জন্য বার বার ট্রেনের দরজা ধরে ঝুলে যাচ্ছিল। ব্যাপারটাতে মজা পেয়ে লীলা পিচ্চির সাথে কথা বলবে সিদ্ধান্ত নিল।

তোমার নাম কি?

সুমন

থাকো কোথায়?

ইয়ারফুটেই থাকি।

আর কে থাকে?

আমার আর কেউ নাই।

লীলা একটু থামল। কিন্তু সে খেয়াল করে দেখল সুমন কাকে যেন খুব গালিগালাজ করছে। সে আশে পাশে একটু তাকিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করলো যে সুমনকে কেউ কিছু বলেছে কিনা। খানিক বাদে লীলা ঘটনাটা আঁচ করতে পারলো। সুমন ট্রেনে ওঠার সময় তার সাথেই স্টেশনে থাকে আরেকটি ছেলে তাকে বকছে। কারণ সুমন ট্রেনে ওঠার সময় সেই ছেলেটি তাকে উঠতে দিতে চাইছিলো না এবং সুমন কে কষে এক চড় মেরেছে। এবং সুমন এই ঘটনার প্রতিশোধ নেবে এই মর্মে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সাক্ষী গোপাল হল লীলা। সুমনের ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে ঝুলে থাকাটায় লীলা খুব অবাক হয়েছে তাই সুমনের ঝুলে থাকার সময় ও পরিধিও বেড়ে গেছে। সে আরও বেশি বেশি করে ঝুলতে লাগলো। লীলা তাকে থামতে বলল। সুমন সাথে সাথে থেমে গেলো।

কি কর?

আমি এই ট্রেনের ইঞ্জিন ঠিক করি। হেই লেইগ্যা ট্রেন যেইহান যায় আমারও যাওয়া লাগে।

টাকা টুকা দ্যায়? নাকি এমনি করো?

দ্যায়। আমি মাসে ২০০০০ ট্যাহা ইনকাম করি। ছোট মানুষ দেইখ্যা আমার ট্যাহা

হেরা রাইখ্যা দ্যায়। শুধু হাত খরচ আর খাইবার খরচ দ্যায়।

লীলা আর দিনার সাহেব একজন আরেকজনের দিকে চেয়ে হেসে উঠলো। তারপর আবার জিজ্ঞাসা শুরু করল,

তুমি জানো ২০০০০ টাকায় কত হয়?

জানি।

বলেই সুমন টাকার হিসেব শুরু করলো। আর যাই হউক সেই হিসেবে যে কত গোলমাল তা বুঝতে দেরি হলো না। তবে সময় যত গড়াতে লাগলো লীলার সাথে সুমনের খাতির তত বাড়তে লাগলো। যেন সুমন এসেছে লীলার সাথেই। আর তাকে দেখে রাখাই তার একমাত্র কাজ। এর মাঝে একবার লীলার পানি পিপাসা পেয়েছিল। সুমনকে লীলা বলেনি তার পরেও সে নিজে থেকেই পানি আনতে গিয়ে ট্রেন মিস করতে বসেছিল। পথিমধ্যে যোগ হয়েছে আরেক সাধু বাবা। এখন যেন দুজন মিলে লীলা কে পাহাড়া দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

ট্রেনের ছুটে চলা। রোদে পুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা, সুমনের কাছ থেকে হঠাৎ পাওয়া আন্তরিকতা, সাধু বাবার অবস্থান সব মিলিয়ে লীলা কেমন রোমাঞ্চিত বোধ করতে লাগলো। রোদে পোড়া ব্যাপারটা আর গরমের কিটকিটে ভাবটা না থাকলে সব মিলিয়ে বেশ লাগছে। লীলা উপলব্ধি করলো “জীবনটা সত্যি খুব সুন্দর!” হঠাৎ জীবনের প্রতি অদ্ভুত ভালোলাগায় লীলার মনটা ভরে উঠল। সাধু বাবা কারও সাথে কথা বলছে না। তিনি বসায় লীলার যে উপকারটা হয়েছে তা হলো এই হতচ্ছাড়া ট্রেনটা কোন কথা নেই বার্তা নেই ট্রেন থামিয়ে দেয়। আর যখনই ট্রেন টা থামে তখনই সব লোক হুড়মুড় করে নামতে থাকে সে যেখানে দাঁড়িয়েছে সেদিক দিয়ে। আর এখন সাধু বাবা বসার কারণে কেউ আর এদিকে নামার সাহস পাচ্ছে না।

