0

ঋতুস্নান

Share

সেলিনা হোসেন

আমার নাম মারসাই। ছোট্ট করে সবাই ডাকে মার্সি। আমি আমার নাম নিয়ে খুশি। নানাকিছু আমার পছন্দের মতো হলেই আমি খুশি থাকি। আমার চাহিদার বাড়াবাড়ি নেই।আমি আদিবাসী রাখাইন সম্প্রদায়ের মেয়ে। কতকাল আগে আমার পূর্বপ্রজন্মের মানুষেরা এখানে এসে বসতি করেছিল সেসব গল্প আমার দাদু-দিদিমা জানতো। দাদু বলতো, যারা এখানে প্রথমে এসেছিল তারা এখানে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি শুরু করেছিল। বাবা-মা বলে এখন এই বসতির ঠিকানা পটুয়াখালির কলাপাড়া উপজেলার মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের কড়চাপাড়া গ্রামে। আমি এই গ্রামটির নাম নিয়ে খুশি। অন্য গাঁয়ে গেলে কেউ যদি আমার গাঁয়ের নাম জিজ্ঞেস করে তখন আমি বেশ জোরেসোরে গাঁয়ের নাম বলি। কেউ কেউ বলে, মেয়েটা একটা পাগল। নিজের গ্রাম নিয়ে এত খুশি হওয়ার কি আছে! আমি কাকে বোঝাবো যে খুশি হওয়ার কত কিছু আছে। আমি বেশি খুশি যেএটা আমার দিদিমার গ্রাম। বিয়ের পরে দাদু তাঁর শ্বশুরবাড়িতে থাকতে আসেন। এটা মাতৃসূত্রীয় রাখাইনদের সামাজিক নিয়ম। বিয়ে হলে ছেলেকে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে হবে। আমার দাদু-দিদিমা বেশ সুখেই সংসার করেছেন। দিদিমার বাবা তাদেরকে বত্রিশ বিঘা মাঠান জমি দিয়েছিলেন। দাদু নিজে কৃষিকাজ দেখতেন। ঘরে ফসল ওঠাতেন। দিদিমা সেগুলো যত্ন করে সঞ্চয় করতেন। সারাবছর ঘরে কোনো অভাব থাকতোনা। আমার মা খুশির স্বরে সেসব দিনের কথা গল্প করতেন। তাঁরা দুই বোন দুই ভাই ছিলেন।আমি যখন দিদিমার আদর বুঝতে শিখি তখন তাঁর বেশ বয়স হয়েছিল। তার চেয়েও বেশি তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গিয়েছিল সাগরের ঝড়ে দুই সন্তান হারিয়ে।দিদিমা এমন করে গল্পটা বলতেন আমাকে, জানিস সেদিন সাগর খুব রেগে গিয়েছিল। আমার দু’চোখে বিস্ময় জমা হতো। জিজ্ঞেস করতাম, সাগর কেমন করে রেগে যায় দিদিমা? দাদু যেমন রেগে যায় তেমন? তারচেয়েও বেশি। তোর দাদুর রাগের চেয়ে লক্ষ গুন বেশি রাগ থাকতো সাগরের।সেদিন সাগর কেন রাগ করেছিল দিদিমা? আমি জানি না। বোধহয় আমাদের কোনো পাপ ছিল।

