0

গোলাপি অর্কিডে আনন্দে থাকা দিন

Share

জীবন যেথানে যেমন (পর্ব-৯)

কুলসুম আক্তার সুমী

অক্টোবরের শেষদিকে নিকটতম প্রতিবেশির মরণাপন্ন অবস্থায় বাসায় কাটানোর শেষ ইচ্ছার কথা শুনে মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়েছিল। সেই কষ্টের রেশ প্রায় পুরো নভেম্বরই বয়ে বেড়াতে হল। ৫ নভেম্বর মেজো দুলাভাই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। অক্টোবর ১১ তারিখে ওমরাহ করতে গেলেন আপা আর বড় ছেলের সাথে, যাবার আগে থেকেই শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন কিছুটা। ফিরে এলেন আরো বেশি অসুস্থ হয়ে। এই অসুস্থতা আর সারলো না…। 

আমার সাথে অনেক অনেক কথার শেষে ‘আইচ্ছা তোরা দেশে আইবি কবে?’ জিজ্ঞেস করার আরো একজন মানুষ কমে গেলো! মেজো আপা (আমার মামাতো বোন এখন ননাস) -দুলাভাইয়ের বিয়ের কাহিনীটা নাটক/সিনেমার কাহিনীর মতো। আমার মামা গ্রামের মানুষের বিচার শালিস করেন। দশ গাঁয়ের লোকে চিনে, জানে, মান্য করে। দুলাভাইয়ের বিয়ে ঠিক হলো অন্যগ্রামে। মামা গন্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে সে বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। কোন বিষয় নিয়ে বনিবনা হলো না, সে নিয়ে বাকবিতন্ডা, ঝগড়া। বিয়ে ভেঙ্গে গেলো, ছেলের বাবা প্রচন্ড মানসিক কষ্ট পেয়েছেন। 

সে কষ্ট মামাকে খুবই স্পর্শ করেছে, তিনি ঘোষণা দিলেন, বিয়ের তারিখ আজ। আজকেই বিয়ে হবে। কিন্তু পাত্রী কোথায়? মামার মেয়ে আছে… যদিও মেয়ে তখন যথেষ্টই ছোট; কিন্তু আমার মামার জবানের (মুখের কথার) দাম ছিলো, বাড়ি এসে  ছাগল জবাই হলো, পুকুরের মাছ তোলা হলো, রান্নাবান্না হলো, বিয়ে সেদিনই হয়েছিলো রাতের বেলায়। শ্বশুরবাড়ি দেওয়া হলো আপাকে আরো অনেক বছর পরে। 

আমাদের পাশাপাশি গ্রাম। আম্মাকে আনার জন্য রাতে কাউকে পাঠানো হয়েছিলো। (আমার স্বশিক্ষিত মা বরাবরই বাল্যবিয়ের বিরোধী ছিলেন) এতো ছোট মেয়ে কেন কথাবার্তা ছাড়া বিয়ে দিতে হবে? এই রাগে আম্মা যাননি। পরদিন সকাল বেলা মামা এলেন আমাদের বাড়িতে। আম্মা তখন পুকুরে থালা বাসন ধুতে গেছেন। পুকুর ঘাটের সবচেয়ে উপরের গাছের গুঁড়িতে বসে মামা আম্মাকে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘কাজ একটা তো করি ফালাইছি। আশুকে তো বিয়া দিয়া দিছি।’ 

আম্মা রাগে গজগজ করে বলেছেন, আপনার যখন মেয়ে বেশি হইছে, আপনি বিয়া দিবেন না কেটেকুটে জলে ভাসাইয়া দিবেন, সে তো আপনার ইচ্ছা। আমারে বলার কী আছে!? মামা নরম হয়ে বলেছেন, ছেলেটা ভালো, ওর বাপের এত মন খারাপ হইছে সহ্য করতে পারি নাই। কথা দিয়া ফেলছি। আম্মাও জবাব দিলেন, ভালো মন্দের কথা কই নাই ভাই, আশুর কী বিয়ার বয়স হইছে!? 

