শায়লা শবনম
‘ঐ শাড়িটা দেখি, ওটা নামাও তো।’ ইনানির কথায় ছেলেটা কালো শাড়িটা নামিয়ে ঝুলিয়ে দিলো উপরের স্ট্যান্ডের সাথে। ‘নাহ, এটা তো দেখি একদম কালো! সেইম শাড়ি অন্য কোন রঙের নাই?’ ইনানি আবার জিজ্ঞেস করে। ‘আছে তো আপা। এই যে এই দুইটা দেখেন।’ ছেলেটা আরও দুটো শাড়ি বের করে ঝুলিয়ে দেয়। ‘নীল শাড়িটা দেখ তো ঝুমু, কেমন লাগছে?’ ইনানি ঝুমুকে জিজ্ঞেস করলো। ঝুমু এতক্ষণ চুপচাপ পাশে বসে ছিল, এবার শাড়িটা ভালো করে দেখলো। নেভি ব্লুর উপরে লাল এবং সাদায় ময়ূরের নকশা। পাড়েও বেশ জমকালো কাজ। কালোটাতেও একই কাজ, শুধু রঙটা আলাদা।
‘সুন্দর তো!’ সংক্ষেপে উত্তর দেয় ঝুমু। ‘এটা নিয়ে নেই কি বলিস?’ ‘নিতে পারিস। আমার তো বেশ ভালো লাগছে।’ ‘আচ্ছা ভাই এটাই প্যাকিং করে দেন। ঝুমু, তুই কিছু নিবি নাকি?’ ‘আপনি এইটা নেন, এটা আপনারে মানাবে।’ পৌঢ় লোকটা, সম্ভবত দোকানের মালিক, কালো শাড়িটা এগিয়ে দিলেন ঝুমুর দিকে। অনেকক্ষণ থেকেই তিনি লক্ষ্য করছেন বারবার ঘুরেফিরে এই শাড়িটাই দেখছে ঝুমু। ঝুমু কিছুটা অনাগ্রহের সাথে বললো, ‘নাহ, থাক। দাম বেশি!’ ‘দাম বেশি না মা। এই দামে এই শাড়ি পাবেন না কোথাও।’ ইনানিও সায় দিলো লোকটার কথায়। বললো, ‘পছন্দ হলে নিয়ে নে ঝুমু। এই কোয়ালিটির শাড়ির জন্য প্রাইসটা খুব বেশি না কিন্তু।’
ঝুমু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আস্তে করে। ইনানির জন্য দামটা বেশি না, তার হাসবেন্ড বড় ব্যবসায়ী। কিন্তু ঝুমুর জন্য দামটা অনেক। সে বললো, ‘আমি তো এতো টাকা নিয়ে বের হই নাই। তোর জন্যেই আসলাম। আমার কেনার কথা তো চিন্তা করি নাই।’ ‘আচ্ছা, কিছু নাহয় এডভান্স দিয়ে যান। কাল পরশু এসে বাকিটা দিয়ে নিয়ে যাবেন।’ পৌঢ় আবার বললো।
ঝুমু দেখে তার ব্যাগে পাঁচশো টাকার একটা নোট আর কিছু খুচরা আছে। পাঁচশো দিয়ে এডভান্স করা যায় অবশ্য। কিন্তু কাল হোক পরশু হোক বাকি টাকা তো দিতেই হবে। কোন অকেশন ছাড়া এইমুহূর্তে এতো দাম দিয়ে শাড়ি কেনা উচিত হবে কিনা সে বুঝতে পারছে না। তাই কিছুটা দ্বিধা নিয়েই সে বললো, ‘না থাক। চল ওঠা যাক।’ ‘ঠিক আছে, ওটাই প্যাক করে দেন।’ ছেলেটা শাড়িটা প্যাকেটবন্দী করে দিলে ইনানি দামটা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বেরিয়ে আসার সময় পৌঢ় লোকটা আবার বললো, ‘শাড়িটা কিন্তু নিতে পারতেন। দাম বেশি বলি নাই। আপনাকে শাড়িটায় মানাতো খুব।’ ঝুমু কোন উত্তর দিলো না, বের হয়ে গেলো ইনানির সাথে।
.