পাপ? মানুষের পাপের জন্য সাগর রাগবে কেন? মানুষ যদি সাগরের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে তাহলে সাগরতো রাগবেই। এভাবেই দিদিমার সঙ্গে গল্প শুরু হতো। তারপর দিদিমা বলতেন সাগরের সেই ঝড়ে কেমন করে তছনছ হয়ে গিয়েছিল দাদু-দিদিমার সংসার। সেই ঝড়ে দিদিমা হারিয়েছিল তার বড় মেয়ে আর ছোট ছেলেকে। আমার মাকে পেয়েছিল পাশের গ্রামে। আর মামাকে পেয়েছিল আমাদের গাঁয়েরই অন্য ধারে। দাদু আটকেছিল গাছের ডালে। দিদিমা সাগর-সৈকতে পড়েছিলেন। অনেক পরে তাঁর জ্ঞান ফিরে এসেছিল। আমি ভয়ে কুঁকড়ে থেকে বলি, এটা কি দৈত্য-দানবের গল্প দিদিমা? দিদিমা চুপ করে থেকে বলতেন, না মানুষের পাপের গল্প। তুমি বারবার মানুষের পাপের কথা বলো কেন দিদিমা? দিদিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে থাকে। তারপর নিজে নিজেই বলে, এটা আমার মনে হয় দাদু। মানুষই সাগরকে খেপায়। এই ধরো সাগরে বড় বড় জাহাজ ভাসায়। সাগরের জল নষ্ট করে। সাগরের মাছগুলো ধরে ফেলে  এইসব দাদু, এইসব। এইসবই আমার মনে হয়। আমাদের অনেক পাপ জমেছে। এরপরে দিদিমা কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার মেয়ের মরদেহ দেখে ওকে চিনতে পারিনি। চিনেছিলাম কানের ফুল আর গলার চেন দেখে। ছেলেটিকে চেনার উপায় ছিল না। গাঁয়ের লোকে বলেছিল, এটা আপনারই ছেলে। আমিও মেনে নিলাম। বললাম, হোক। ও আমার ছেলেই হোক। তবুতো আমার কাছে ফিরে এসেছে। সাগর আমাকে বলেছে, ওকে বুকে নাও। আমি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলি, দিদিমা তোমার অনেক কষ্ট, না? হ্যাঁ রে, আমার বুকভরা কষ্ট। আমি বলি, তোমাদেরকে আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করতে হয়েছিল? আমরা সব হারিয়েছিলাম। ধানের গোলা, গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি, গাছ-গাছালি। এমনকি আমাদের ঘর-দুয়োরও ভেসে গিয়েছিল দাদু। তোর মা আর মামা আমাদের কোলে ছিল বলে আমরা নতুন করে শুরু করেছিলাম। আমাদের ভাঙা বুক জোড়া লাগিয়েছিল।

সেই বড় ঝড়ের পরে আমাদের পাড়ায় আট ঘর রাখাইন পরিবার ছিল। তাদেরই পূর্বমানুষেরা এখানে জঙ্গল কেটে বসতি করেছিল। দাদু-দিদিমা বলতেন, বাঙালিরা রাখাইনদের জায়গা-জমি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য শাসাতো। বলতো, তোমরা বার্মা থেকে এসেছো, বার্মায় চলে যাও। আমরা এখানে থাকবো। দাদু বলতেন জায়গাটাতো আমরাই থাকার জন্য তৈরি করেছি। তখনতো তোমরা এখানে বাস করতে না। যখন আমরা এসেছিলাম তখন আমাদের ন্যাংটো থাকতে হয়েছে। বনের ফলমূল খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। তোমরাতো এভাবে থাকোনি। আমরা বসতির জন্য জায়গা তৈরি করার পরে তোমরা বাস করতে এসেছো। এখন আমাদের যেতে বলছো কেন? আমরাতো তোমাদের কোনো ক্ষতি করিনি। আমি নিজেদের ইতিহাসের কথা শুনতে ভালোবাসতাম। নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতির গৌরবের জন্য আমার খুব গর্ব ছিল। হতে পারি আমরা একটি ছোট নৃ-গোষ্ঠী, কিন্তু আমাদের বড় জাতি হওয়ার সবকিছু আছে। শুধু আমাদেরকে সংখ্যায় বাড়তে হবে। দিদিমা বলতেন, এখানে আমরা একটা বড় দল এসেছিলাম। কিন্তু জঙ্গল কেটে বসতি বানাতে গিয়ে অনেক লোক মারা গেছেন। ছোটরা খেতে না পেয়ে মারা গেছে। অনেকে হিংস্র জীবজন্তুর মুখে প্রাণ দিয়েছে। আমাদেরকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল রে নাতনি। এখন বাঙালিরা আমাদেরকে হুমকি দেয়। জায়গা ছেড়ে দিতে বলে। আমাদের জমি দখল করে নিতে চায়। তোমরা প্রতিবাদ করনি দিদিমা? করিনি আবার, করেছি। কিন্তু ওরা সংখ্যায় বেশি। এজন্য ওদের সঙ্গে আমরা পারিনি। ওরা আস্তে আস্তে আমাদেরকে কোণঠাসা করেছে। এখন একদম শেষ করতে চায় রে নাতনি।