সময়টা বেশ কাটছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না সূর্য মামার তীব্র শাসনে লীলার বেহাল অবস্থা হল। তার গাল রোদে লাল হয়ে যেতে থাকল। এবং এর সবচেয়ে খারাপ দিক হল লীলার গাল জ্বালা করতে শুরু করলো। আর তার সাথে এই ট্রেনের অমায়িক ব্যবহারে সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বাহ কি ভদ্র ট্রেন রে বাবা! বাংলাদেশে ট্রেনের ভদ্রতার জন্য যদি কোন পুরস্কার দেয়া হতো তবে চট্টলা ট্রেনটি তা পেতো বলে লীলার ধারনা হল। বাংলার এমন কোন ট্রেন নেই যাকে এই ট্রেন টি সাইড না দিচ্ছে। এমনকি লোকাল ট্রেনকেও তিনি সাইড দিয়ে চলছেন। সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এ দেশের কর্মকাজ! এমন যখন অবস্থা লীলা জানতে পারলো যে কোন জায়গায় ইচ্ছে করলেই এই ট্রেন থামানো যায় এবং এর জন্য গুণতে হবে বাড়তি ২০০-২৫০ টাকা। তাহলেই এই অমায়িক ট্রেনটি যে কাউকে তার বাড়ির পাশে নামিয়ে দিয়ে যাবে। এর চেয়ে হতভম্ব খবর লীলা শুনেছে বলে আপাতত মনে করতে পারছে না। কি বলছে এইসব! এও কি সম্ভব!!!

কড়া রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে লীলা পানি পিপাসায় কাতর হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার ব্যাগে পানি নেই। এমনকি কোথাও যে নেমে পানি খাবে তারও উপায় নেই। লীলা সুমনের সামনে কথাটা আনমনে নিজেকেই বলছিল, সুমন সেটা শুনে ফেলেছে কিন্তু কোন কিছু বলেনি। একটু পর যখন অন্য আরেকটি স্টেশনে ট্রেন থামল তখন সুমন এক বাড়ি থেকে পানি আনতে গেলো। একজন টোকাই এর কাছ থেকে বোতল ধার করে। হঠাৎ ট্রেনটি হুইসেল বাজাতেই লীলা সুমনকে এদিক সেদিক খুঁজতে গিয়ে যখন দেখল সে এক বাড়ির মহিলাকে পানি নেয়ার ব্যাপারটা মাত্র বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। লীলা সুমনকে হাত ইশারা করে চলে আসতে বলল। পানি আর খাওয়া হল না। সুমন যখন দৌড়ে আবার ট্রেনে উঠলো তখন ট্রেনটি প্রায় চলন্ত।

 সেই বিশাল পরিবারের সবচেয়ে বড় ছেলেটি হঠাৎ কি কারণে যেন সুমনের উপর ক্ষ্যাপে উঠল। সে সুমনকে ট্রেন থেকে নেমে যেতে বলল। লীলা ঘটনার আকস্মিকতা বুঝে উঠতে পারল না। কারণ লীলার জানামতে ট্রেনে যে কেউ যেতে পারে। কেউ কাউকে এভাবে তাড়াতে পারেনা। সে সুমনকে নিজের কাছে সরিয়ে আনল। কিছু সময় পর লীলা সৌভাগ্যবশত বসার একটি জায়গা পাবে বলে আভাস পেলো। ট্রেন তখন প্রায় ভৈরবের কাছাকাছি চলে এসেছে। সময়ের কাটাও এগিয়েছে অনেক দূর। লীলা সিট পেলো। কিন্তু বসতে না বসতে তার উঠার সময় হয়ে এলো। নিজের সিটটা সে সুমনকে দিয়ে দিল। দিনার সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নামার প্রস্তুুতি নেয়া শুরু করল। অবশেষে ট্রেন ভৈরব স্টেশন এসে পৌঁছল। কিন্তু ঘড়ির কাটা তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলে গিয়ে মিশেছে। ঘড়িতে তখন বিকাল ৩টা বেজে ৩০মিনিট।