আমার মামাও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জীবনে, তবে এই সিদ্ধান্তটা মোটেই ভুল হয়নি। আপা-দুলাভাইয়ের পাঁচজন সন্তান পাঁচ পাঁচটা রত্ন। ঢাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য জায়গা থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত সবাই। বিসিএস ক্যাডারসহ সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে সফলভাবে কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। 

আপা-দুলাভাই অনেক কষ্ট করেছেন জীবনে। ভাঙ্গা ঘরদোর থেকে আলিশান বাড়ি করেছেন, দালান করেছেন। ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সুখ বা আনন্দ উপভোগের সময়টা যেই মাত্র হাতে এসেছে তখনই ডাক পড়েছে যাবার, বোধহয় একটু বেশি তাড়াতাড়িই চলে গেলেন দুলাভাই। আসলে আসার তো ক্রম থাকে যাওয়ার থাকে না। যার সময় যখন হয় তখনই যেতে হবে। 

আমার আদরটা বরাবর অন্য লেভেলের ছিলো সবার কাছেই। তাই আমি কোনদিন শ্যালিকাও ছিলাম না, পরবর্তী সময়ে শ্যালকের বউ হইনি… আমি ছোটবোন ছিলাম সবসময়। আমাকে কোনদিন তুই থেকে তুমি বলেনি। আমার  ও রকম আদরের লোক কমছে আর কমছে…। 

একই দিনে আমাদের বন্ধু তওহিদ মাহমুদ হোসেন সাজুর খোকাবাবুও (আব্বা) চলে গেছেন। সে খবর জেনেছি অনার্য শান্ত’র হোয়াটসআপে মেসেজ থেকে। ও লিখেছে, কাকু (তওহিদের বাবা) নেই। আজ সকাল ১১টায়— আমি সারাদিন ওখানেই ছিলাম, দাফনের পর বাসায় এসেছি। তারপর বললো, তুই আসবি কবে দেশে? একবার দেখা না হলে খুব আফসোস নিয়ে মরবো। কখন যে কার ডাক আসে বলা তো যায় না। 

তওহিদ ইনবক্সে আমার একদিন আগের মেসেজের জবাব দিলো, ‘মারা গিয়েছেন।’ তারপর চ্যাটবক্সে অনেক্ষণ কথোপকথন। বাবা-মায়ের খাটে শুয়েছে ও। বাবার বালিশে… যে বালিশে পরশুও উনি শুয়েছিলেন। ওর ঘুম আসছে না, ঘুমের ঔষধ খেয়েও! মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে মা-বাবা দু’জনকে কবরে শুইয়ে দেওয়ার ভার বইতে পারছে না সে। না দেখেই কিছু মানুষকে কী আপন করে বুকের মধ্যে ঠাঁই দিয়েছি আমি! ওদের জন্য কষ্ট হয়, ভীষণ অন্যরকম কষ্ট। 

প্রায় তিনমাস থাকার পর ১১ নভেম্বর ড. মাহবুব মজুমদার সপরিবারে চলে গেলেন নিউইয়র্কে নিজের বাসায়। খারাপ লাগছে— মানুষকে ভালোবাসায় ভীষণ কষ্ট, তাই বলে কি ভালোবাসা বন্ধ করবো, তাতো নয়! আগস্টের শেষদিনে মেয়ে চলে গেলো ডর্মে কিন্তু আমার বাসা খালি হলো না। ডক্টর মাহবুব মজুমদার, উনার সহধর্মিনী শারমিন হোসেন, তাদের সন্তান মিখাইল মজুমদার ছিলো, আমাদের বাড়িটা ভরপুর ছিলো। আমি মেয়েকে রেখে আসার কষ্ট সেরকম অনুভব করতে পারিনি, শারমিন আন্টি সেটা করতে দেননি। 

আমি কাজে থাকা অবস্থায় বেলা বারটার দিকে তারা চলে গেলেন। কাজ থেকে বেরিয়ে বুক দুমড়ে মুচড়ে কান্না পেল আমার। মনে পড়ে গেল কত অতীত স্মৃতি… আমার ভাইয়ের এইটুকু দুই রুমের বাসা ছিলো ঢাকা শহরে। মোটামুটি আবাসিক হোটেলের মত হয়ে গিয়েছিলো একটা সময়। কত মানুষ বিদেশ মানে মধ্যপ্রাচ্য যাওয়ার আগে দু’তিন দিনের জন্য চলে আসত। ঐটুকু খুপচি বাসায় থেকে (কোন কোন সময় তাদের ব্যাগ/ কাপড় জামাও কিনে দিতে হত) ওরা বিদেশ যেত। কিন্তু বিদেশ ফেরত কেউ আমাদের বাসায় আসতো না, বিমানবন্দর থেকে সরাসরি বাড়ি যেত। সে নিয়ে একটু বড় হওয়ার পর ভাতিজা ভাতিজিরা অনেক ক্ষ্যাপাতো আমাকে, ভাবীকে। তোমাদের আদরের ভাই/ দেবররা বিদেশ যাওয়ার সময় এ বাসা থেকে যাবে কিন্তু বিদেশ থেকে আসার সময় তো এ বাসায় আসবে না! 