দিদিমারদের কাছে শুনেছিলাম বাঙালিদের চাপে সে সময়ে আটঘর পরিবারের ছয় ঘরই সামান্য দামে জমিজমা বিক্রি করে চলে গিয়েছিল। আট বিঘা জমির সমান ছিল এক কানি  মাত্র একশ-দুশ টাকায় সেসব জমি বিক্রি করে দিতে হয়েছিল ওদের। ওরা চলে গিয়েছিল কেন দিদিমা? ভয় পেয়েছিল। ভয়ে চলে গিয়েছিল। দেশে গিয়েও ওদের কোনো শান্তি ছিলনা। পরে শুনেছিলাম। তোমরা ওদেরকে যেতে না করনি কেন? করেছিলাম। শোনেনি। ওদের চলে যাওয়া দেখেছিলাম। আর কেঁদেছিলাম। তোমরা ভয় পাওনি কেন দিদিমা? তোর দাদু আর আমি ঠিক করেছিলাম যে আমরা এখানেই থাকব। আমাদের যা হয় হবে। এই মাটিতো আমাদের দাদু-দিদিমা তৈরি করেছিল। তাহলে এটা আমাদেরই মাটি। আমরা ছাড়ব না। থাকার জন্য লড়ে যাব। বাহ, তোমরাতো খুব সাহসী ছিলে। হ্যাঁ, আমরা খুব সাহস করেছিলাম রে নাতনী। আমাদের সঙ্গে রামদা থাকতো। রাতে বর্শা নিয়ে ঘুমাতাম। কাউকে পরোয়া করতামনা। যারা আমাদের পিছে লেগেছিল তারা আমাদের সাহস দেখে বেশি ঘাঁটায়নি আর। তাছাড়া অনেক বাঙালি পরিবার আমাদের পক্ষে ছিল। ওরা আমাদের হয়ে শয়তানদের সঙ্গে ঝগড়া করতো।

আমি দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে বলতাম, তোমরা ঠিক কাজটি করেছিলে দিদিমা। আমি ওদের পরিষ্কার বলেছিলাম, আমাদের জমি নিতে হলে আমাদের রক্তে পা ধুয়ে নিতে হবে। পারবেন, রক্তে পা ডোবাতে? ওরা থমকে যেত। কথা বাড়াত না। শেষদিকে আমাদের সঙ্গে লাগা বন্ধ করেছিল। তারপর একদিন দাদু মরে যায়। হ্যাঁ। দিদিমা উদাস হয়ে যেতেন। বলতে পারতেন না যে দাদুকে ছাড়া তার দিনগুলো কেমন কেটেছে। শুধু বলতেন, লড়াই লড়াই। আর আমি বলতাম সেই সঙ্গে সাহস। হ্যাঁ, সাহস সাহস। মনে করেছিলাম, মরতেতো হবেই। সাহস নিয়ে মরবো। হার মানবো না। দিদিমার টিকে থাকার গল্প শুনতে আমার খুব ভালোলাগতো। নিজেকে একটি সাহসী মেয়ে হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল আমার। একদিন দিদিমা মরে গেলেন। কেঁদে বুক ভাসলাম। দিদিমাকে প্রায়ই স্বপ্ন দেখতাম। মাঝে মাঝে মনে হতো দিদিমা আমার কাছে বসে আছেন। আমার হাতটা তুলে নিজের গালে বুলিয়ে দিচ্ছেন বলছেন, বেঁচে থাকা একটা লড়াই নাতনি। আমার ঘুম ভেঙে গেলে আমি বালিশে মুখ ঘঁষতাম। মনে হতো বালিশের কোথাও দিদিমা আছে। আমি তার গায়ের গন্ধ পাচ্ছি। আমার বাবা-মাও সাহসী মানুষ। বলেন, আমরা হার মানবো না। এ মাটিতেই থাকবো। নিজেদের স¤প্রদায়কে বড় করে তুলবো। আমরা দুই বোন, এক ভাই। আমি বড়। আমাদের নিয়ে বাবা-মায়ের সংসার ভালোই কাটছিল। খুব বেশি অভাব ছিল না। বাবা কৃষিকাজ করতেন। মাও নানা রকম কাজ করে আয় করতেন। আমাদের স্কুলে পাঠাতেন। আমরা লেখাপড়া শিখে বড় হব, এমন ইচ্ছে ছিল তাদের। আমরা তিন ভাইবোন মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতাম।