স্টেশনে নেমেই দিল দৌড় রিকশার জন্য। একজন রিকশাচালককে জিজ্ঞাস করল, “ভাই লঞ্চ কি পাওয়া যাবে?” রিক্সাচালক কি বলল লীলা সেটা খেয়াল করার মত অবস্থায়ও নেই। রিকশাচালক শুধু বলল “আফা উডুইন” সাথে সাথে সে রিকশায় চড়ে বসল। তবে সে ধারনা করে নিল যেহেতু তিনি তাকে উঠতে বলেছেন তার মানে লঞ্চ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে! কিন্তু লঞ্চ ঘাটে যেতে যেতে লীলা টের পেল কত বড় অনিশ্চয়তার ফাঁদে সে পা দিয়েছে। মজার ব্যাপার হল তার দুশ্চিন্তা দেখে বেচারা রিকশাচালকও চিন্তা শুরু করে দিল। চিন্তা মনে হয় এক ধরনের সংক্রামক রোগ যা খুব সহজেই সংক্রামিত হয়।

লঞ্চ ঘাটে সে যখন নেমে রিকশা ভাড়া দিতে যাবে তখন রিকশাচালক তাকে বলল “আফা আগে দেইখ্যা আইন, আমি ইহানই আছি, ভাড়া ফরে দিলেও চলবো”। লীলা আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে ছুটে গেলো। লঞ্চঘাটে সবসময় হইচই হতে থাকে লীলা তার কিছুই দেখতে পেলো না। হইচই-এর বদলে সে দেখতে পেলো দু-তিনটে উঠতি বয়সের ছেলে খোশগল্পে মেতে উঠেছে আর বাকি সব ফাঁকা। গল্পের বিষয় “বিড়ি”। চিৎকার করে তারা তাদের গল্পগুলো করছে। এমন সময় লীলা সেখানে পৌঁছল। সে এসে তাদের খোশগল্পে ব্যাঘাত করে ফেলল। সবাই খুব অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। 

এই অসময়ে একা একটি মেয়েকে দেখে আবার হয়তোবা প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি লম্বা মেয়ে বলেই তাদের অবাক হওয়ার ব্যাপারটা প্রসারিত হল। হ্যাঁ লীলার যে কারণে সব মানুষের নজরে পড়ে, যার জন্য সে কমলাপুর স্টেশনে টিকেট কাউন্টারের ভদ্র মহিলার নজরে খুব দ্রুত পড়েছিল, যা নিয়ে লীলা বরাবরই খুব বিরক্ত, আবার কখনও কখনও এর সুবিধাগুলোও পায় তার কারণ হলো তার অতিরিক্ত উচ্চতা। অন্য আর দশটা মেয়ের চেয়ে তার উচ্চতা এ দেশের তুলনায় একটু বেশী। যার কারণে তাকে সেই ছোট্ট বেলা থেকেই কিছু হেয়ালিপনা এবং একই সাথে বিরক্তিকর কিছু কথা শুনতে হয়।

সবগুলো ছেলে এক সাথে তার দিকে অবাক ভাবটা সরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। লীলা তাদের দৃষ্টির প্রত্যুত্তর করলো পাল্টা প্রশ্ন করে “অষ্টগ্রামে যাওয়ার লঞ্চ কখন ছাড়বে?” একজন উত্তর করল “লঞ্চ তো গ্যাছে গা কুম্বালাঅই! আইজকা আর কুনু লঞ্চ নাই । কিন্তুক ট্রলার আছে। ইডা রাইতের ১০ টা সময়!” লীলার মনে হল তার গালে কষে কেউ চড় মেরেছে ! সে তাদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করল আর কোন উপায় আছে কি না? তারা সবাই জানালো অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তবে যদি সে কুলিয়ারচর পৌঁছতে পারে ৪০ মিনিটের মধ্যে তাহলে সেখানকার লঞ্চঘাট থেকে ৪ টা ৩০ মিনিটে যে ট্রলার যাবে তাতে অষ্টগ্রাম যেতে পারবে, তবে তারা কোন প্রকার নিশ্চয়তা দিতে পারছেনা। কারণ তারাও সঠিকভাবে জানে না।

বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে লীলা দৌড় দিল রিকশার কাছে। রিকশাচালকও যেন প্রস্তুত। লীলাকে দেখেই যা বোঝার তা বুঝে নিল। আস্বস্ত করল এবং জানাল, একটু আগেই খোঁজ নিয়েছে, জানতে পেরেছে কুলিয়ারচড়ে ৪.৩০মিনিটে একটা ট্রলার আছে। লীলার সন্দেহ দূর করার জন্য সে নিশ্চিত করে জানালো যে যার কাছ থেকে জেনেছে তার বাড়ি ওই লঞ্চ ঘাটের পাশেই। তাই ভুল হওয়ার কোন সুযোগই নেই। ঝটপট রিকশায় চড়ে রওয়ানা দিয়ে দিল লীলা। ভেতরে টেনশনে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে তাতে কি, মুখের হাঁসির সাথে তো আর কপ্রোমাইজ করা যাবে না। রিকশাচালকের আন্তরিকতাও চোখে পড়ার মত। আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ এমন বিপদের সময় এমন একজন মানুষকে পাওয়ার জন্য। লোকটা জান প্রাণ দিয়ে রিকশা টানছে। যেন লঞ্চ মিস করা চলবে না কোনভাবেই। রিকশাচালক ভাই সিদ্ধান্ত নিল শর্টকাটওয়েতে যাবে কিন্তু কিছুতেই কিছু হলনা। 

কিছুদূর এগুতেই দেখতে পেলো সেখানে নির্মাণকাজ চলায় সাময়িকভাবে রাস্তাটি বন্ধ আছে। কি আর করা, অগত্যা তাদেরকে সময় সাপেক্ষ রাস্তাই বেছে নিতে হল। তবে লীলা এই মুহূর্তে একটু যেন রিল্যাক্স। টেনশন জিনিসটা মেমোরিকার্ড এর মত কিছু অন্যকে দিতে পারলে নিজেরটা হাল্কা মনে হয়। যেহেতু লীলা টের পেলো তার রিকশাচালকও তাকে নিয়ে ভালই দুশ্চিন্তা করছে তাই তার নিজের এখন একটু কম চিন্তা করলেও হবে। লীলাকে সান্তনা দিয়ে বলতে লাগলো “আফা কুইলারচর যুদি আমি আফনেরে দিয়াইত্তাম তাইলে আমি দিয়াইতামই, কিন্তু রিকশা লইয়াতো অত দূরে যাওন যাইতোনা। কিন্তু আফনে চিন্তা কইরুইন না আমি আফনেরে সিএনজি কইরা দিয়াম”।