সে তালিকায় মিস্টার মজুমদারও (আমার বর) আছে তখন অবশ্য মিস্টার মজুমদার হয়নি, সাফায়েত ভাই ছিলো! আমাদের বাসা থেকে বিদেশ (আমেরিকা) এলেও যাওয়ার সময় কিন্তু সরাসরি বাড়িই গিয়েছিল। কত মানুষ ডাক্তার দেখাতে আসতো, কত মানুষ বিদেশ যাওয়ার কাগজপত্র ঠিক করতে আসতো, তাও সেই আবাসিক হোটেলে… দেখে দেখেই বড় হয়েছি।  

এদেশে আমার আসার আগের বছরগুলোতে মজুমদার বলতো ঈদের সময় ব্রঙ্কসে জাকির ভাইয়ের বাসায় ওরা ভূরিভোজ করে। প্রায় সব ঈদেই একই কথা শুনতাম… কেউ মনে রাখুক আর না রাখুক আমি অন্তত স্বীকার করি লাকসাম, কুমিল্লা, নোয়াখালীর বহু মানুষকে জাকির ভাইয়ের বউ রান্না করে খাইয়েছেন। আমি আসার পর বললাম, জাকির ভাই/ ভাবী তো আর ব্রঙ্কস থেকে এত দূরে তোমার বাসায় খেতে আসবে না, এখানকার ব্যাচেলরদেরকে এখন থেকে ঈদে আমাদের বাসায় খেতে বলবে। সেই থেকে আমার বাসা ঈদের সময়ে ব্যাচেলরদের খাওয়ার জায়গায় পরিণত হয়। আমেরিকায় আসার পরের অন্তত আট বছর ঈদের সময় আমি কোথাও যাইনি, অস্টম বছরে প্রথম কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলাম। 

সেটা তো ঈদে খাওয়ার বিষয়। আর বাসায় থাকার বিষয়ে যদি বলি… ছোট্ট দুই রুমের বাসায় থেকেছি কিংবা নিজের বাড়িতে, কত মানুষই এসেছে বা থেকেছে আমার কাছে। দুই-চার সপ্তাহ, মাস থেকে শুরু করে দুই-চার বছরও থেকেছে কেউ কেউ। যারা থেকেছে তারা সবাই মনে রেখেছে এমন নয়, আবার কেউ কেউ রেখেছেও। সবাই এক মানসিকতার নয়, সবার বোধ বা কৃতজ্ঞতাবোধ একরকম নয়। তাই ঐসব নিয়ে ভাবি না। বরং জীবনে এমন কিছু মানুষ কিছু সময়ের জন্য হলেও আমার/ আমাদের কাছে ছিলো যা জীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে। ভাগ্নে ডক্টর হাবিবুর রহমান ছিলো আমাদের কাছে কয়েক মাস, তার সাথে কাটানো সময়গুলো আমার জীবনের অনন্য সময় হয়ে আছে। এখন দূরে চলে গেছে, জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি গবেষক, ব্যথা হয়ে বুকে বাজে… কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে যেতে হয়, হবেই। 

গত তিন মাস ছিলেন কেবল বাংলাদেশের নয় বিশ্বের আদর্শতম একজন মানুষ ডক্টর মাহবুব মজুমদার ও তাঁর পরিবার। প্রকাশ ও প্রচারবিমুখ এই মানুষটাকে খুব বেশি মানুষ না চিনলেও যারা চেনার তারা ঠিকই চিনেন। তিনি কত বড় মাপের মানুষ তা আমি অনুমান করতে পারি। এই তিনটা মাস আসতে যেতে, উঠতে বসতে আন্টি আন্টি বলে ডেকেছেন। কত রকমের কত কী গল্প করেছি আমরা, কত রকমের দুষ্টামি, মজা করেছি। খাওয়া দাওয়া করেছি একসাথে, স্মৃতিগুলো আমায় ভোগাবে কিছুদিন। এক জীবনে ভালোবাসার বিনিময়ে লোকে ভালোবাসাই পায় না। অথচ, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহ  কী পাইনি আমি! নিজেকে ভাগ্যবান না মনে করলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি বড্ড অকৃজ্ঞতা হয়ে যায়। 

