1

জীবন যেখানে যেমন

Share

কুলসুম আক্তার সুমী

অজ পাড়া গাঁয়ের মেয়ে আমি। নবম শ্রেণীতে গ্রাম ছেড়ে শহরের স্কুলে গিয়ে গাঁইয়া, ক্ষ্যfত উপাধি পেয়েছিলাম সহপাঠিদের কাছ থেকে। শিক্ষকদের আদর, স্নেহ পেয়েছিলাম ঠিকই। এসএসসি, এইচএসসি পাশ করলাম ভালোভাবেই। ভর্তি ফর্ম উঠালাম একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এখন ভাবলে ভয় হয় খুব, আত্মবিশ্বাস ছিলো নাকি বোকামী। যদি ভর্তির সুযোগ না পেতাম একটা বছর লস হয়ে যেতো। যাই হোক সুযোগ পেয়েছিলাম। ভর্তি হয়েছি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। পড়ার ইচ্ছা ছিলো আইন, সুযোগ হয়নি। এক সময় ‘লোক প্রশাসন’ বিভাগে চলে যাবো ভেবেছি। শেষে মনস্থির করলাম সাংবাদিকতাতেই পড়বো। স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম আরো অনেক কিছু। মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। প্রবাসীর সাথে বিয়ে ঠিক হলো। জীবন নামের রেলগাড়ির গতি পাল্টে গেলো অন্যপথে। আমি তাকে বিয়ে করে ভালোবেসেছি কিন্তু সে ভালোবেসেই বিয়ে করেছে, পরিবারের কারো কারো অমতে। এই দ্বন্দ্বের মূল জায়গাটায় ছিলো, পরিবার চেয়েছে খুব সুন্দরি বউ হবে কম শিক্ষিত হলেও। ও চেয়েছে শিক্ষিত বউ হবে খুব সুন্দরী না হলেও। 

যাই হোক, পাশ করার পর কিছুদিন বিচ্ছিন্নভাবে সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলাম। প্রথম আলো, আজকের কাগজ এবং বাংলাদেশ ইনফো ডট কমে। সবখানেই ডেস্কজব। এরইমধ্যে বিয়ে হলো, প্রথম সন্তানের মা হলাম। আমাদের মা-মেয়ের কাগজপত্র প্রসেসিং হচ্ছে; যে কোন সময় চলে আসবো তাই মনে তখন প্রবাসী হওয়ার স্বপ্ন। ২০০৭ সালে আড়াই বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে পাড়ি জমালাম স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। দ্বিতীয়বার সন্তানসম্ভবা হলাম। বছরের শেষ মাসে মা হলাম। কোন কিছু করার চিন্তা বাদ দিয়ে মনোযোগী হলাম সংসারে। ভাবলাম ছেলেমেয়ে একটু বড় হোক তখন দেখা যাবে। আড়াই বছরের সময় জানা গেলো আমার ছেলেটা  বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু। ভীষণ রকমের ধাক্কা খেলাম। সবারই যেমন হয় প্রথম প্রথম… কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার সাথেই এমন হলো!? এই ভাবনায়, এই কষ্টে মুষড়ে পড়লাম। এদেশে স্পেশাল বাচ্চাদের স্বাবলম্বী করার জন্য নানা রকমের সুবিধা আছে। তিনবছর পর্যন্ত ‘আর্লি ইন্টারভেনশন’ এর জন্য টিচার আসতে শুরু করলো বাসায়। আমাকেও শিখতে হলো কিভাবে ওর সাথে আচরণ করবো, কিভাবে ওকে সবকিছু করা শিখাবো, কথা বলানো, রাগ/জেদ নিয়ন্ত্রন করা, ওকে হ্যান্ডেল করবো কিভাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন আমার ধ্যান-জ্ঞান ওর দিকেই। নিজের কিছু করার কথা আর মাথাতেই আনলাম না। 