সিএনজি স্টেশনে পৌঁছে দুজনেই আক্কেল গুড়ুম! গরুর হাট বসেছে তাই সিএনজি প্রায় নেই বললেই চলে। দু একটা যাও আছে যাত্রী সংকটে এই মুহূর্তে ছেড়ে যাবে না। একটু সামনে এগুতেই একটা সিএনজি পাওয়া গেলো। মোটে সিট ফাঁকা একখানা। রিকশাচালক তাকে যখন জানালো লীলা চটজলদি সিএনজিতে ওঠার জন্য নেমে গেল রিকশা থেকে। কিন্তু বিধি বাম! সিএনজি চালক জানালো তাকে নেয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ সিএনজিতে শুধু তার পাশের সিটটা ফাঁকা আছে আর সেটাতে সে কোন মেয়েকে নিতে পারবে না। যে কোন ধরনের অঘটন ঘটতে পারে। লীলা চালকের কোন কথাতে পাত্তা না দিয়ে বলল “আপনার কোন চিন্তা করতে হবে না, আমি প্রতিদিন বাসে ঝুলে ঝুলে অফিসে যাই, এটাতেও পারব, আর কোন ঘটনা ঘটলে আমি এর জন্য দায়ী, তাও আপনি আমাকে নিয়ে চলেন”। 

চালক সাহেব আপত্তি করার আর কিছু না পেয়ে লীলাকে নিতে বাধ্য হল। আর উচ্চতার দিক থেকে চিন্তা করে তার কাছে কিছুটা নির্ভরযোগ্য হয়তো মনে হয়েছে লীলাকে, লীলার তাই মনে হল। রিকশার ভাড়া বুঝিয়ে দেয়ার সময় রিকশাচালক সিএনজি ড্রাইভার কে বলল “আফারে একটু তাড়াতাড়ি লইয়া যাইয়ুন”। বিদায় নিয়ে আবার যাত্রা শুরু। এবার নতুন নাটক শুরু। চালক সাহেব গাড়ি চালানোর পাশাপাশি, তার সিএনজিতে মেয়েরা সামনে বসে কিভাবে কিভাবে পড়ে গিয়েছিলো সেই গল্প বলতে শুরু করল লীলা কে। এর মাঝে লীলা কে আশ্বস্ত করতেও ভুলল না। প্রায় যখন কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তখন গরু ছাগলের হাটের কারণে তাদের সামনে এগুতে একটু সময় লাগলো। কিন্তু যতটুকু সম্ভব তিনি কায়দা করে ভালই এগুলো। 

লঞ্চঘাটের কাছে প্রায় এমন সময় সিএনজি ড্রাইভার আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললেন, “আফা আফনে হাইট্টা যাইনগা, তাইলেও তাড়াতাড়ি যাইতে ফারবাইন যেই জ্যাম লাগসে সামনে”। হায়রে জ্যাম এই মফস্বলকেও মুক্তি দিল না। ভাড়া চুকিয়ে সে লঞ্চ ঘাটের দিকে হাঁটা দিল। যদিও লীলা দাদা বাড়ি যায় না বহু বছর কিন্তু বাবা-মা কে প্রায়শই লঞ্চে উঠিয়ে দিতে আসে সে কুলিয়ারচর পর্যন্ত। তাদের কে লঞ্চে উঠিয়ে আবার ঢাকায় চলে যায়। তাই ভৈরবের মত এই জায়গাটাও তার অচেনা নয়। তবুও আজ যেন কেমন কেমন লাগছে। হয়তো আজকের এই বেপরোয়া জার্নি এবং মনের ভেতর চেপে থাকা অজানা আশংকা তাকে দ্বিধায় ফেলে দিচ্ছে। দ্রুত পায়ে হেঁটে যখন সে লঞ্চঘাটে পা রাখল আর দেরি না করে দৌড় দিল শেষ মাথায়। শেষ মাথায় এসে সে চারিদিকে তাকিয়ে ধুধু খাঁখাঁ মাঠের মত শুণ্য লঞ্চঘাট দেখতে পেলো। তবে খুব বেশি সময় আগে ছেড়ে যাইনি লঞ্চটা। মাত্রই ছেড়েছে ঘাটের অল্প দূরেই নদীতে দেখা যাচ্ছে লঞ্চটা যাচ্ছে। (চলবে)