.
কেমন হলো তোমাদের শপিং?’ রিমোট হাতে টিভিতে বিভিন্ন চ্যানেলে ঘুরতে ঘুরতে জিজ্ঞেস করলো সাজিদ। ‘ভালো।’ ঝুমু ছোট করে উত্তর দেয়। ‘কী কেনা হলো দুই বান্ধবীর? ‘’দুই বান্ধবী না, ইনানি শাড়ি কিনেছে। মিতুলের বিয়ে সামনে, বিয়েতে নতুন শাড়ি পরবে সবাই।’ ‘সবাই মানে তোমরা সব বান্ধবীরা?’ ‘হুম।’ ‘তাহলে তুমি কিনলে না কেন? তুমিও একটা কিনতে।’ ‘কিনলাম না তোমার কথা ভেবে। তোমার হাতে এখন টাকা আছে কিনা জানি না তো। একটা শাড়ি অবশ্য পছন্দও হয়েছিলো। ওটারই অন্য রঙেরটা ইনানি নিয়েছে। কালোর ওপর কী চমৎকার কাজ! কিন্তু দামটা বেশি।’
সাজিদ লক্ষ্য করলো শাড়িটার কথা বলতে গিয়ে ঝুমুর চোখমুখ কেমন ঝলমল করছে। খানিকটা বিস্মিত হয় সাজিদ, শাড়ি চুড়ি নিয়ে আলাদা কোন আগ্রহ প্রকাশ করতে ঝুমুকে কখনো দেখেনি সে। এমনকি অন্য কোন বিলাসদ্রব্য নিয়েও নয়। মনে মনে খুশিই হয়েছিল সে, কেনাকাটা নিয়ে ঝুমু অতি উৎসাহী হলে তার উপর বাড়তি চাপ তো পড়তোই। হয়তো বাবা মাকে পাঠাতে গিয়ে টান পড়ে যেতো টাকায়। এমনকি এই যে প্রতিমাসে বেতন পাওয়ার পরে একটা নির্দিষ্ট এমাউন্ট সাজিদ পাঠায় বাবার একাউন্টে সেটা নিয়েও বিয়ের পরে এই দেড় বছরে কোন প্রশ্ন করেনি ঝুমু। এজন্য মনে মনে স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতাই অনুভব করেছে সবসময় সাজিদ।
সে জিজ্ঞেস করলো, ‘কত প্রাইস ছিল শাড়িটার?’ ‘চার হাজার।’ ‘আমি টাকাটা দিচ্ছি তোমাকে। কাল গিয়ে নিয়ে এসো।’ ঝুমু বিস্মিত হয়ে বললো, ‘এতো দাম দিয়ে এখন শাড়ি কিনবো?’ ‘একটা শাড়িই তো পছন্দ করেছো, গয়নাগাটি বা অন্য কোন দামী জিনিস তো তুমি কখনো চাওনি আমার কাছে।’ ‘বিয়ের সময় যে গয়না পেয়েছিলাম সেগুলোই তো পরা হয় না। নতুন গয়না দিয়ে কি হবে! অহেতুক খরচ।’ ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, গয়না থাক। কিন্তু ঈদ কোরবানিতেও তো তুমি তেমন দামী কাপড় কেনো না। শাড়িটা তুমি নিয়ে এসো, আমার ভালো লাগবে।’
.
.
পরেরদিন একটু তাড়াতাড়িই রান্নাবান্নাসহ সব কাজ সেড়ে নিলো ঝুমু। বাসার কাজে কোন হেল্পিং হ্যান্ড রাখেনি সে। দুজন মানুষের সামান্য কাজগুলোর জন্য বুয়ার পেছনে অযথা টাকা খরচ করার কোন মানে হয় না। এইটুকু কাজ একাই করতে পারে সে। অবশ্য তার বোন এবং বান্ধবীরা এজন্য তাকে কিপটে মনে করে। তা করুক, কিন্তু প্রতিটা কাজের মধ্যেই কেমন একটা মায়া খুঁজে পায় ঝুমু। এরই নাম কি সংসারের মায়া!