কিছু তারিখ আমি কখনোই ভুলি না। তেমনই একটা তারিখ ১৩ নভেম্বর… আমার দু’টোর মতই। বাকিগুলো এদিক সেদিক হয় সামান্য হলেও। এজন্য ওদের মন খারাপও হতে পারে, হতে তো পারেই। কতকিছু আমরা ইচ্ছা করেই করি, আর এটাতো আমার অনিচ্ছাতেই হয়ে যায়। আমার শৈশবের দিনগুলো এক অর্থে নিরানন্দই ছিল। আমার সমবয়সী পরিচিতদের সবারই দু’একটা ছোট ভাই/বোন ছিল। আমার কিছুই নাই… সব বড় বড়। ছোট থাকলে কত্ত মজা হত।

সেই ভাবনার বয়সটাতে আমার ভাতিজির জন্ম। ওটা আমার হাতে একটা দম দেওয়া পুতুল এনে দেওয়ার মত আনন্দের ছিল। আমিও তখন নিতান্তই শিশু, তবুও মনাসপটে ওর জন্মের দিনটা এখনো আমার চোখে ভাসে। ওর বেড়ে  ওঠার দিনগুলোকে চোখ বন্ধ করে এখনো দেখি, এবং খুব স্পষ্ট দেখতে পাই। দেখতে দেখতে কতগুলো বছর চলে গেছে, কিন্তু এখনো সেই হাফপ্যান্ট পরা পেট বের হওয়া কিংবা লক্করঝক্কর খেলতে গিয়ে পায়ের চামড়া ছিঁড়ে আসা নুপূরই রয়ে গেছে ও আমার কাছে। এরচেয়ে বড় আমি ওকে ভাবতেই পারি না। 

১৩ তারিখ সন্ধ্যায় আরো একটা দারুন ঘটনা ঘটেছে। বন্ধু তওহিদকে সকালে ফোন দিয়েছিলাম। শান্ত’র কাছ থেকে শুক্রবার নাম্বার নিয়েছি। নিজের ব্যস্ততায় কল করা হয়নি। বাবার মৃত্যুর পর সন্তানকে কিভাবে সান্ত্বনা দিতে হয় জানি না আমি। শুধু ফোন করে একটু সময় দিলাম। তওহিদ হোয়াটসআ্যাপ কলে শান্তকে যুক্ত করল। আমরা ত্রিভূজ আড্ডায় ডুবে রইলাম কিছুটা সময়। ঐটুকুই আমি করতে পারি বন্ধুর জন্য… এর বেশি মোর সাধ্য নাই! 

নিভাকে বললাম, তোমার জামাই (তওহিদ) তোমাকে  বিখ্যাত করে ফেলছে। ও বললো, বিখ্যাত না বলো কুখ্যাত করে ফেলছে। বৌয়ের প্রশংসা করে পোস্ট দেয়… লোকে ভাবে বৌ জানি কত জাদরেল! নইলে কি আর এত প্রশংসা করত? তওহিদও কম যায় না… বললো, তুইও তো মজুমদারের প্রশংসা করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলিস। আচ্ছা মিস্টার মজুমদারের নামটাই তো জানি না… মজুমদার কিন্তু মুখস্ত হয়ে গেছে তোর লেখা পড়ে পড়ে। বললাম, তুই যেমন নিভার প্রশংসা বাড়িয়ে করিস না, আমিও তাই। 

যে ঘটনা বলার জন্য এত কথা তাই বলি এবার। শুক্রবার বিকেলে বন্ধুর বাবার সাথে মেয়ে বাসায় আসে। রবিবার মজুমদার কন্যা ও তার বন্ধুকে দিয়ে আসে। শনিবার দুই শিফট কাজ করে এসে রাত তিনটায় উঠে ইংল্যান্ড পাকিস্তান টি২০ ফাইনালের প্রথমার্ধ দেখে ভোরে কাজে গেল সে। কাজ শেষ করে বেলা দুইটায় ফিরে গোসল করে বলল, আমি একটু ঘুমাব নইলে গাড়ি চালাতে পারব না। 

ঘন্টা দেড়েক ঘুমিয়ে উঠে ভাত খেয়ে পৌনে পাঁচটায় মেয়েকে নিয়ে বের হল। সবকিছু ঠিকঠাক নেওয়া হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করেছে দু’বার… প্রতিদিনকার মতই। যাওয়ার পথে মেয়ের বন্ধুর বাসা থেকে তাকেও তুলে নিলাম। ৬০ মাইল গাড়ি চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে গাড়ি থামাল। মেয়ে ব্যাগে হাত দিয়ে বলল, ও মাই গড… আমার আইডি আনা হয়নি। 

আর কোন মানুষ, আর কোন বাবা, আর কোন শিক্ষিত ভদ্রলোক ঐ মুহূর্তে মেয়েকে বকাঝকা করত, বউকে বকাঝকা করত, হয়তো গালিগালাজও করত কিংবা আরো অনেক কিছু…! কিন্তু মানুষটা গাড়ির দরজা খুলে নামতে নামতে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, গাড়িতে বস নামার দরকার নাই। পেছন থেকে মেয়ে দু’টোকে লাগেজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, রুমে যাও। আমি আইডি নিয়ে আসছি। 

বাসায় এসে ছেলেকে একটা কলা খাওয়ালো। আমায় বলল, আরেক কাপ কফি বানাও। বাথরুমে গেল। আইডি নিলাম। আবার ঐটুকু পথ ড্রাইভ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া। মেয়ে নিচে নেমে এসেছে গাড়ির কাছে। বলল, সরি আব্বু। মজুমদার বলল, সকালে ক্লাস আছে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেও, কিছু হয়নি… চিন্তা করো না। 

আমি বললাম, তোর বাপটা একটা অসাধারণ বাপ। হতে পারে সে অনেক বেশি স্মার্ট না, অনেক বেশি শিক্ষিত না, অনেক বেশি সুদর্শন না কিন্তু জানিস তুই অনেক ভাগ্যবতী একটা মেয়ে। এরকম একটা বাপ থাকলে আর কিছু লাগে না। মেয়ে দৌড়ে গিয়ে বাপের গালে একটা চুমু এঁকে দিল। মেয়ের বাপ বলল, এরকম একটা আদর পেলে দুইশ মাইল গাড়ি চালানো ব্যাপার না। 

গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ ২০২২ শুরু হল ২০ নভেম্বর কাতারে। জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর প্রথম ম্যাচ। মজুমদার বাসায় নেই, মেয়েও নেই। কত বছর পর ফুটবল বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ দেখতে বসেছি আমি! মনে মনে হারিয়ে গেছি বত্রিশ বছর আগের একরাতে। নোনাজলে ভেসে যাচ্ছি… 

১৯৯০ সাল। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হয়েছে। বিশ্বকাপের আগে ম্যারাডোনা ও পেলের ছবি সম্বলিত খাতা বই কিনেছি। তার আগে ফুটবল খেলোয়াড় ছোট ভাই (যে বাবা মায়ের দেওয়া নামের চেয়ে বেশি পরিচিত ফুটবল খেলে পাওয়া জিকু নামে) ম্যারাডোনার বড় ছবি (পোস্টার) কিনে দিয়েছিল। আমাদের গ্রামে তখনো বিদ্যুৎ আসেনি। পাশের গ্রামে এবং চন্দনা বাজারে বিদ্যুৎ আছে। বাজারে  একটা দোকানে টেলিভিশনও আছে। এলাকার ছেলেরা রাতে ফুটবল খেলা দেখবে সেখানে, দোকানদারের চা নাস্তা বিক্রি বাট্টাও বাড়বে। তাই এই ব্যবস্থা।

আমার স্মৃতি খুব বেশি বেইমানি না করলে খেলাটা রাত বারটায় শুরু হয়েছিল। ছোটভাই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল  চন্দনা বাজারে আর্জেন্টিনা-ক্যামেরুনের উদ্বোধনী খেলা দেখাতে। আগের বারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার সাথে ক্যামেরুনের খেলা। পুরো এক দোকান ছেলে-বুড়ো পুরুষ মানুষের মাঝে আমি একমাত্র মেয়ে ভাইয়ার কোলে বসে খেলা দেখেছি। 

যে মানুষটার কোলে বসে আমার খেলা দেখা শুরু। যার আঙুল পেঁচিয়ে আমি প্রথম ফুটবলে লাথি দিয়েছি, যার হাত ধরে ছেলেদের টিমে আমি খেলেছি… সাপোর্ট করেছি তার বিপরীত দলকে। কোনদিন বলেনি তুই কেন আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করিস!? এত উদার কী করে হলে তুমি ঐ সংকীর্ণ পরিবেশে বেড়ে উঠেও! কত প্রশ্ন আমার মনে জাগে? কত কী আমার জানার বাকি ছিল? কিসের এত তাড়া ছিল রে ছোট? আমাকে কত কত স্মৃতির কষ্ট উপহার দিয়ে চলে গেছে আমার ভাই! মাঝে মাঝে আমার কী যে অসহনীয় লাগে সেই ভার দুনিয়ার কেউ তা বুঝবে না।

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের ছুটিতে আমরা বেড়িয়ে এলাম মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর থেকে। আমাদের অনেকদিন কোথাও যাওয়া হচ্ছিল না। মেয়ে ডর্মে যাওয়ার পর সবার একসাথে ঘুরতে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। থ্যাঙ্কসগিভিং এর ছুটিটা তাই আমরা কাজে লাগাতে চাইলাম। যদিও এখন পুরোপুরিই শীত তবু একটু একঘেয়েমি দূর করা জরুরী হয়ে পড়েছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাল্টিমোর যাব জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি গবেষক ভাগ্নে ড. হাবিবুর রহমানের বাসায়। 

হাবিব বিয়ে করেছে গত সেপ্টেম্বরে, বৌ আমেরিকা এসেছে তাও প্রায় তিন মাস হতে চললো। আমাদের বৌ দেখা হয়নি এতদিন… আমেরিকার ব্যস্ত জীবনে এই (জাতীয়) ছুটিতেও হাবিবকে অফিসে যেতে হচ্ছে। গবেষণা এমনই জিনিস, তা করতে হয় নিরলসভাবে এবং বিরতিহীনভাবে। 

যাই হোক, ভাগ্নে বৌ দেখাতে না আসলে বা সে সুযোগ না পেলে আমরা বৌ দেখব না তা হবে কেন? এদেশে এলে এসব খুব ভালোভাবে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়ে যায়। মানুষের ব্যস্ততা বা জীবন বাস্তবতা সহজে বুঝতে পারার মানসিকতাও আরেকটু মজবুত হয়। 

আমরা বৌ দেখতে গেলাম, হয়ে গেল আমাদের আরেকটা মেয়ে। মেয়েতে আমার বা মজুমদারের কোন অনীহা নেই; বোধকরি হবেও না কোনদিন। বৌমা এত মিশুক, এত অমায়িক, এত ভদ্র… এরকম মেয়ে ডজন ডজন থাকলেও অনীহা আসবে না কারোই। হাবিব-বৃষ্টি তোমাদের জীবন এরকম অনাবিল আনন্দে কাটুক এই প্রত্যাশা আমাদের সবসময়ের। 

বুধবার নওরোজের অর্ধদিবস স্কুল ছিল। আগে থেকেই ব্যাগ গুছিয়ে, বাপ ছেলে কে কি পরবে সবকিছু ঠিক করে রেখে কাজে গিয়েছি আমি। এরকম করেই আমাদের সব ভ্রমণের পরিকল্পনা করতে হয়। প্রতিটা মিনিট সেকেন্ড হিসেব করে করে। নওরোজ বাসায় এল বেলা একটায়। ওকে গোসল করিয়ে খাইয়ে রেডি করে মজুমদার আমাকে উঠিয়ে নিল কাজের জায়গা থেকে। সেখান থেকে দ্বিমিত্রার বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওকে নিয়ে গন্তব্য বাল্টিমোর। 

