0

জীবন যেখানে যেমন (পর্ব-৫)

Share

কুলসুম আক্তার সুমী

প্রবাস জীবনের নানা গল্প নিয়ে প্রতিমাসেই লিখে যাচ্ছি রোকেয়ানামার শুরু থেকেই। তারই ধারাবাহিকতায় এ লেখাটিও তৈরি করেছিলাম জুলাই মাসের জন্য। যদিও অনিবার্য কারণবশত মাঝখানে পার হয়ে গেছে দুটো মাস। তবুও লেখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে জুলাই মাসের ঘটনাবলী নিয়ে লেখাটা একটু দেরিতে হলেও শেয়ার করলাম। আশা করি আবারো সমসাময়িক ঘটনাবলী তুলে ধরতে পারব রোকেয়ানামার পাঠকদের জন্য।

প্রকৃত গরমের অনুভূতি নিয়ে জুলাই আসে এ অঞ্চলে।  যদিও সে গরম সহ্য করা কষ্টকর তবুও বছরের সাত মাস শীত অনুভব করা মানুষরা গরমকে বেশ স্বানন্দেই  স্বাগত জানায়। এ সময় সাধারণত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে। ফলে এ দেশীয় এবং অবস্থাপন্ন লোকেরা লম্বা ছুটি কাটাতে বেরিয়ে পড়ে। যাদের ততোটা সঙ্গতি নেই তারাও সুযোগ পেলেই সমুদ্র সৈকত বা আশপাশের পার্কে চলে যায় পরিবার ও বন্ধু বান্ধব নিয়ে। বিশেষ করে সারা সপ্তাহ কাজের শেষে সপ্তাহান্তের ছুটিতে সমুদ্র সৈকত, পার্ক, খোলা মাঠ এমনকি বাড়ির পেছনের আঙিনা জমে  ওঠে মানুষের আনন্দ কোলাহলে। 

চলতি সপ্তাহে নিউজার্সিতে দাবদাহ সতর্কতা (হিট ওয়ার্নিং) চলছে। এরই মধ্যে আমরা গেলাম লংব্রাঞ্চ বিচে। এটি আটলান্টিক মহাসাগরের একটা বিচ। আমেরিকার পূর্ব দিকের অনেক প্রদেশ যেমন: নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, কানেক্টিকাট, মেরিল্যান্ড, দেলোয়ারসহ আরো অনেকের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আটলান্টিক মহাসাগর। মানুষের নামার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয় এরকম অনেক জায়গাতেই আছে পরিকল্পিত বিচ। যেমন… আটলান্টিক সিটি বিচ, এ্যাশবেরি বিচ, লংব্রাঞ্চ বিচ, ক্যাপ মে বিচ, কোনি আইল্যান্ড বিচ, বেথেনি বিচ ইত্যাদি। 

আমরা যখন পৌঁছালাম বিচে তখন লোকে লোকারণ্য। বিচ উপভোগে আমাদের দুই সন্তানের রুচি সম্পূর্ণ বিপরীত। ছেলে পানি অন্তপ্রাণ, টানা দু’চার ঘন্টা দাপাদাপি করেও উঠতে আগ্রহী না। আর মেয়ে পানিতে নামতেই চায় না। সৈকতে বসে সমুদ্রের ঢেউ দেখা, মানুষের আচরণ অবলোকন আর সুন্দর মুহূর্তের দৃশ্য ধারণ তার প্রিয়। সে যাই হোক… আমাদের সমুদ্র উপভোগ করে ফেরার সময় হলো। খেয়াল হলো, সাফায়েতের ফোনটা নেই ব্যাগে, গাড়িতে কোথাও। মেয়ে তার ফোন থেকে কল করলো, ফোনটা ধরলো কেউ। মেয়ে বললো, এটা আমার আব্বুর ফোন, ফোনটা কোথায়? অপর প্রান্ত থেকে জানালো, এটা লংব্রাঞ্চ বিচ পুলিশ সেবা কেন্দ্রে আছে, এসে নিয়ে যাও।  সাথে ঠিকানাও বলে দিলো। বুঝলাম কাছাকাছিই কোথাও, খুঁজে বের করতে হবে। সাফায়েত বললো, তোমরা গাড়িতে বসো আমি দেখছি। কর্তব্যরত একজন পুলিশকে ফোনের বিষয়ে বলতেই সে বললো, ফোনটা গাড়ির উপরে ছিলো—পুলিশ ওটা রেখে দিয়েছে। তুমি গিয়ে গাড়িতে বসো এই গরমে হেঁটে যাওয়ার দরকার নেই। আমি ফোন এনে দিচ্ছি। দু’তিন মিনিট পরেই ফোন নিয়ে হাজির সেই পুলিশ অফিসার। সাফায়েত বললো, নামটা যে পুলিশ সেবা কেন্দ্র, আসলেই সেবা। আমি বললাম, জনগনের ট্যাক্স এর পয়সায় যে বেতন পায় ওরা, ওরা সেটা হালাল করে খায়— আর আমরা খুঁজি হালাল খাবারের দোকান। 

কাছাকাছির একটা হালাল খাবারের দোকান খোঁজ করে তার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমাদের আত্মীয়, ভাগ্নে ডঃ হাবিবুর রহমানকে ফোন করেছিলাম সকালেই। আমরা তোমার কাছাকাছি আসছি, চলে এসো। ভাগ্নে সহকারি গবেষক হিসেবে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, বল্টিমোরে চলে যাচ্ছে এমাসের শেষে। সেজন্য তার বর্তমান প্রফেসর তাকে দিয়ে বেশ কিছু কাজ শেষ করিয়ে নিতে চাইছে—ফলে রবিবারেও সে ল্যাবে। বললো, আন্টি আপনারা সমুদ্র উপভোগ করেন আমি হাতের কাজ গুছিয়ে শেষ বিকেলে যোগ দিবো আপনাদের সাথে। 

খাবার অর্ডার দিয়ে বসতেই ভাগ্নে এলো, খাওয়া শেষ করে বেরুলাম হাঁটতে। আমরা যে খাবারের দোকানে গিয়েছি সেটা এ্যাশবেরি বিচের কাছাকাছি। ওখানেই  একটা পার্ক। খুব ছোট কিন্তু ছিমছাম, গোছানো সুন্দর। অসংখ্য হাঁস চরে বেড়াচ্ছে, লোকজন হাঁটছে, কেউ ছবি তুলছে, কেউ ভিডিও করছে, কেউ গাছের ছায়ায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে। সান্ধ্য সূর্যের মায়াবী আলোয় অপার্থিব সুন্দর চারদিক। 

আরেকটু এগিয়ে যেতেই ছবির মতো সুন্দর একটা লেক। লেকে আরো অনেক হাঁস। লেকের পাড়ে একটু পরপর বসার জন্য বেঞ্চি, বড়শি দিয়ে মাছ ধরার জায়গা এবং নিয়মাবলী। এখানে মাছ ধরে আবার ছেড়ে দিতে হবে, মারা যাবে না কিছুতেই। লেকের ধারে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে হেলেদুলে আসলো একটা নাদুস নুদুস শ্বেত শুভ্র রাজহাঁস (সোয়ান)। রূপকথার গল্প বার্বিতে যে সোয়ান লেক দেখেছিলাম, যে সোয়ান দেখেছিলাম— তাই যেনো চোখের সামনে। একদম হাতের কাছে, চাইলেই ছুঁয়ে দেওয়া যায়। 

ভাগ্নে বললো, আমাদের দেশের রাজহাঁস কেমন আক্রমনাত্মক, এরা একদম বিপরীত। মানুষের আগমনে সোয়ানটা এতো কাছে এলো, ও বোধহয় ক্ষুধার্ত। বোধ হয় লোকে ওকে এখানে খেতে দেয় কিছু। আমাদের মেয়ে বললো, ওদের কোন খাওয়া দেওয়া ঠিক না, এটা বেআইনি। ভাগ্নে বললো, তা জানি—কিন্তু দেখো লোকজন বোধহয় খাবার দেয়, তাই আমি হাত উঁচু করতেই ও ছুটে আসছে। মেয়ে আবারো জোর দিয়ে বললো, লোকে দিলেও এটা ঠিক কাজ না। আমরা ছবি তুলছি, ভিডিও করছি… মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাই সাইকেল নিয়ে একজন এসে হাজির (পার্ক ও লেকের তত্ত্বাবধায়ক)। জিজ্ঞেস করলো তোমাদের কাছে কি কোন খাবার আছে? বললাম, না। সে বললো, সোয়ান দ্য মেরি খুব অসুস্থ। আমরা ওকে মেরি বলে ডাকি। অনেক পর্যটক মজা করে ওকে পাউরুটি খাওয়ায়, আনন্দ পায়; এতে করে সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ভাগ্নে জিজ্ঞেস করলো, এই লেকে কি একটাই সোয়ান? বললো, আগে দু’টো ছিলো একটা মারা গেছে, এখন সে একা। একটা ছবির মতো জায়গায় একটা স্বপ্নের মতো বিকেল কাটিয়ে আমরা বাড়ি ফিরলাম। 

