শাহরিয়া হোসেন রিয়া
আমি ক্যান্সার ! কি চমকে উঠলেন ? না..মানে আমার রাশি ক্যান্সার..যেটাকে কর্কট বলে । জুলাই মাসে আমার জন্ম। আমার রাশি কর্কট বলেই কি না জানি না…সেই ছোটবেলা থেকেই এই ক্যান্সারের সাথেই আমার বসবাস। আমার বাবা..আমার হিরো। সুদর্শন.সুঠাম দেহ..হাসি খুশি..পরিশ্রমী একজন মানুষ। না তিনি এখন নেই। সেই ১৯৯৬ সালেই আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়েছেন । কারণ ঐ যে বললাম..আমার ক্যান্সারের সাথেই বসবাস ।
বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। স্বপ্নবাজ একজন মানুষ। এই মানুষটিকেই আমি দেখেছি ডিউডেনাম ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করতে। কখনও ধানমন্ডির ডেলটা হাসপাতাল । কখনও বেইলি রোডের মনোয়ারা হাসপাতাল। পুরনো সেই দিনের কথা মনে হলে এখনও নাকে লাগে হাসপাতালের করিডোরের ডেটলের কড়া গন্ধ। চোখ বন্ধ করলে এখনও দেখতে পাই শেষ সময়ে আব্বুর তীব্র যন্ত্রণা। আর চোখে ভাসে আম্মুর তীব্র লড়াই। চেয়ে চেয়ে দেখতাম..আম্মু একরুম থেকে আরেক রুমে দৌড়াচ্ছে ।
আম্মুর ফর্সা গাল..চিবুক লাল হয়ে আছে গরমে। ঘাম চিকচিক করছে সারা মুখে । এক হাতে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে ছুটতেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে । যদি তার পরম ভরসার মানুষটিকে যমদূতের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন। না পারলেন না। মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই হেরে গেলেন আম্মু। হেরে গেলাম আমরা সবাই । ছোট্ট সেই আমি..আমার মন..সব কিছুই যেন সেদিন থেকেই ক্যান্সারের সাথে বসবাসের ভবিষ্যত পাকা করে নিয়েছিল। আমার রাশি ক্যান্সার..বাবাও চলে গেলেন ক্যান্সারে ।

বেশ কিছুক্ষণ তো গল্প করলাম। নিজেকেই তো জানালাম না। আমি থাকি কানাডার এডমন্টনে। স্বামী..দুই কন্যা আর মা….এই চারজনকে নিয়েই আমার সুখের সংসার । এই সুখও আমাকে যু্দ্ধ জয় করে আনতে হয়েছে দুই বছর আগে। ঐ যে বলেছিলাম আমি ক্যান্সার । যেন আঠার মতো লেগে আছে শব্দটা আমার সাথে। সেই গল্প পরে করছি।
কানাডায় পাড়ি দেবার আগে বাংলাদেশে বেশ ভালোই জনপ্রিয় তখন আমি । বেসরকারি টেলিভিশন ‘চ্যানেল আই’ তে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় বিট আমার ঘাড়ে । এর বাইরেও বড় বড় ইভেন্ট বা উৎসবের এ্যাসাইনেমন্ট আসলেই ডাক পড়তো আমার । অহংকার করে বললে বলতে পারি হাতে গোনা কয়েকটি স্যাটেলাইট টিভির সময় কম বেশি সবাই চিনতো আমাকে । শাহরিয়া হোসেন রিয়া । ডাকনাম রিয়া নামেই পরিচিত।
সালটা…২০১৪। মাস ২৪ ডিসেম্বর..বুধবার । পরিচিত জন..পরিচিত পরিবেশ..ভালো লাগার বন্ধু, কাছে আত্মীয় সবাইকে ছেড়ে চলে এলাম কানাডায়। নিজের জন্য নয়, সন্তানদের উন্নত জীবনের জন্য । চিরদিনের জন্য দেশ ছেড়ে আসার সময়টা এখনও চোখে ভাসে। ভোর বেলা বিমান ছাড়লো । ৩০ হাজার ফুট উপরে ধীরে ধীরে সূর্যের আভা ছড়ানো দেখতে লাগলাম । কিন্তু আমার মনের আভা ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। নতুন করে আবার জীবন শুরুর শংকা ভর করলো । তখনও ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি সেই ১৯৯৬ সালের ক্যান্সার পিছু নিয়েছে আমার নিয়তি হয়ে ।