কিন্তু গ্রামের লোভী কয়েকজন বাঙালি বাবাকে চলে যাওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতো। আমাদের গরু-ছাগল ধরে নিয়ে যেতো। গাছ কেটে ফেলতো। এসব নির্যাতন বাবা-মা মুখ বুঁজে সইতেন না। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ দিতেন। সালিশ বসতো। কখনো মিটমাট হতো, কখনো হতো না। এসবের মধ্যেই আমাদের দিন কাটছিল। আমার বাবা-মাকে ভিটে ছাড়াতে পারেনি সন্ত্রাসী বাঙালিরা। দুজনেই দিদিমার মতো সাহসী ছিলেন। ওদেরকে বলে দিয়েছিলেন, যা খুশি করতে পার, কিন্তু আমাদের নড়াতে পারবে না। ওরা বাবাকে নানাভবে হয়রানী করত। জমি দখলের জন্য বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এগারো বার মামলা করেছিল ওরা। কিন্তু আদালতে বাবার পক্ষে রায় হয়। দুষ্টু লোকেরা বাবার সঙ্গে পেরে উঠত না। বাবা মামলায় জিতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেছি। হাইস্কুলে যেতে শুরু করি। বখাটে ছেলেরা আমাকে উক্ত্যক্ত করতে শুরু করে। ওই মার্সি, ওই মাছি পেছন থেকে এভাবে টিস করত আমাকে কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে হি-হি করে হাসতো। কখনো শুনতাম, তোমাকে ভালোবাসি মার্সি। একবার তাকাও আমার দিকে। তোমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে রাখবো। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যেত। আমি মাথা নিচু করে হেঁটে কোনোরকমে স্কুলে পৌঁছাতাম। ওরা মাঝে মাঝে খুব খারাপ ভাষায় কথা বলতো। ভয়ে আমার পা কাঁপতো ঠকঠক করে। আমি দৌড়াতেও ভুলে যেতাম। ডাক ছেড়ে কাঁদতাম। আশেপাশের দু’একজন জিজ্ঞেস করতো, কি হয়েছে তোমার? আমি কারও কথার উত্তর দিতাম না। তারপর একসময় দৌড়াতে শুরু করতাম। একদিন এভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি পৌঁছে দেখলাম আমার পা দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। আমি চিৎকার করে মাকে ডাকি। কাঁদতে কাঁদতে বলি, মা দেখো আমার কি হয়েছে। মা ছুটে এসে আমাকে দেখেন। আমি পাগলের মতো লাফাতে থাকি। মা মৃদু ধমক দিয়ে বলেন, দাঁড়া না, দেখি কি হয়েছে। কোথাও পড়ে গিয়েছিলি?