তিনবছর পর থেকে ছেলে স্কুলে যাওয়া শুরু করলো। মেয়ে তারও আগে থেকেই স্কুলে যায়। দুজনকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে রান্নাবান্না, ধোয়ামোছা  সংসারের সব কাজকর্ম করতাম। আবার স্কুল শেষে বাচ্চাদের এনে ওদের গোসল, খাওয়ানো, হোমওয়ার্ক এসব করে দিন যাচ্ছিলো। কোন কিছু করার জন্য মন থেকে কোন তাগিদ অনুভব করিনি, চুলায় যাক আমার কিছু করা! ছেলেটা আরেকটু বড় এবং স্বাবলম্বী হোক এই ভাবনার মধ্যেই ছিলাম। ২০১৫ সালে দেশে এলাম। কাছের কেউ একজন বললো, “এতো যন্ত্রণা দেয় বাচ্চাটা। আমার বাচ্চা হলে কবে মেরেই ফেলতাম!” ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। দেশ থেকে ফেরার বছরখানেক পর আরেকজন বললো, “আমাদের মনে কষ্ট দিয়ে বিয়ে করেছে; তাই, আল্লাহ বিচার করেছে।” মনে মনে পণ করলাম, আমি কিছু করবো, এভাবে শুধু রান্নাবান্না আর সংসারের কাজ করে সময় কাটাবো না। আমি হারবো না। হেরে যাবার জন্য আমার জন্ম হয় নি। আমি মাথা উঁচু করে বাঁচবো এবং আমার সন্তানদেরও সেভাবে বাঁচতে শেখাবো। আমার কিছু না করার দায়টা ঘুরেফিরে আমার স্পেশাল বাচ্চাটার ঘাড়ে গিয়ে পড়ছে, পড়বে। আমি তো তা হতে দিতে পারি না বরং আমি দেখিয়ে দিবো ইচ্ছাশক্তি থাকলে কোন প্রতিবন্ধকতাই প্রতিবন্ধক নয়। ২০১৭ সালে কাজে যোগ দিলাম, একটা মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট কোম্পানিতে। লেখালেখি শুরু করলাম পুরোদমে। ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতাম, কখনোই সংরক্ষণ করিনি। এবার আর আগের মতো পুরনো কাগজের সাথে কেজিদরে বিক্রির জন্য নয়, সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করলাম। 

বাচ্চারা স্কুলে থাকে আড়াইটা পর্যন্ত। এখন ছেলেটা মোটামুটি বুঝতে শিখেছে অনেককিছু। আমার জামাই কাজের সময়টা পরিবর্তন করে নিয়েছে যাতে বাচ্চারা স্কুল থেকে আসার আগেই সে বাসায় এসে পৌঁছে এবং স্কুলবাস থেকে নিয়ে গোসল, খাওয়ানো এসব করতে পারে। সংসারের কাজকর্মে জামাই, মেয়ে এমনকি আমার ছেলেও অনেক সাহায্য করে। আমি সবসময় শেখানোর চেষ্টা করি, সংসারটা আমাদের সবার। আমরা সবাই মিলে কাজ করলে একজনের উপর আর বেশি চাপ পড়বে না। আমরা আমাদের অবসর সময়ে বেড়াতে যাই, বিশেষ করে গ্রীষ্মের সময়। এখানে গ্রীষ্মের সময় খুব সংক্ষিপ্ত। তাই আমরা সে সময়টা কাজে লাগানোর চেষ্টা করি, খুব দূরে যেতে পারি আর না পারি কাছে-ধারে সবসময়ই ঘুরি। গতবছর আমরা ভার্জিনিয়া ও ওয়াশিংটন ডিসি গিয়েছিলাম। স্টাচু অব লিবার্টি এবং সেন্ট্রাল পার্কে গিয়েছিলাম। কাছে-দূরে যেখানেই যাই আমি কিছু না কিছু শেখার, জানার, আহরণের চেষ্টা করি। জীবনে আসলে অনাবিল সুখ কিংবা কেবল দুঃখ বলে কিছু নেই। দু’টোই পাশাপাশি আছে, থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই যে পরিস্থিতিতেই পড়ি না কেন আমরা যেন ভেঙে না পড়ি। মন থেকে ভেতর থেকে শক্ত হয়ে একবার উঠে দাঁড়াতে পারলে; একবার পথে নামলে পথই একসময় গন্তব্য ঠিক করে দিবে। 