কানাডার ক্যালগিরিতে নামলাম । স্বপ্নের কানাডা । সুন্দর গোছানো দেশ । মানুষগুলোও সুন্দর । সবকিছুই সুন্দর হয়ে ধরা দিলো চোখে । হয়তো এর কারণও ছিলো। এখানেই তো আমার সব..আমার প্রাণপ্রিয় মা..আমার আদরের ছোট বোন, প্রিয় বড় ভাই। প্রিয় মানুষগুলোর সাথে এখন থেকে একসাথে থাকবো..সব কিছু তো আমার ভালো লাগবেই। কানাডা নেমে সবাইকে পেলাম। কিন্তু মনটা তারপরও খচখচ করতে লাগলো। প্রিয় আরেকজন মানুষ তো বহুদূরে এখনো। ছোট বোন রিপা । সেই আক্ষেপও বেশিক্ষণ থাকলো না । ইন্টারনেটের বদৌলতে মুহুর্তেই কাছে এলো রিপা।
তারপরের কানাডার জীবনে আসি। এডমন্টনে আমার যে বাড়ি সেখান থেকে আমার বোন টুম্পার বাড়ি পাঁচ মিনিটের পথ। মা আমার সাথেই । বড় ভাই রাসেল..ওর বাড়ি একটু দূরে । ক্যালগিরি। উন্নত দেশে তাও খুব বেশি পথ না। তিন ঘন্টার ড্রাইভ। ১২০/১৩০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে যাওয়া যায় গাড়ি নিয়ে। শুরু হলো আমার খুশীর জীবন। নতুন আর এক জীবন। যে জীবনে চাইলেই ছোঁয়া যায় ,জড়িয়ে ধরা যায়..প্রিয় মা..প্রিয় ভাই..প্রিয় বোনকে ।
না…খুব বেশিদিন সেই সুখ স্থায়ী হলোনা। আবারও সেই ক্যান্সার । আমার সাথে সাথে সেও যে এসেছে এদেশে। ২০১৯ সাল। নতুন জীবন সবে মাত্র গোছাতে শুরু করেছি। ঠিক সেই সময়ে আমার জীবনে আবারো কর্কটের হানা। এবার শিকার আমার বর। এ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম। বাংলাদেশের নামকরা ক্রিমিনাল ল’ইয়ার। বেশ কিছুদিন ধরেই তার শরীর খারাপ। তখনও বুঝতে পারিনি তার শরীরেও বাসা বেঁধেছে আমার আজীবনের কষ্টের নাম ক্যান্সার । যে ক্যান্সার খুব অল্প বয়সেই পিতা হারা করেছে আমাদের ৪ ভাই-বোনকে। বরকে নিয়ে শুরু হলো নতুন আরেক যুদ্ধ।

উন্নত দেশ..উন্নত চিকিৎসা..তারপরও সারাক্ষণ বুক ধকধক করে । আল্লাহর কাছে একটাই দোয়া চাইতাম “হে বিধাতা আমার দুই কন্যা রাইয়্যানা আর জারাহ্ কে বাবার মায়ার বাঁধন থেকে বঞ্চিত করো না। আমার মতো অল্প বয়সে বাবা হারা করো না তাদের । দোয়া করতাম..আর দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তো। মনে হতো পারবো তো যুদ্ধে জয়ী হতে ? ডাক্তারদের মধুর ব্যবহার,আমার বরের প্রবল মনোবল…উন্নত চিকিৎসা..আমার সন্তানদের মায়া..উপর আল্লাহ মনে হয় ফিরে তাকালেন ।
এর মাঝেই চলছে আমার টিকে থাকার লড়াই। কখনও ৮ ঘন্টা..কখনও ৬ ঘন্টার জব । বাসায় ফিরে সবার খাবার আয়োজন । বাচ্চাদের যত্ন । সাথে বরের দেখভাল । আমার সাথে সাথে এই যুদ্ধে যোগ দিলেন আরো তিন যোদ্ধা। একজন আমার মা। আমার বড় ভাই। আরেকজন ছোট বোন টুম্পা ।
দিনক্ষণ ঠিক করে বরকে ভর্তি করালাম হাসপাতালে । দীর্ঘ ১২ ঘন্টার অপারেশন। সফল হলো । ছোট্ট করে একটা প্রশান্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে । মনে হলো কতদিন বুক ভরে নিশ্বাস নিই না ।বাচ্চাদের খুশীর কান্না। চারদিকে কেমন আলো হয়ে উঠলো। আবার শুরু হলো আমার নতুন করে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পালা। বড় মেয়ে রাইয়্যানা ভর্তি হলো ভার্সিটিতে ।