না, কোথাও পড়ে যাইনি। ব্যথা পাইনি। আমার কোথাও কেটে যায়নি মা। আমার কিছুই হয়নি মা। শুধু ওই শয়তানগুলোর ভয়ে আমি দৌড় দিয়েছি।আয়,ঘরে আয়। বুঝতে পেরেছি এটা তোর জীবনের প্রথম রক্ত। প্রথম রক্ত? প্রথম রক্ত কি মা? তুমি ঋতুমতী হয়েছ মা। ঋতুমতী? এটা আবার কি? তুমি বড় হয়েছো। বড়? কত বড়? আমার বয়সতো বারো বছর। বারো বছর বয়সে একটি মেয়ে কত বড় হতে পারে? আমিতো এখনও ছেলেদেরকে ভয় পাই। আমি বড় হলে ছেলেদেরকে আর ভয় পাব না মা। বুঝেছি, তুই তোর দিদিমার মতো সাহসী মেয়ে। আয় ঘরে আয়। তোকে এখন অনেক কিছু শিখতে হবে। ঋতুমতী হলে কি হয় মা? মেয়েরা মা হয়। মেয়েদের মা হওয়ার বয়স হয়। আমি বিড়বিড় করি, মা হওয়ার বয়স হয়, মা হওয়ার বয়স হয়। তাহলেতো আমি অনেক বড় হয়েছি। অনেক বড় হয়েছি  আকাশের সমান বড়। সাগরের মতো বড়। সাগরের একটা বড় ঝড় এলে আমাকে কিছুতেই ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। আনন্দে আমি উচ্ছ¡সিত হয়ে উঠি। মা আমাকে কতকিছু বোঝাচ্ছেন। আমি তাঁর কথা আর শুনতে চাই না। একলাফে উঠোনে নামি। উঠোনে ঘুরপাক খাই। বেলগাছ ছুঁয়ে চালতা গাছের নিচে দাঁড়াই। চালতার সাদা ফুল নাকের কাছে এলে বলি, চালতা সুন্দরী, এখন আমিও ফুল ফোটাতে পারবো। তোমার মতো ধবধবে সাদা ফুল। নইলে আকাশের মতো নীল ফুল। ঘর থেকে মা ডাকেন। ঘরে আয় মার্সি। এসময় এত লাফালাফি করতে হয় না। ব্যথা হবে। ব্যথা? মায়ের কথায় আমি ঘরে ফিরে আসি। বলি, আজ আমার আনন্দের দিন মা। মা মৃদু হাসেন। বুঝতে পারি মা আমার আনন্দ দেখে মজা পাচ্ছেন। তিনি আমাকে যত্ন করেন। মাছের বড় টুকরো খেতে দেন। থালাভরা ভাত দিয়ে বলেন, সব খাবি। ছোট বোন জুসনা বলে, দিদিকে এত খেতে বলছ কেন মা? দিদির কি হয়েছে? এই সংসারে এখন থেকে ও একটা নতুন মেয়ে। ওর যত্ন দরকার। তিন দিন ও স্কুলে যাবে না। ছোট ভাইটি চেঁচিয়ে বলে, কিন্তু, কেন এতকিছু, তা আমাদের জানতে হবে। জানবি, জানবি। মা ব্যস্ত হয়ে উঠে যান। ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে, তোর কি হয়েছে দিদি? মা বলেছেন, আমি বড় হয়েছি।

