জীবন যেখানে যেমন (পর্ব-৮ )
কুলসুম আক্তার সুমী
বছরের শেষ চারমাস আমার জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নিজের জন্মদিন, দুই সন্তানের জন্মদিন, বিয়েবার্ষিকী সবই এই সময়ে। সেপ্টেম্বর জুড়ে কন্যার বিরহে কাতর ছিলাম, নিজেকে ধীরে ধীরে ধাতস্থ করার চেষ্টা করছি।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে একটা বিয়ের দাওয়াত ছিলো। সাধারণত কোথাও যাওয়ার প্রসঙ্গ এলেই মেয়ে খুব বিরক্ত হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর সে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। হোমওয়ার্কের চাপ ছিলো, শরীর খারাপ ছিলো… সব শেষ করেছে অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য। একটু বোধহয় ম্যাচিউর হয়েছে!

২০২০ এর মাঝামাঝিতে এ বিয়েটা হওয়ার কথা ছিলো। তারও ছয়মাস আগে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। কমিউনিটি সেন্টার বুক করা হয়েছে। গায়ে হলুদের জন্য শাড়ি-পাঞ্জাবী বাংলাদেশ থেকে কিনে সবার বাসায় বাসায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঠিক সেই সময়েই বিশ্বব্যাপী করোনা অতিমারি। আর সে কারণেই সে বিয়ে হলো না। হলো না মানে বিয়ে হলো কাজী আর মৌলভী ঘরে ডেকে কিন্তু কোন অনুষ্ঠান হলো না। হবেই বা কেমন করে তখন নিউইয়র্ক শহর রীতিমতো মৃত্যুপূরী।
অতিমারি গেলো, জীবনের নানাবিধ ব্যস্ততা। সবকিছুর পর সেই বিয়ের এতো মাস পর বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান করা হলো। এই অচেনা শহরে যে ক’জন মানুষ অতি আপনজনের মতো বোন বলে সম্বোধন করে, এই পরিবারটি ঠিক তেমন।

দুই বছর আগে থেকে দাওয়াত দেওয়া। মনে মনে কতদিন থেকে ঠিক করে রাখা একটা অনুষ্ঠান, কিন্তু বাসার পরিস্থিতি ভয়ানক খারাপ। মজুমদার অসুস্থ, মেয়ে অসুস্থ। মনটাই খারাপ ছিলো। দুপুর দুইটা পর্যন্ত সিদ্ধান্তই নিতে পারিনি অনুষ্ঠানে যাবো কী যাবো না। শেষমেষ মেয়ে বললো, আমি এতো কষ্ট করে ঘুম বাদ দিয়ে, অসুখ বাঁধিয়ে হোমওয়ার্ক শেষ করে বাসায় আসলাম ওখানে না গেলে হয়!? শেষ পর্যন্ত মেয়ের আগ্রহেই যাওয়া হলো।
যতই অসুস্থ থাকি, যতই কষ্টে থাকি, যেখানে গেলাম সেখানে সেখানকার মতোই থাকি আমরা। মেয়েও তাই। আমার মেয়েকে দেখে বুঝার উপায় ছিলো না যে সেদিন সকালেও তার চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছিলো। ভালোই হৈচৈ, নাচানাচি করলাম আমরা। মেয়ের কাছ থেকে এইদিন একটা জিনিস শিখলাম, বর-কনের নাচের পর কাপলদের নাচার আহ্বান জানালে আমি বললাম, আমি কি নাচতে পারি নাকি? মেয়ে বললো, আম্মু এসব জায়গায় নাচতে গ্রামার লাগে না। একটু নড়াচড়া করলেই হয়। মেয়ে মা হয়েছে কত কিছু শেখাচ্ছে এখন আমায়!

৫ তারিখে যুগল জীবনের ১৯ বছর পার করলাম। এইদিন ফেসবুকে লিখেছিলাম… বুঝ হওয়ার পর থেকেই দেখি আমি সাঁতার কাটতে পারি, দৌড়াতে পারি। সাঁতার আমায় কেউ শিখিয়েছিলো হাতে ধরে সেটা আমি জানি, কিন্তু দৌড় আমাকে কেউ হাতে ধরে শিখিয়েছিলো কী না জানি না। বিস্তৃত জীবনে আমায় নিরবচ্ছিন্নভাবে দৌড়ে যেতে হবে বলেই হয়তো দৌড়টা আমি ঠিক ঠিক শিখে নিয়েছিলাম জীবনের প্রারম্ভেই।
সংসারও কেউ হাতে ধরে শেখায়নি। বাঙালি মেয়ে মাত্রই বোধহয় এটা নিজে থেকেই শিখে নেয়। মনে পড়ে না, আমেরিকা আসার আগে ভাতের মাড়টাও ফেলেছি ঠিকমতো। ডাল আর আলুভাজি ছাড়া কোন রান্নাও করিনি কোনদিন। কিন্তু (ভালো রান্না না করলেও) দিব্যি চালিয়ে নিচ্ছি তো!

সংসার জীবনটাও একটা দৌড়। তবে এ দৌড়টা একার নয়। এটা রিলে রেস। একজন দৌড়ে এসে কাঠিটা যার হাতে দেয় তাঁকেও দৌড়াতে হয় বাকি পথটা ঠিকঠাক মতো এগিয়ে যাওয়ার জন্য। উনিশ বছর খারাপ যায়নি তেমনটি নয় বরং আমি বলবো দারুণ চলেছে!
আমার বিয়েটা এ মাসের ১০ তারিখে হওয়ার পাকা কথা ছিলো। কার্ড ছাপানো, কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করা সব ঠিক। সেই বিয়ে ৫ তারিখে কেন হলো, এই কষ্টে বিয়ের পরের অন্তত দশ বছর এই তারিখে মন খারাপ করে কাটিয়েছি। তারপর, নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছি যে বিয়েটা না হওয়ার হাজারটা কারণ থাকার পরও হয়েছে, সেটা আসলে হওয়ারই ছিলো… তাই হয়েছে। তাই আর মন খারাপ করা নয়, তর্ক বিতর্ক, ঝগড়াও না…। আমি যেদিন থেকে নিজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি আমি ভালো থাকবো, সেদিন থেকে আর একটুও খারাপ থাকিনি। আর জীবনে থাকবোও না, কারণ আমার যা আছে আর যা নেই সবটা মেনেই ভালো থাকতে শিখে গেছি।

আমার বর এই দিনটা ভুলে যান, আর না ভুললেও তার অনুভূতির প্রকাশ নিরব, সৌম্য… আমার বিপরীত। এক সময় এসব নিয়ে রেগে ব্যোম হতাম, গাল ফুলিয়ে রাখতাম দু’দিন। এখন খুব সহজ স্বাভাবিক মনে হয়। মনে হয় প্রতিটি মানুষই আলাদা, তার প্রকাশভঙ্গীও তাই। আমি দিনটাকে ভুলি না, ভুলতে পারি না, ভুলবো না কখনো। এ দিনটা না এলে আমার দ্বিমিত্রা আসতো না, আমার নওরোজ আসতো না। উনিশ বছর বিশেষ করে আমেরিকা আসার পরের পনেরো বছর আমার নানাবিধ পাগলামি সহ্য করার জন্য তোমাকে (আমার বর) ধন্যবাদ। আমার দু’টো সন্তানের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। আমার স্বপ্নগুলোর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য ধন্যবাদ। সর্বেপরি, ‘এমন আমি ঘর বেঁধেছি আহারে যার ঠিকানা নাই স্বপনের সিঁড়ি দিয়ে যেখানে পৌঁছে আমি যাই’… এমন একটা সুখের ঘর বাঁধতে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
৭ অক্টোবর গেল বিশ্ব হাসি দিবস। প্রতিদিন, সারাদিন হাসতে পারলেও একটা বিশেষ দিনকে বিশেষভাবে সম্মান/স্মরণ করা মোটেই খারাপ মনে করি না আমি। তাই বিশেষ দিন থেকেই না হয় হাসতে শুরু করুন। হাসুন প্রাণখুলে।

হাসি মন-শরীর উভয়ই ভালো করে। হাসির উপকারিতা এই আধুনিক যুগে যেন আরো বেড়েছে। যে কোনো অসুখের সবচেয়ে ভালো ওষুধ হচ্ছে হাসি। যদি একমুহূর্তে কল্পনা করা যায় প্রিয় কারও হাসিমাখা মুখ, মনটা কেমন চট করেই ভালো হয়ে যায়। চিন্তা কমানো থেকে শুরু করে, শরীরের পেশীকে আরাম দেওয়া এমনকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও নাকি সাহায্য করে প্রাণখোলা হাসি।
১৬ অক্টোবর শেষ বিকেলে কন্যা এলো বাসায়। সকালে তড়িঘড়ি করেই ব্যাংকে গেলাম, একটা দরকারি কাজ ছিলো। তারপর লাইব্রেরিতে। কতদিন ওদিকটায় যাওয়া হয়নি, এদিকটায় গাছের পাতায় কী সুন্দর রঙ ধরেছে। পথে পথে হাঁটলাম আর আনলিমিটেড ছবি তুললাম।

লাইব্রেরি থেকে হেঁটে আসছি, সিটি হলের সামনে ডেমোক্রেটিক দলের সদস্যরা টেবিল পেতে ভোটার রেজিস্ট্রেশন করছে। বললাম, আমি আগেই করেছি। মেয়ে বললো, আমি তো আঠারো হয়েছি আম্মু। আমি করে নিই। নতুন প্রজন্মের নতুন ভোটার পেয়ে ওরা উচ্ছ্বসিত। ফর্ম এগিয়ে দিলো, মেয়ে ফর্ম পূরণ করলো, জমা দিলো। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছি… আমার ছোট্ট পুতুল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে গেছে, ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে! কাউন্সিলম্যান চার্লস কবের সাথে ছবি তুললাম মেয়ের।
ততক্ষণে সাড়ে বারোটার বেশি বেজে গেছে, দুপুরের খাওয়া দরকার। কেনেডি ফ্রায়েড চিকেনের দোকানে ঢুকলাম। খাওয়া শেষে শপরাইটে। মেয়ের জন্য কিছু শুকনো খাবার কিনতে হবে, সাথে বাসার জন্যও। বাজার সেরে খেলার মাঠে। বাইরে বেরুবো আর নওরোজ একটু দোলনা চড়বে না, তা হতেই পারে না। নওরোজ দোলনায় দোল খায়, আমরা মা-মেয়ে ফটোসেশন করি।

বাসায় ফিরে দ্বিমিত্রা বললো, আম্মু জুতা খোলার আগেই চলো শিম তুলে আনি। শিম, টমেটো তুলে আনলাম। রান্না করলাম। গাছের একটু পরিচর্যা করলাম। মানে… বাইরের টবের গাছগুলো মরতে শুরু করবে যে কোন রাতে বেশি শীত পড়লেই। তাই গাছগুলো বাসার ভেতরে আনলাম। শুকরিয়া… আরো একটা দৌড়ের দিন শেষ হলো। এতো দৌড়ের মধ্যেও আমার কাছে জীবন সুন্দর, সত্যিই সুন্দর। শুধু যাপন না করে উদযাপন করতে জানলেই হলো।
১৯ অক্টোবর স্কুলের এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো দীর্ঘ আঠাশ বছর পর। চট্টগ্রাম সেনানিবাস উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর একেক জন ছিটকে গেলাম একেক দিকে। পলি আর মামুনের সাথে কলেজেও একসাথে ছিলাম চট্টগ্রাম পাবলিক স্কুল ও কলেজে। আমেরিকা এসেও দেখা হয়েছে। সাবিহা সুলতানা বেবি এইচএসসি পড়েছে সাভার ক্যান্ট পাবলিক থেকে তারপর শিকদার মেডিক্যালে আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
দূরত্ব আসলে তো সীমানায় নির্ধারণ করে না। দূরত্ব হয় যোগাযোগহীনতায়… তাই এইটুকু ছোট দেশে বা এইটুকু ঢাকা শহরে থেকেও ছিলাম বিচ্ছিন্ন। ফেসবুকের কল্যাণে যোগাযোগ পুণঃস্থাপিত হয়েছে কয়েকবছর হলো। টুকটাক চ্যাট হয় ইনবক্সে।

হঠাৎ সেদিন কাজের মাঝখানে ওয়াশরুমে গিয়ে দেখি সাবিহার মিসডকল। একটু আশ্চর্যই হলাম। পরেরবার আবার ফোন ধরে দেখি, ক্ষুদেবার্তা … সুমী আমি নিউইয়র্কে, পারলে কল দিস। কাজ শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে কল করলাম। বাসায় আসার কথা বলার জন্য উইকএন্ড দরকার কিন্তু সে সময় ওরা থাকবে নিউইয়র্কের বাইরে। ওর ছেলে ভর্তি হয়েছে উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেখানে যাবে তার ক্যাম্পাস দেখতে এবং ছেলেকে দিয়ে আসতে। এতো কাছে এসে দেখা হবে না মানতেই কষ্ট হচ্ছিলো।
ত্রিওয়ে লাইনে ফোনে মামুন বললো, আমি দেখা করবোই। আমি বললাম, তাহলে বুধবার বিকেলটা ঠিক কর, (আমি কাজ থেকে ফিরলে আমার জামাইর কাজ শুরু হয়।) এই একটা বিকেল চাইলে সে কষ্টেসৃষ্টে ছুটি ম্যানেজ করতে পারবে। তড়িঘড়ি পলিকে দায়িত্ব দেওয়া হলো কাছেপিঠে একটা জায়গা ঠিক কর, যেখানে আমরা বসতে পারি।

আগেরদিন আবারো কাজের সময়ে সাবিহার মিসডকল। কাজ শেষে কলব্যাক করলাম। ও বললো, পলির সাথে কথা হয়েছে, ও রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দিয়েছে। বারবার আফসোস করছিলো, সময়ের অভাবে এরচেয়ে ভালো জায়গার ব্যবস্থা করা গেলো না বলে। তোমরা শুধু শুধুই ভাবছো—আমরা কোথায় বসবো, চেয়ারে না পাটিতে না মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকবো, কী খাবো বাঙালি না চাইনিজ— সিঙ্গারা-সমুচা না পিৎজা-বার্গার এগুলো কোনোটাই কোনোকিছু ম্যাটার করে না। আমাদের দেখা হবে এটাই আসল কথা।
হ্যাঁ, আমাদের দেখা হয়েছে। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছি, অনুভব করার চেষ্টা করেছি বিস্তৃত একটা অদেখা জীবন! দু’টো ঘন্টা আমরা উচ্ছ্বাসের হাওয়ায় ভেসে আঠাশ বছর পেছনে চলে গেছি। সেনানিবাস উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে পিটি প্যারেডের সময় কিংবা টিফিনের ফাঁকে মেতে উঠা হুল্লোড়ে।
এতো আনন্দ! এতো আনন্দ!! শব্দের কী সাধ্য প্রকাশ করে এতো আনন্দ! টুপি খোলা স্যালুট বাবা জাকারবার্গ। তুমি না আসলে পৃথিবীতে, আজকের এই এতো স্মৃতি জাগানিয়া, এমন মধুর সন্ধ্যাটাও হয়তো আসতো না আমার এবং আমাদের জীবনে।

দু’দিন আগে হঠাৎ করেই একটা দুঃসংবাদ কড়া নাড়লো। আমার নিকটতম প্রতিবেশি আইরিশ দম্পতি জিমি আর লরা। লরার জীবন প্রদীপ নিভু নিভু, এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। চার বছর আগে আমরা বাড়ি কেনার পর এ পাড়ায় আমাদেরকে এমনভাবে স্বাগত জানিয়েছিলো ওরা, একজীবনে ভুলতে পারবো না। বাড়ির প্রয়োজনীয় কত জিনিস যে আমাকে ডেকে ডেকে দিয়েছিলো লরা। আমাকে খুব সুন্দর করে সুমীইই বলে ডাকতো। কিছু দেওয়ার সময়ই বলতো, ‘সুমী এটা নাও, তোমার দরকার হবে, কিনতে হবে। আমার কাছে দু’টো আছে। শুধু শুধু কেনো টাকা নষ্ট করবে? বাড়ি কিনেছো দেখবে কত খরচ!’ আমার ব্যালকনিতে এখনো ওর দেওয়া এক জোড়া বেতের চেয়ার।
আগের রবিবার বিকেলে যখন বাসার সামনে এ্যাম্বুলেন্স এসেছিলো, মজুমদার জিমি ও তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো কোনো সাহায্য লাগবে কী না? ওরা না সূচক জবাব দিলে সে গিয়ে সোফায় বসলো। আমি দরজায় দাঁড়িয়েছিলাম লরাকে ঘর থেকে স্ট্রেচারে করে বাইরে আনা, গাড়িতে উঠানো এবং গাড়িটা ছেড়ে চোখের আড়াল হওয়া পর্যন্ত। ফিরে এসে মজুমদারকে বললাম, ওকে তো নিয়ে গেলো। স্বামী বা ছেলে কেউ তো গেলো না সাথে। মজুমদার বললো, হয়তো সঙ্কটাপন্ন অবস্থা, তাই দ্রুত নিয়ে গেছে। ওরা হয়তো গাড়িতে করে পরে যাবে।

