জেসমীন আক্তার
শানবাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে কাপড়টা এমন ভাবে আছড়ে যাচ্ছে, দেখে মনে হয় যেন চিরচেনা কোনো শত্রুকে ঘৃণা ভরে চোখ ও কপাল খিচিয়ে অবিরাম পিটিয়ে যাচ্ছে। আর ফাঁকে ফাঁকে একটু বিরতি নিয়ে ক্যানক্যানে শব্দে চিৎকার করে ডেকে উঠছে ফা- লা- নি ইইই। তুই ইস্কুলে যাইবি না? ফালানি অদূর থেকে দৌড়ে এসে মা কে বলছে, হ যামু। ট্যাকা দেও।
কথাটি বলার সাথে সাথে আঁচলের গিট খুলে থুবরানো,মোচড়ানো পাঁচ টাকার নোটটি বের করে মেয়ের হাতে দেয়। ফালানি টাকাটি নিয়ে এক দৌড়ে তার মায়ের চোখের সীমানার বাইরে চলে যায়। আর ওর মা পরম তৃপ্তি ভরে দেখে আর একা একাই কথাগুলো আউড়ে যায়, “আমার মতো মাইনসের বাইত্তে বাইন্দালি খাটবি নি,লেখা পড়া শিখ্যা একটা কলমের গুতা দিয়া হাজার হাজার ট্যাকা কামাবি।”
এই বলে সে আবার কাপড় কাচতে শুরু করে, আর থেকে থেকে কাকে যেন সমানে অভিশাপ দিয়ে যায়। হ্যাঁ, এই অভিশাপ বর্ষনকারী মহিলা ফালানির মা। আমাদের এলাকায় প্রায় চার-পাঁচ বাড়িতে কাজ করতো। ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি ফালানির জন্মের পরপরই ওর বাবা ওদের রেখে চলে গেছে। এই থেকে ওর নাম হয়ে গেছে ফালানি।
আমাদের পাশের বাড়ির বারান্দার একটা ছোট্ট ঘরে ফালানীর মা থাকতো। শুনেছি এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গও নাকি রাতের অন্ধকারে সেই বেড়ার ফাঁক গলে জ্যোৎস্না ঢোকা ঘরটিতে ঢুকে যেত। আমার স্মৃতির দৃষ্টিতে যতটুকু দেখি চামড়ায় মোড়ানো কিছু জীর্ণশীর্ণ হাড়ের অবয়ব মাত্র ফালানির মায়ের।
চেহারায় কোনো সুশ্রী চিহ্ন আমার চোখে পরে নাই। সে যখন ঘাটে কাজ করতো, কখনো ফালানির বাপকে কখনো বা গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে বকে যেত।
তার একটাই স্বপ্ন ছিল, নিজে মানুষের বাড়িতে কাজ করলেও মেয়েকে করতে দেবেনা। মেয়ে পড়াশোনা শিখলে সে কলমের খোঁচা দিয়ে টাকা ইনকাম করতে পারবে এমনটাই তার ধারণা। মায়ের এই চাওয়াটাকে মেয়ে খুব মজা করে উপভোগ করতো এবং যখন তখন কলম লাগবে, খাতা লাগবে বলে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিত।
সবসময়ই দেখতাম ওর হাতে আইসক্রিম নয়তো কাগজের ঠোঙায় অন্য কিছু। মায়ের স্বপ্নটা ওকে ছুঁয়ে যেতে পারেনি, পড়াশোনায় মন ছিল না ওর। সারাদিনই মুখে দ্বিগবিজয়ের হাসি লেগেই থাকতো, মা কে ফাঁকি দিয়ে যখন যা খুশি করতে পারত বলে। শুনেছি ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ার পর তারই পছন্দের ছেলের সাথে ওর মা বিয়ে দিয়ে দেয় এবং কিছুদিন পর ওর মা মারা যায়।
অনেক দিন পর মায়ের বাসায় যাওয়ার পথে ফালানিকে দেখে রীতিমতো আমি চমকে উঠলাম। সেই হাসি মাখা উচ্ছ্বলা মেয়েটির মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, দেখতে অনেকটাই এখন মায়ের অবয়ব ধারণ করেছে। রাস্তা দিয়ে যখন হাঁটছিল তখন ওর হাতে ধরা ছিল ছোট ছেলে যার বয়স আট নয় বছর হবে।
আমাকে হঠাৎ করেই দেখে যেন সেও অপ্রস্তুত লজ্জা মিশ্রিত হাসিটা দিল। জিজ্ঞেস করলাম, কি রে কেমন আছিস? উত্তরে বলল,বালাই! অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই পাশ কাটিয়ে চলে গেল আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই। হয়তো ওর ভালো লাগেনি, শৈশবে পাশের বাড়ির উঠোনটিতে কত খেলার সঙ্গী হিসেবে সে আমাদের সাথে ছিল। পরে লোক মুখে জানতে পারলাম, ফালানির এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ের বয়স এখন তেরো-চৌদ্দ হবে।
ফালানির স্বামী কোনো কাজ করেনা,সে নিজেই বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসার ও স্বামীর হাত খরচ চালায়। এবং প্রতি রাতে নেশাখোর স্বামীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা কারো অজানা নয়। অনেকে তাকে পরামর্শ দেয়, এত কষ্টই যখন করিস তাহলে এমন স্বামীর দরকার ই কি? সে উত্তরে বলে, হেইটা তোমরা বুঝবানা।
ফালানির মায়ের দেখা স্বপ্ন হয়তো ওকে ছুঁয়ে দিতে পারে নি। কিন্তু রাতদুপুরে ওর মায়ের লাঞ্চিত হওয়ার নির্মম সাক্ষীর চোখদুটোকেও হয়তো উপড়ে ফেলতে পারে নি। তাই নিজেকে এবং মেয়েকে শক্ত আবরণে বেষ্টিত করার জন্য স্বামী নামক অপদার্থটির সকল অত্যাচার সহ্য করে খোলসের মধ্যে আবৃত থাকার তীব্র সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে।