0

কর্কটে বসবাস (পর্ব-২)

Share

শাহরিয়া হোসেন রিয়া

আবার শুরু..সেই কর্কট। মানে আমার রাশি..ক্যান্সার। শুরু হলো অপারেশনের ডেট খোঁজা। এর মধ্যেই চলতে থাকলো আমার সংগ্রামী জীবন। সকাল বা বিকালে জব করি। বাসায় ফিরে এমন ভাব করি যেন কিছুই হয়নি আমার । কিন্তু আমি জানি..ভেতরে ভেতরে কি রকম যুদ্ধ করছি আমি। ভাবছি আমার সন্তানের কথা। মায়ের কথা..বোনের কথা..ভাইয়ের কথা। সব কিছু এলোমেলো লাগে। সারাদিন যেমন তেমন..রাত গভীর হলে ভয় বাড়তে থাকে। ঠিক ভয় নয়..দুশ্চিন্তা ।

 কত কিছু মাথায় ঘোরে। ভাবি ..আমি না থাকলে ওরা কি করবে। আমার পরিচিত মুখ,বন্ধু-বান্ধব..ওরা কতটুকু কষ্ট পাবে। নানান চিন্তায় ঘুম আসেনা আমার। ধীরে ধীরে শরীর খারাপ হতে শুরু করে। আম্মু সারাক্ষণ গল্প করে । ছোট বোন টুম্পা কারণে অকারণে ছুটে ছুটে আসে । ভাব এমন কিছুই হয়নি । কিন্তু আমি বুঝি..ভেতরে ভেতরে একেবারেই ভেঙে পড়েছে আম্মু আর টুম্পা। বড় মেয়ে রাইয়্যানা..গভীর রাতে কফি খাওযাতে নিয়ে যেতে চায়। বুঝতে পারি আমি, কম কথা বলা এই মেয়েটা আমার সাথে আরও একটু বেশি সময় কাটাতে চাইছে। হয়তো তাদের মনেও নানান শংকা উঁকি দিচ্ছে। আমার কিছুই ভালো লাগে না। দেখতে দেখতে রমজান শেষ হয়ে যায় । 

ঈদের দিন সবাই মিলে নামাজ পড়তে যাই। নামাজ শেষে বাসায় ফিরতেই ডাক্তারের ফোন। অপারেশনের তারিখ দেয়া হয়েছে। আমার কর্কট মুক্তির দিন গণনা শুরু। হয়তো ভাবছেন..ক্যান্সার থেকে মুক্তি । আহা..এমন যদি হতো। আর যার জীবন চৌদ্দ আনাই কুড়িয়ে পাওয়া তার কি এত সহজে মুক্তি মেলে ! ঈদের দুই দিন পর থেকেই আম্মুর শরীর খারাপ হতে শুরু করলো। টেস্ট করালাম। করোনা পজিটিভ। একে একে আমার মেয়ে দুজনও পজিটিভ হলো। 

আরো ভেঙে পরলাম। আম্মু..বাচ্চারা করোনা আক্রান্ত এ কারণে নয়। চিন্তা বাড়তে লাগলো এবার নিজের জন্যই। কারণ আমি নিজে পজিটিভ হলে আর অপারেশন হবে না । একবার তারিখ মিস হলে পরে আবার কবে পাওয়া যাবে অপারেশনের তারিখ তার ঠিক নেই। উন্নত দেশগুলোর এই এক সমস্যা। এক একটা অপারেশনের তারিখ পেতে এক বছরও লেগে যায়। অপারেশনের তারিখ যত ঘনিয়ে আসে, আমার কপালে চিন্তার ভাঁজও ঘন হতে থাকে। 

আরও পরীক্ষা বাকি ছিলো আমার। যে মানুষটি সব সময় আমাকে সাহস জুগিয়েছে ..আমার অপারেশনের সময় আমার পাশে থাকবে বলে কথা দিয়েছে..সেই ছোট বোন টুম্পাও করোনা আক্রান্ত হলো। এবার আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছা করতো সেই সময় । যাই হোক আল্লাহ মনে হয় এবার আমার দিকে মুখ তুলে চাইলেন। আমার অপারেশনের ঠিক আগের দিন টুম্পা করোনা নেগেটিভ হলো ।

আজ কর্কট থেকে মুক্তির দিন । সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। ছোট বোন টুম্পা..টুম্পার বর শিহাব আর আমি। আমার বর তখন বাংলাদেশে। গাড়িতে কেউ কারো সাথে কথা বলছি না ।টুম্পা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আমিও বাইরে তাকিয়ে আছি। সব কিছুর ছুটে চলা দেখছি। কি অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছে । এই প্রথম আমার মনে হলো..জীবন সত্যিই সুন্দর! এই পথ দিয়ে আগেও বহুবার গিয়েছি। কিন্তু এই রাস্তাটা আগে এতোটা সুন্দর কখনো লাগেনি । হয়তো কর্কট থেকে মুক্তি পাবো এই আনন্দই ভর করে ছিলো মনে।

আমাদের মনের অবস্থা শিহাব হয়তো বুঝতে পারছিলো। সে মাঝে মাঝে টুকটাক কথা বলে মন ভালো করার চেষ্টা করছিলো। হা অথবা হু এর মধ্যেই আমাদের উত্তর সীমাবদ্ধ ছিলো। ছোট্ট একটু পথ..কিন্তু মনে হলো কত পথ ঘুরে ঘুরে হাসপাতালে পৌঁছালাম। সব ফরমালিটিজ শেষ করে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো অপারেশন রুমে । একটি ছোট্ট বেডে শুয়ে থাকতে বললো। আমি শুয়ে শুয়ে হাসপাতালের ছাদ দেখতে লাগলাম।

একসময় ডাক্তার এলেন। আমাকে অজ্ঞান করা হলো। আর কিছু মনে মনে নেই। আমি গভীর স্বপ্নে ডুবে গেলাম। দেখলাম.. আমার অপারেশন চলছে, চিন্তিত মুখে বাইরে বসে আছে আমার ছোট্ট বোনটি। অসীম সাহসী এবং পৃথিবীর সব দু:খ কষ্ট সহ্য করার অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো মেয়েটির চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। গড়িয়ে পড়া সেই পানি  লুকানোর চেষ্টাও করছে না সে। অপলক তাকিয়ে আছে সে উপরের দিকে। যেন সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু প্রার্থনা করছে । 

বাসায় আম্মু একা। অসুস্থ শরীর নিয়ে মেয়ের পাশে থাকতে না পারার শোকে কান্না করছে । দুই মেয়ে.রাইয়্যানা আর জারাহ দুই রুমে একাকী বসে আছে। এক মনে তাকিয়ে আছে রঙিন দেয়ালের দিকে। এখন তাদের কাছে সব কিছুই ফিকে লাগছে। বাংলাদেশে নিজের চেম্বারে একমনে পায়চারী করছে আমার বর। আর আমি ? কেউ একজন দেবদূত বা পরী..আমাকে নিয়ে শূণ্যে উড়ে যাচ্ছে কোলে নিয়ে। যেন আমাকে সব কিছু থেকে মুক্তি দিতে চাইছে । যে কর্কটে আমার বসবাস । সেই কর্কট থেকে মুক্তি। আমি আমার শরীর এলিয়ে দিয়েছি তার দুই হাতের উপর। উড়ে যাচ্ছি হাওয়ার মেঘে ভেসে । অসীম কোন সুন্দরের দিকে ……!

শাহরিয়া হোসেন রিয়া, এডমন্টন (কানাডা)