জিমি পুলিশে চাকরি করতো। ছেলে, মেয়েও পুলিশে চাকরি করে, অন্যত্র থাকে। জিমি ও লরা একাই ছিলো এই বাড়িতে ত্রিশ বছর ধরে। গতকাল সন্ধ্যায়ও তাকে কিচেনে ডিনার শেষে প্লেট বাটি ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছে সাজিয়ে রাখতে দেখেছি আমি, আর মুগ্ধ চোখে চেয়ে থেকেছি। কিছুদিন আগেও কিচেনে খাওয়ার টেবিলের দু’পাশে দু’জন বসতো… এ দৃশ্য আমাকে অসম্ভব আপ্লুত করতো! একমাত্র ডিনারের সময়টাতেই তাদের খাওয়ার দৃশ্য দেখতাম আমি। কাজ থেকে ফিরে গোসল সেরে কিচেনে গিয়েছি হয়তো ৬টা বা সোয়া ৬টা নাগাদ ওরা তখন ডিনারে বসতো। আমি পাশের ঘর থেকে চোরের মতো এ দৃশ্য দেখতাম।
কাল যখন দেখলাম টেবিলটার একপাশ খালি, কেমন যেনো হু হু করে উঠলো ভেতরটা। মনে মনে ভেবেছিলাম কবে যে লরা ফিরবে হাসপাতাল থেকে, আবার সেই মায়াবী দৃশ্যটা দেখবো! কে জানতো সে দৃশ্যটা আর কোনদিনই দেখবো না!

কাজ থেকে এসেই কিচেনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সরাসরি বাসায় যাওয়া ঠিক হবে কী না, এই ভাবনায়। শেষে ওদের কিচেনে একজনকে দেখে বাইরে গিয়ে বললাম, আমি কি আসতে পারি? আমাকে সে (জিমি লরা দম্পতির মেয়ে) স্বাগত জানালো। বললো, জিমি লিভিং রুমে আছে। ওর কাছে গিয়ে বললাম, তোমরা আমার সবচেয়ে কাছের আর সবচেয়ে প্রিয় প্রতিবেশি। তোমাদের কোন প্রয়োজন হলে আমাদেরকে অবশ্যই জানাবে। আমি যাওয়াতে জিমি খুব খুশি হয়েছে, বারবার ধন্যবাদ দিলো।
তাদের মেয়ে এসে বললো, তুমি এসেছো আমরা অনেক খুশি হয়েছি। লরা উপরে বিশ্রাম নিচ্ছে, ও এখন ঘুমে… জাগলে তোমাকে ডাকবো। আসলে ডাক্তাররা বলেছে ওর আর কোন চিকিৎসা নাই। ওর হাতে খুব বেশি সময়ও নাই। ও শেষ সময়টা হাসপাতালে নয়, ওর বাড়িতে কাটাতে চায়। তাই আমরা ওকে নিয়ে এসেছি।
ভদ্রমহিলার গলা ততক্ষণে ভারি হয়ে আসছে কিছুটা টের পাচ্ছিলাম, নিজের গলাতেও যেনো দলা পাকিয়ে উঠলো কিছু একটা! নিজেকে সামলে কোনমতে বিদায় নিয়ে আসলাম। নিজের বাড়ির প্রথম সিঁড়িতে পা দিতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো… দেশ, কাল, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সব মেয়েই বুঝি একটা আপন ঘরের স্বপ্ন লালন করে বুকের ভেতরে!

দু’দিন ধরেই মনটা ভারি ছিলো। মেয়ে এসেছে বাসায় দুই সপ্তাহ পরে, সে আনন্দকে ছাপিয়ে গেছে প্রতিবেশির (ক্লিনিক্যালি ডেড) অবস্থা। কিন্তু মেয়েটা তো একটু আনন্দে থাকতে চায় বাসায় এসে। তার কথা চিন্তা করেই নিজেকে সামলে নিই… দুঃখ-কষ্ট-জরা-ব্যাধি-মৃত্যু সবকিছুর ভেতর দিয়েও জীবন চলবে জীবনের গতিতে।
সকালে গাছের শিম তুলি মা-মেয়ে, রান্না করি…। খাওয়া শেষে বেরিয়ে পড়ি ঝরা পাতার আনন্দ কুড়াতে। ড. মাহবুব মজুমদারের সহধর্মিনী শারমিন হোসাইনসহ ঘুরে বেড়াই বনে-বাদাড়ে শেষ বিকেলের অনেকটা সময়। ঝরা পাতার মতো মনের দুঃখগুলো উড়িয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করি। কাছাকাছি বাঙালি প্রতিবেশির বাসায় যাই । হরেক রকমের খানাপিনা আর দুইঘন্টার জমজমাট আড্ডা মেরে বাসায় ফিরি। সবকিছুর পরেও, সবকিছুর মধ্যেও জীবন সুন্দর; জীবন আনন্দের। জীবন জীবনের মতোই গতিময়।
কুলসুম আক্তার সুমী, নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র