আমিও মুষড়ে পড়েছিলাম একসময়। তারপর ভাবলাম পৃথিবীতে বহু মানুষ আছে যাদের একটা সন্তান নেই। আমার দু’টো সন্তান আছে, হোক না একজন স্পেশাল বাচ্চা তাতে কি হয়েছে! আমি ওকে আল্লাহর তরফ থেকে দেওয়া উপহার মনে করে নিলাম! নিজেই নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হলাম। লেখালেখিটা আমাকে অনেক সাহায্য করলো এই মানসিক কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে। আমাকে চিনিয়ে দিলো আমার গন্তব্য। ২০২১ এর করোনা কবলিত বইমেলায় প্রকাশিত হলো প্রথম একক কাব্যগ্রন্থ ‘শব্দের ইচ্ছেঘুড়ি’। এছাড়াও আরো দু’টি সংকলন। ২০২২ এর বইমেলায় প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘জোছনার জলছাপ’। আরো পান্ডুলিপি তৈরি আছে। এর সাথে ছোটগল্পও লেখার চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প প্রকাশের আশা রাখি। এক বয়সে আবৃত্তি শেখার খুব শখ ছিলো। সময়, সুযোগের অভাবে পারিনি। এখন অনলাইনে একটা আবৃত্তির ক্লাসে ভর্তি হয়েছি। না, বাচিকশিল্পী হওয়ার জন্য নয়। সেই সুযোগ বা সম্ভাবনা হয়তো খুব বেশি নেই এখন আর। শুধু নিজের ইচ্ছা আর মনোবাসনা পূরনের জন্যই এই ক্লাস করা। এটা শুরু করেছি একটা বিশ্বাস থেকে, তা হলো সবার আগে নিজের জন্য বাঁচতে হবে। 

পরিবার, সন্তান, সংসার সবকিছুকে ভালো রাখার জন্য নিজের ভালো থাকাটা খুব প্রয়োজন। প্রতিটা মেয়ের/ নারীর সবার জন্য সবকিছু করার সাথে সাথে নিজের আনন্দের জন্য, নিজের ভালো থাকার জন্য কিছু না কিছু করা উচিত। সবার জন্য/ ছেলেমেয়েদের জন্য সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে শেষ বয়সে এসে হুতাশ করার মাঝে কোন মাহাত্ম নেই। ছেলেমেয়েদের জীবনটাও তাদের নিজস্ব। এখন তাদের জন্য সব করে তাদের কাছ থেকে সবকিছুর প্রতিদান চাইলে কেবল জটিলতার তৈরি সাধ-আহ্লাদ আর পূরণ হবে না। সময় এসেছে এই বিষয়গুলো ভেবে দেখার। একটা ফুলটাইম চাকরি, একটা সংসার, স্বামী ও দুটো সন্তান। কবিতা, গল্প, আবৃত্তির ক্লাস…। জাগতিক আরো আরো আরো যা কিছু আছে সব নিয়ে বেশ আছি, ভালো আছি। চাইলে আরো কিছুও করা সম্ভব। ইচ্ছাশক্তি থাকলে অনেক কিছু সম্ভব। আমার নিউজার্সির বাড়িতে একটা বেশ বড় ব্যালকনি আছে। গ্রীষ্মের দিনগুলোতে আমি প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরে এককাপ কফি নিয়ে ঐ ব্যালকনিতে বসি। অস্তমিত সূর্যের লাল আভায় যখন চারপাশ রঙিন হয়ে উঠে তখন মনে মনে ভাবি, জীবন সুন্দর, খুব সুন্দর।

কুলসুম আক্তার সুমী, নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র