ভ্রমণের গল্পের আগে পথের একটা অবিস্মরণীয় গল্প না বললেই নয়। থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের দু’দিন আর সপ্তাহান্তের দু’দিন মিলে চারদিনের ছুটির কারণে বুধবার বিকেলে রাস্তায় ভীষণ যানজট। তাছাড়া আমাকে ও দ্বিমিত্রাকে নেওয়া সহ রাস্তায় সময় লেগেছে প্রায় সাত ঘন্টার মত। পথিমধ্যে নওরোজ বলল, ও বাথরুমে যাবে। হাইওয়েতে যেখানে সেখানে গাড়ি থামানো যায় না, তাড়াতাড়ি করে কাছাকাছি গ্যাস স্টেশন খুঁজে সেখানে গাড়ি থামাল। মজুমদার জিজ্ঞেস করল, তোমরা বাথরুমে যাবে? মেয়ে বলল, না… আমি কিছুই বলিনি। সে ছেলেকে নিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে গেল বাথরুমের দিকে। আমি আর মেয়েও নামলাম। আমরা গেলাম লেডিস বাথরুমে। মজুমদার আমাদের বের হওয়া লক্ষ করেনি, বাপ ছেলে বাথরুম থেকে বেরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে একেবারে হাইওয়েতে উঠে গেছে। প্রায় পাঁচ মাইলের মত গাড়ি ড্রাইভ করে ফেলেছে।

এদিকে আমরা মা-মেয়ে বের হয়ে কোন ফ্লেভারের কফি নিব, এসময় চিপস খাওয়া ঠিক হবে কিনা এসব আলাপ করে চলেছি। অনেকক্ষণ ওরা বেরুচ্ছে না দেখে আমি এবার টেনশন করছি। নওরোজ কি প্যান্ট নষ্ট করে ফেলেছে? এত দেরি হচ্ছে কেন? আরো কিছু সময় অপেক্ষার পর অসহিষ্ণু হয়ে বাইরে গিয়ে দেখি গাড়ি নেই। মেয়ে কল করল, আব্বু তুমি কই? … দিল গ্যাস স্টেশনের লোকেশন। পাঁচ মাইল আবার ড্রাইভ করে এসে আমাদেরকে নিল। এই ঘটনা কোনদিন ভুলব না, আর ভুলবনা ‘রয়্যাল ফার্মস’ গ্যাস স্টেশনের নাম! যাক… এত কাহিনীর পর আমরা সাড়ে আটটার দিকে গন্তব্যে পৌঁছালাম। রাতে খাওয়া দাওয়া আর জম্পেস আড্ডার পর ঘুমিয়ে পড়া। 

পরদিন আমরা ওয়াশিংটন ডিসি যাব, ঠিক করাই ছিল। গত কয়েক মাস ধরে নওরোজ ওয়াশিংটন ডিসি যাওয়ার জন্য বারবার বলছিল। হাবিব বলেছিল, ও যাবে না। ওকে ল্যাবে যেতেই হবে অন্তত তিন ঘন্টার জন্য। সকালে আমরা ওকে ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দিলাম ল্যাবে। সিদ্ধান্ত নিলাম ওর কাজ শেষেই বের হব। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এত ভালো আবহাওয়া থাকে না এখানটায়। কিন্তু সেদিন ছিল, আমরা ক্যাপিটল, হোয়াইট হাউজ, ওয়াশিংটন মনুমেন্ট ও লিঙ্কন মেমোরিয়াল ঘুরলাম সারা বিকেলজুড়ে। নওরোজ অনেক খুশি হয়েছে। আমাদের বৌমা বৃষ্টি প্রথমবার দেখেছে, ও অনেক উচ্ছ্বসিত। আমরা আরো দু’বার গিয়েছি ওখানে, কিন্তু আমরা মা-মেয়ে একটু বেশিই বাচ্চা। এরকম জায়গা হাজারবার দেখলেও আমাদের ক্লান্তি লাগবে না, লাগে না। 

ওখান থেকে ফিরে রাতের খাওয়া সেরে হাবিবদের এ্যাপার্টমেন্ট ঘুরলাম। একটা ভবনে শ’পাঁচেক বাসা। কত সুযোগ সুবিধা তাতে! বাচ্চাদের খেলার জায়গা, ব্যায়ামাগার (জিম), অতিথি আপ্যায়নের জায়গা, পড়াশুনার জায়গা, গল্প করার জায়গা কী নেই ঐ ভবনটায়! আমরাও ব্যায়াম করলাম আধাঘন্টা। পরদিনও আগের সকালের মতই হাবিব ল্যাবে চলে গেল। আমরা দুপুরের খাবার শেষে সরাসরি চলে গেলাম জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঘুরে ঘুরে ক্যাম্পাস দেখলাম, ছবি তুললাম।