তুই তো যতটুকু ছিলি ততটুকুই আছিস। একটুও লম্বা হোসনি। আমি লাজুক হেসে বলি, আমি বেশিকিছু জানিনা। মা বোধহয় পরে তোদেরকে বলবে। ছোট ভাইটি ভাতের থালা ঠেলে দিয়ে বলে, ঘোড়ার ডিম! কচুর শাক। হি-হি করে হাসে জুসনা। ওকে হাসতে দেখে ওর মাথায় চাপড় মারে বিলটন। বলে, বেশি হাসলে তোকে আমি । ভ্যাঁ করে কাঁদে জুসনা। আমাদের কারোই আর ঠিকমতো ভাত খাওয়া হয় না। ভাতের থালা ঠেলে রেখে আমরা যে যার মতো উঠে পড়ি। মা এসে হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন। কাউকে কিছু বলেন না। চুপচাপ থালা-বাসন গোছাতে থাকেন। আমি খুশি যে আমি ঋতুমতী হওয়ার পর থেকে মা আমার যত্ন  নেন। মাস গড়ায়। বছর গড়ায়। ঋতুচক্রের আবর্তে আমি বুঝতে পারি কীভাবে মা হতে হয়। আমার শরীর যেন ঝমঝম করে ওঠে। বুঝেতে পারি না যে কোথায় পালাই, কোথায় যাই। বুঝতে পারি ফুলের ওপর মৌমাছির ওড়াউড়ি, বুঝতে পারি পাখির বাসার খবর। ডিম এবং ছানার খবর। আমার সামনে এখন নতুন পৃথিবীর দরজা খুলে যায়। ছেলেগুলো পিছে লাগলে আমি ঘুরে দাঁড়াতে পারি। গরম চোখে শাসন করি। বলি, তোরা বাড়াবাড়ি করবি না। জুতো মারবো। ওরা প্রথমে অবাক হয়। তারপর জিজ্ঞেস করে, তোর কি হয়েছে রে মাছি? আমার নাম ঠিক করে বল। ও বাব্বা, সাহস বেড়েছে দেখছি। বাপ তো দিন দিন ফকির হয়ে যাচ্ছে। গাঁ-ছাড়া করে ছাড়বো। সাহস থাকলে করিস দেখে নেবো। ওদের সামনে দিয়ে আমি হনহনিয়ে হেঁটে আসি। পেছনে শুনতে পাই ওদের কথা কি হয়েছে ওর? এত চোটপাট বেড়েছে কেন? গাঁ ছাড়তে হলে বুঝবে? আমি বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়াই। আমি জানি আমাদের বাড়িতে অভাব নেমেছে। মামলায় বাবা জিতেছেন ঠিকই, কিন্তু হারিয়েছেন জমি। মামলার খরচ চালিয়েছেন জমি বিক্রি করে। এখন মাত্র এক কানি জমি আছে। মা কষ্টে সংসার চালায়। মাঝে মাঝে বলেন, তোরা আয় করতে শুরু করলে আমাদের কষ্টের দিন শেষ হবে রে মেয়ে।

আমি বলি, ধৈর্য ধরো মা। আমাদের দিন ফিরবে। আমার মনে হয় মাকে সান্তনা দেয়ার বয়স আমার হয়ে গেছে। আমি তাদের বড় সন্তান। আমার এখন অনেক দায়িত্ব। আমি দ্বিতীয়বারের মতো আবার সাহসী হয়ে উঠি। আমার মনে হয় আমার জীবনের এক একটি ধাপে আমি অন্য ভাবনা নিয়ে বড় হচ্ছি। পড়ালেখার পাশাপাশি আমার এসব কিছুও শেখা হচ্ছে। এরমধ্যে একদিন জুসনা ঋতুমতী হয়। রক্ত দেখে ও ভয়ে-আতঙ্কে কান্নাকাটি শুরু করে। মা আমাকে বলেন, তুই ওকে সামলা। কি যে পাগলামি করছে। মা ক্লান্ত। মা অনেকখানি নুয়ে পড়েছে। সংসারের অভাবই মাকে দুর্বল করে ফেলেছে। আমি জুসনাকে ঘরে নিয়ে সব বুঝিয়ে বলি। ওর কান্না থামে না। ওর চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলি, তোর মা হওয়ার ক্ষমতা হয়েছে জুসান। ও আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে বলে, মা? আমি হেসে ওর মাথায় চুমু দিয়ে বলি, হ্যাঁ। ঋতুমতী হওয়ার পরেই মেয়েরা মা হওয়ার শক্তি পায়। ও চোখ বড় করে বলে, ওই যে বললে প্রতি মাসে হবে? হ্যাঁ, তাতো হবেই। ও মাথা ঝাঁকিয়ে প্রবলবেগে বলে, না না আমি এত ঝামেলা সহ্য করতে পারবো না। ও চিৎকার করে বলে, আমি মা হতে চাই না। আমি ওর গালে চড় মারি। বুঝতে পারি বেশ জোরেই মেরেছি। আকস্মিকভাবে ওর কান্না থেমে যায়। দু’চোখ বড় বড় করে বলে, মারলে কেন? আমি মা হব কি না হব সেটা আমার খুশি। তোমার কি? এই কথা আর দ্বিতীয়বার বলবি না। কেন বলব না? কেন বলব না? ও দুহাতে আমাকে ধরে ঝাঁকায়। আমি ওকে শান্ত করে বলি, আমাদের অনেক বড় কাজ করতে হবে জুসান। কাজ? ওর চোখে বিষ্ময়ের সীমা নেই। আদিবাসী রাখাইনদের মানুষ বাড়াতে হবে। তাহলে বাঙালিরা আমাদের উপর জুলুম করতে পারবে না।