বের হতে গিয়েও একটুখানি বসলো ঝুমু। নাহ, এই ঘোর দুপুরবেলা যাওয়া ঠিক হবে না। শপিংমলে দোকানীরা এসময় দোকানের সামনে পর্দা টেনে খেতে বসে। থাক, একটু পরে যাওয়া যাক। ঝুমু মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুক ওপেন করে। স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ করেই একটা পোস্টে চোখ আটকে যায়। একটা এতিমখানার সামনে বাচ্চা একটা মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে ঝুমুর একজন ফেসবুক ফ্রেন্ড।
বাচ্চা মেয়েটার বাবা মা, এমনকি দাদা দাদি বা কাছের কোন আত্মীয় স্বজনই নেই। দমবন্ধ করে ঝুমু পড়ে ফেলে পুরো লেখাটা। বাচ্চা মেয়েটাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তার কী ইচ্ছে করে, প্রথমে কোন কথা বলেনি সে। একটু আদর পেয়ে অনবরত চোখ থেকে জল ঝরেছে তার। তারপর একসময় বলে, মাংস দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করে খুব। সেই ঈদের সময় খেয়েছিল, তারপর আর মাংস দিয়ে ভাত খায়নি সে। লেখাটা পড়তে পড়তে বুকের ভেতর কোথায় যেন মোচড় দিয়ে ওঠে, একটা ভাঙচুর টের পায় ঝুমু। কখন যে তার চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পরে বুঝতে পারে না।
.
.
‘কই, কি শাড়ি কিনেছো দেখাও।’ অফিস থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে টিভির সামনে বসেই সাজিদ বললো।
‘তুমি বসো, আমি চা নিয়ে আসি।’ ঝুমু রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। আজ কেমন একটা সংকোচ, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় কাজ করছে তার মধ্যে। সাজিদের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না সে।
‘নিয়ে আসো শাড়িটা। দেখি কালো শাড়িতে কেমন মানায় আমার বউকে।’ চায়ে চুমুক দিয়ে সাজিদ আবার বললো। নিমকিটা খাও না! তুমি এটা পছন্দ করো, তাই আনলাম।’ ঝুমু বললো। ‘থ্যাংকু, আচ্ছা শাড়িটা আনো তো।’
‘চিনি হয়েছে চায়ে? চিনি আনবো?’ হড়বড়িয়ে বলে উঠতে গেলে ঝুমুর হাতটা টেনে ধরলো সাজিদ। জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে ঝুমু? কোন সমস্যা?’
‘নাহ, সমস্যা হবে কেন? আমি চিনি নিয়ে আসি।’
‘চায়ে চিনি হয়নি সেটা তো বলিনি আমি! প্রতিদিনই তো তুমি ঠিক ঠিক চিনি দাও। কিন্তু আজ এমন ছটফট করছো কেন?’ সাজিদ বিস্মিত হয়ে বললো।
কিছু না বলে চুপ করে থাকে ঝুমু। সাজিদ কোমল কণ্ঠে বললো, ‘আমাকে বলবে না কী হয়েছে? শাড়িটা পাওনি? বিক্রি হয়ে গেছে? আচ্ছা ওটা না পেলে অন্য একটা কিনবে, মন খারাপ করার তো কিছু নাই। কাল আমরা দুজন মিলেই যাবো, ঠিক আছে?’ যেন বাচ্চা একটা মেয়েকে বোঝাচ্ছে এভাবে বললো সাজিদ।
ঝুমু আস্তে আস্তে বললো, ‘কোন দরকার নেই। বিয়েতে পরার জন্য আমার নতুন শাড়ি লাগবে না সাজিদ। অনেক শাড়ি আছে তো, ওখান থেকেই একটা পরবো না হয়।’
‘কেন! আমি তো সকালে শাড়ি কেনার জন্য তোমাকে টাকা দিয়ে গেলাম! তাহলে কিনবে না কেন?’