তারপর গেলাম বাল্টিমোর ইনার হারবারে। আগেই একুরিয়ামের টিকেট করা ছিল বিকেল পাঁচটার। বাইরে কিছু সময় ঘুরাফিরা, কিছু খাওয়া দাওয়া করে ঢুকলাম মাছেদের সাম্রাজ্যে। এ এক বিশাল ও অনিন্দ্য সুন্দর জগৎ। দুই ঘন্টা শত শত রকমের মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী, রেইন ফরেস্ট দেখে, চোখকে অনাবিল আনন্দ, মনকে অফুরান প্রশান্তি দিয়ে বেরুলাম সাতটায়। আমাদের সবকিছু নিয়েই বেরিয়েছিলাম আমরা। হাবিব ও বৃষ্টিকে জন্স হপকিন্স ক্যাম্পাসে নামিয়ে দিয়ে আমরা যাত্রা করি নিউজার্সির দিকে। 

২৭ নভেম্বর আমার জন্মদিন। জন্মদিনের গল্প দিয়েই শেষ করব যাপিত জীবনের এবারের পর্ব। একটা অসাধারণ জন্মদিন কাটালাম। না… আহামরি কোন উপহার, বিশেষ কোন সারপ্রাইজ কিছুই না। কিছু মানুষের ভালোবাসায় উৎসারিত একটা দিন। সকাল বেলা ফোন করে মজুমদার বলল, হ্যাপি বার্থডে— এবার কিন্তু আমি ভুলি নাই। আমি হাসলাম মনে মনে আর ভাবলাম এটাই উপহার। যদিও জানি ফেসবুকে ততক্ষণে বেশ কিছু উইশ হয়েছে যারা আমাদের কমন বন্ধু, ভুলার কোন উপায়ই নেই। তবু খুশি হলাম… অল্পতে খুশি হওয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা দিয়ে আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন। 

তারপর থেকে ফোনের উপর ছিলাম বিকাল ২টা পর্যন্ত পরিবার ও বন্ধুদের সাথে। জাগ্রত কবিতা, স্টার লাইট, জোড়া শালিক, এসএসসি ৯৪, পিঙ্করোজ, ৯৪ উইএসএ, দলছুট, প্রতিফলিত রোদ্দুর, আই মিস ইউ, ক্লাব ৯৪ ইউএসএ, ৯৪ মা এন্ড মি সহ ফেসবুকের নানা গ্রুপে শতশত উইশে ভেসেছি। ব্যক্তিগতভাবে লিখেছে অনেকে। আমি কৃতজ্ঞ, আমি আপ্লুত, আমি ধন্য এত  এত ভালোবাসা পেয়ে। এই ছোট্ট জীবনে ভালো থাকার জন্য এরচেয়ে বেশি আর কি চাই! 

কাজ থেকে ফিরার সময় মজুমদার কেক আর আমার প্রিয় অর্কিড নিয়ে এল। এটা আমার প্রত্যাশিত ছিল না। ও এসব করত না আগে কখনো। আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেছি, সব মানুষ তো আর এক রকম হয় না। জন্মদিন হলেই কেক কাটতে হবে এমন বাধ্যবাধকতাও নেই। এইতো দু’দিন আগেই আমাদেরকে ঘুরিয়ে আনল বাল্টিমোর থেকে, সেটাকেই জন্মদিনের উপহার ভেবে নিলেই তো হয়ে গেল। আমি এসবের জন্য গোঁ ধরি না। এসব না আনলেও কিছু হত না কিন্তু আনাতে খুশি হয়েছি। 

স্পেন-জার্মানী ফুটবল ম্যাচ দেখা শেষ করে মেয়েকে ডর্মে রেখে আসার জন্য রেডি হলাম। কেক কাটলাম, ফটোসেশন করলাম, নিজেরা খেলাম। মেয়ে ও তার বন্ধুর জন্য বক্স করে নিয়ে নিলাম অর্ধেক পরিমান। বাকিটা রইল নওরোজের জন্য। 

জীবনে ভালোবাসাটা থাকলে এবং ভালো থাকতে জানলে সোনা-দানা-ডায়মন্ড-ফাইভ স্টার হোটেল লাগে না, একটা গোলাপি অর্কিডেই আনন্দে থাকা যায়। 

কুলসুম আক্তার সুমী, নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র