ধুত, কি যে বলিস এসব আমি বুঝতে পারিনা। আমি এত ঝামেলা সইতে পারবনা। ও আমার সামনে থেকে ছুটে চলে যায়। উঠোনে চক্কর খায়। ঠিক আমি যেভাবে চক্কর দিয়েছিলাম সেভাবে। ওকে দেখতে আমার ভালোলাছে। মনে হয় এমন সুন্দর দৃশ্য আমি অনেকদিন দেখিনি। আমার সামনে ও উড়ে আসা পরী হয়। আলো ছড়িয়ে দিয়েছে বাড়িতে। মা আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলেন, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস যে? কাজ হয়েছে? আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলি, হয়নি। হবে। তুমি কিছু ভেবো না। মা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকান। প্রশ্ন করেন না। আমি বুঝি যে মা আমাকে নতুন করে দেখছেন। ভাবছেন, মেয়েটাকে চেনা লাগছে না। ও বোধহয় নতুন সাহস খুুঁজে পেয়েছে। মায়ের ভাবসাব দেখে আমি খুব আনন্দ পাই। একদিন বাড়িতে এসে বাবা ভেঙে পড়েন। বলেন, নিজেরা এক হতে হবে। নইলে এলাকার রাখাইন স¤প্রদায়কে টিকিয়ে রাখা মুশকিল হবে। আমি মাথা তুলে বলি, বাবা এটাতো নতুন সমস্যা না। আদিবাসী রাখাইনদের তাড়িয়ে দিয়ে ওরা জমি দখল করতে চায়। বাবা নিজেদের জমি নিজেদের রক্ষা করতে হবে। এজন্য সামনে লড়াই আছে। মানুষ চাই। অনেক মানুষ। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আমি বাবাকে বলতে পারি না যে, জুসান ঋতুমতী হয়েছে। ও মানুষ আনবে। তুমি ভয় পেয়োনা বাবা। সাহস রাখো। দিদিমার মতো সাহস। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, কিছু বলবি? তোমার কি তেষ্টা পেয়েছে বাবা? হ্যাঁ রে, খুব তেষ্টা পেয়েছে। দেখতে পাই মা বাবার জন্য ডাবের জল নিয়ে আসছে। বাবা এক চুমুকে সেই জল শেষ করে। আমার মনে হয় বাবাকে সমুদ্র দিলে সেটাও শেষ করে ফেলবেন। পড়ে থাকবে তলানী।