মাসের প্রথম দিকে ছিলো মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহা। তার আগে পুরো সপ্তাহজুড়ে ঠান্ডা জ্বরে নাকাল ছিলাম। ঈদ আয়োজন বলতে ছিলো না তেমন কিছুই। ঈদের সকালে ছেলের কপালে হাত দিয়ে বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো যেনো। ওর শরীরে জ্বর। বিকেল নাগাদ ছেলের শরীর কিছুটা স্বাভাবিক হলো। ষোলো আনা বাঙালীয়ানায় সেজে বেড়াতে গেলাম প্রতিবেশির বাসায়। পুরো সপ্তাহ কাজ করলাম যথারীতি। পরের সপ্তাহান্তে ঈদ পরবর্তী দাওয়াতেও গেলাম দেশীয় ঐতিহ্যবাহী মনিপুরী শাড়ি পরে। নিজের বা পরিবারের কারো ছোটখাট অসুখ বিসুখ কিংবা কর্মব্যস্ততা কোনকিছুই বিরত রাখে না আমায় আজকের যাপিত জীবনের আনন্দ উপভোগ থেকে। কারণ আমার কাছে আজকের হিসেবটাই মূখ্য, হিসেব করার জন্য আগামী দিন জীবনে নাও আসতে পারে। 

তারও আগে জুনের শেষদিকে আমার শহরের স্বাধীনতা দিবসের আতশবাজি ( ফায়ারওয়ার্ক ) হয়ে গেলো আমার বাড়ির পাশের ডোয়েটমরো হাইস্কুল মাঠে। ৪ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ আতশবাজি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, সরকারি দপ্তর, পাড়া-মহল্লা এমনকি ব্যক্তিগতভাবে বাড়িতে বাড়িতেও আতশবাজি করা হয়। জুনের শেষদিক থেকেই সন্ধ্যার পর সর্বত্র আতশবাজি দেখতে পাওয়া যায়। 

এঙ্গেলউড পার্ক ডিপার্টমেন্ট এই আয়োজন করে প্রতিবছর। অতিমারির কারণে গত তিনবছর বন্ধ ছিলো। এবার সিটি মেয়র মাইকেল ওয়াইল্ডস ছিলেন পুরো অনুষ্ঠানের অভিভাবকরূপে। প্রথমে নিজের শেডে বসে এবং পরে প্রায় প্রতিটি জটলায় হেঁটে হেঁটে ব্যাগ আর বাচ্চাদের পিজভি বিতরণ করেছেন তিনি। কত মানুষের সাথে যে হাত মিলিয়েছেন, ছবি তুলেছেন, কুশল বিনিময় করেছেন; চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। জনপ্রতিনিধি শব্দটার প্রকৃত অর্থ বুঝা যায় এদের দেখলে। অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে আমার বাচ্চাদেরকেও ব্যাগ, খেলনা, বই দিয়েছিলেন  নিজের হাতে। ছবি তুলেছিলাম আমরা। 

সেদিনও বাচ্চাদের নিয়ে আমাকে একাই যেতে হয়েছে আতশবাজি দেখতে। আমাদের বিকল্প কর্মঘন্টায় একজনের কাজ শেষ হলে শুরু হয় অন্যজনের। কিন্তু জীবনের আনন্দের উপলক্ষকে অবহেলা করা ঠিক নয়। তাই বাচ্চা ও পাড়া প্রতিবেশিদের নিয়ে উপভোগ করেছি একটা আনন্দ সন্ধ্যা। 

আমার কাছে জীবন যাপনের, জীবন উপভোগের। জীবনকে উপভোগ করতে জানলে তার উপকরণ বাতায়ন পাশের গাছ-ফুল, লতা-পাতাতেই পাওয়া যায়। জীবন যখন যেখানে যেমন… 

কুলসুম আক্তার সুমী, নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র