সাজিদের কথার উত্তর না দিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুক থেকে একটা ছবি বের করলো ঝুমু। বললো, ‘এই ছবিটা দেখো তো সাজিদ। পোস্টটা পড়ো প্লিজ।’
সাজিদ আজ একের পর এক বিস্মিত হচ্ছে। ফেসবুকের পোস্ট এতো পড়ার কী আছে! কিন্তু ঝুমু আগ্রহ নিয়ে বলেছে বলে পড়লো সে। তারপর বললো, ‘খুবই দুঃখজনক! এরকম কতো বাচ্চারা আমাদের আশেপাশে আছে। খারাপ লাগে, কিন্তু তাদের জন্য কিছু করার সামর্থ তো আমাদের নাই। সমাজের বিত্তবানরা যদি এগিয়ে আসে তাহলে কিছুটা কষ্ট অন্তত লাঘব হয় বাচ্চাগুলোর।’
‘যাদের এগিয়ে আসার আসুক, কিন্তু আমাদের যতটুকু আছে সামান্য হলেও সেখান থেকে কি কিছু করতে পারি না আমরা?’
‘হয়তো পারি। কিন্তু হঠাৎ করে এসব কেন বলছো বলো তো?’
‘সাজিদ আমি, আমি…. ‘ কথা শেষ করে না ঝুমু।
‘হ্যা বলো, তুমি কী?’
‘আমি শাড়ির টাকাটা থেকে ওদের জন্য কিছু পাঠিয়ে দিয়েছি।’
‘শাড়ির টাকা পাঠিয়ে দিয়েছো মানে?’ হতভম্ব হয়ে বললো সাজিদ।
‘লেখাটা পড়ে এত্তো খারাপ লাগছিল! বেশি কিছু না, বাচ্চাটা শুধু মাংস দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছে! কী সামান্য চাওয়া! অথচ সেটাই ওরা পায় না! আর আমরা….. ‘
‘পুরো টাকাটা দিয়ে দিয়েছো?’
‘না না, পুরোটা পাঠাইনি, মাত্র এক হাজার।’
‘মানে, তুমি এক হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলে এই পোস্টটা দেখে! চেনা নেই, জানা নেই, সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের নম্বরে! এটা তো ভুয়াও হতে পারে!’ এখনো হতভম্ব সাজিদ।
ঝুমু অপরাধী কণ্ঠে বললো, ‘আমি বিশ্বাস করি এটা ভুয়া না। এদের অনেক কর্মকাণ্ড তো দেখেছি এর আগে। চার হাজার টাকা দিয়ে শাড়ি কিনতে চেয়েছিলাম শুধু একটা বিয়েতে পরার জন্য। সেটা না হলেও তো তেমন কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু একবার ভাবো, বাচ্চাগুলো ভাতের সাথে একটুকরো মাংস পেয়ে কি খুশিটাই না হবে! ওদের সেই আনন্দটার কাছে আমার একটা নতুন শাড়ি পাবার আনন্দ তো কিছু না সাজিদ।’ বলতে বলতে কেমন কণ্ঠ ধরে আসে ঝুমুর। সাজিদ কিছুক্ষণ বসে থাকে বিমূঢ় হয়ে। কোন উত্তর দিতে পারে না।
ঝুমু আবার বললো, ‘তুমি, তুমি খুব রাগ করেছো, না?’
‘নাহ রাগ করি নাই। সত্যিই তো, ওদের এই একটুকরো আনন্দের কাছে আমাদের আনন্দটা খুব সামান্য, খুব সামান্য ঝুমু।’ ঝুমুর কাঁধে হাত রেখে কোমল কণ্ঠে বললো সাজিদ।
মেসেঞ্জারে তখনই কিছু ছবি চলে আসে। এতিমখানা থেকে তুলে জুয়েল ভাই পাঠিয়েছেন। অপার্থিব স্বর্গীয় হাসিতে উদ্ভাসিত বাচ্চাদের ছবি। ছবিগুলো দেখে ঝুমু আর সাজিদের মুখেও ফুটে ওঠে একমুঠো প্রাপ্তির স্বর্গীয় হাসি।
ভালো লাগল। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গল্প।