কেউ কেউ বুঝি এমন তৃষ্ণা নিয়ে দিন কাটায়। এসএসসি পাশ করার পরে আমার কুয়োকাটা সাগর সৈকতে যাওয়ার সুযোগ হয়। আমি ততোদিনে রাখাইনদের কাপড় বোনা শিখেছি। স্কুল বন্ধ থাকলে তাঁতে বসি। টুকটাক আয় হয়। মাকে সেই টাকা দেই। মা খুব খুশি যে আমি খুব মনোযোগ দিয়ে কাপড়ে নকশা তুলি। নিজেদের কাপড়ের নকশা আমি হারিয়ে যেতে দেবো না। প্রতিবেশিরা আমার নকশা করা কাপড় কিনতে পছন্দ করে। আমার নাম ছড়িয়ে পড়েছে বেশ। দুষ্ট ছেলেগুলো আমার পিছে আর লাগে না। মা আমাকে বলেন, তুই তোর দিদিমার যোগ্য নাতনি হয়েছিস।  কুয়োকাটা সাগর-সৈকতে দাঁড়িয়ে আমার বুঝি পৃথিবী দেখা হয়। আমি পাগলের মতো জলে ঝাঁপাই। ঝিনুক কুড়াই। লাল কাঁকড়ার পেছনে ছুটে যাই। দেখা হয় মাছ ধরে ফিরে আসা জেলে জর্জির সঙ্গে। ওকে জিজ্ঞেস করি, কি মাছ ধরলেন? ও হেসে বলে, অনেক মাছ ধরেছি। বড় একটা কোল-ভোল পেয়েছি। আমি হাসতে হাসতে বলি, আমার খুব ইচ্ছে করে যে সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরি। সত্যি? এমন ইচ্ছে হয়? হ্যাঁ, হয়। সত্যি বলছি, হয়। জর্জি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলে, যাবে আমার সঙ্গে? যাব। আমি খুব আবেগ দিয়ে উত্তর দেই। যেন ও হাত ধরলে আমি হেঁটে যেতে পারব সমুদ্রের উপর দিয়ে। সমুদ্রের পানি আমার জন্য সমতল ভূমি হয়ে যাবে! জিজ্ঞেস করি, কালকে আমাকে নেবেন? না, কালকে না। তাহলে কবে? আমার কন্ঠস্বর দমে যায়। জর্জি চোখ উজ্জ্বল করে বলে, যেদিন ভরা পূর্ণিমা থাকবে। পুরো চাঁদের ছায়ায় সমুদ্র ঢেকে থাকবে! আর জালের ভেতর ঢুকে যাবে হাজার হাজার মাছ।

আমি হেসে মাথা নাড়ি। পেছনে দাঁড়িয়ে চন্দনা আর মিয়াংচি বলে, কি রে প্রেম হয়ে গেল? আমি রঙিন নুড়ি তুলে সাগরের বুকে ছুঁড়ে মারি। ওদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমার নেই। একদিন ভরা পূর্ণিমার রাতে আমাদের বাসর হয়। বিয়েটা ঠিক তারিখে হবে কিনা এটা নিয়ে আমাদের দুজনের মনে আশঙ্কা ছিল। কারণ মাত্র দুদিন আগে জমির বিরোধ নিয়ে বাঙালি-রাখাইনের মধ্যে মারামারি হয়। তবে বড় ধরণের হাতহত হয়নি। অন্যরা এসে বিরোধ থামিয়ে দেয়। আমার মা বিয়ের তারিখ ঠিক রাখার ব্যাপারে একরোখা ছিলেন বলে আগের তারিখেই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। আমরা দুজনেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। ঘটনা আবার কোনদিকে মোড় নেয় এই ভয়ে আমাদের খুব ভয় ছিল। রাত বাড়ে। চারদিক নীরব হয়ে গেছে। বিছানায় জর্জি আমাকে বলে, আজ ভরা পূর্ণিমা। আমাদের জীবনে এই রাত চাঁদে-ফুলে-সাগরে-মাছে-পাখি-ফসলে ভরে উঠুক। আমি হাসতে হাসতে বলি, বাব্বা, তুমি এত কিছু চাইছ! তুমি চাইবে না? হ্যাঁ, নিশ্চয় চাইব। আমি সন্তান চাই। বেশতো, আমিও সন্তান চাই। আমি পঁচিশটা সন্তান চাই। আঁতকে ওঠে জর্জি।পঁচিশটা! আমি জর্জির বুকে হাত রেখে বলি, আমি রাখাইন স¤প্রদায়কে বড় করতে চাই। ঋতুমতী হওয়ার পর থেকে আমি নিজের মধ্যে এই প্রতিজ্ঞা ধরে রেখেছি। জর্জি দু’হাত বাড়িয়ে আমাকে বুকে টেনে নেয়। আমি আমার চারদিকে সাগরের কল্লোল শুনি।

সেলিনা হোসেন, কথাসাহিত্যিক