এর কিছুদিন পর শুধু আমি নই..পুরো পৃথিবীই ছেঁয়ে গেলো বিষাদে। হানা দিলো কোভিড নাইনটিন। একটু সোজা হয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে ২০২০-২০২১ বলতে গেলে সারা পৃথিবী জুড়েই লকডাউন। সবাই যখন ঘরে বসে আমি তখনও জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি নিজের মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে । সুপার শপে সুপারভাইজারের কাজ । সব বন্ধ থাকলেও খাওয়া দাওয়া তো বন্ধ করা যাবেনা। তাই যেতেই হতো কাজে । সে সময় মনে হতো..আমাকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে। আমার মতো মানুষের মৃত্যু ভয় থাকতে পারে না । কারণ আমার জন্যে আরো ৫টি পরিবার বাঁচবে। চ্যালেঞ্জের সাথেই কাজটা চালিয়ে গেছি টানা দুই বছর। এক্ষেত্রে সাহস যুগিয়েছে আগের সাংবাদিকতা পেশা ।
যাই হোক, মাত্র কোভিডের ভয়াবহতা কাটতে শুরু করেছে। আমিও মাস্ক ছাড়া নিশ্বাস নিতে শুরু করেছি। নতুন বছর ২০২২। আনন্দ নিয়েই শুরু হলো। কিন্তু সেই আনন্দও আমার জীবনে বেশিদিন স্থায়ী হলো না। শরীর খারাপ করতো একটু একটু। খুব একটা পাত্তা দিইনি। মেনে নিলাম এই ভেবে যে, আল্লাহ যাকে বেশি ভালোবাসেন তাকেই হয়তো বেশি কষ্ট দেন। একসময় শরীর আরো খারাপ হতে থাকলে ছোট বোনের পরামর্শে গেলাম ডাক্তারের কাছে । নানা টেস্ট দিলেন ডাক্তার । কিন্তু বিধিবাম ! কে জানতো ক্যান্সার যে এবার আমার ঘাড়েই নিশ্বাস ফেলছে। এরপরই শুরু নতুন আরেকটি গল্পের । নতুন এক যুদ্ধের।
এপ্রিল মাসের ১ তারিখ । রোজা এসে কড়া নাড়ছে । এপ্রিলের ২ তারিখ কানাডার এডমন্টনে রোজা শুরু হয়েছে। লম্বা দিন থাকায় ১৭ ঘন্টার বেশি রোজা রাখতে হয় এখানে। রোজার প্রথম দিনেই ছোট বোন টুম্পার বাসায় ইফতারের দাওয়াত । বাসা কাছে হওয়ায় আমি, আম্মু আর আমার মেয়েরা ইফতারের আগে ভাগে যেয়ে হাজির। বিশাল ইফতারের আয়োজন ছিল সেদিন। কিন্তু ইফতারের পর আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে আমি ঘুণাক্ষরেও তা টের পাইনি। ইফতার শেষ করে আয়েশ করে যেই না টুম্পার কাছে এসে বসেছি..ঠিক সে সময় হঠাৎ টুম্পার ডাক। আপু তোমার সাথে জরুরি কথা আছে চলো উপরে শুয়ে শুয়ে তোমার সাথে জরুরি কথাটা সেরে নিই। আমি বললাম.. যা বলার এখানেই বল।

টুম্পা কথাগুলা এক নাগাড়ে বলতে লাগলো। আমি শুধু শুনছিলাম । আপু তোমার থাইরয়েড সার্জারি করতে হবে । তোমার মার্চের ৩০ তারিখ করা বায়োপসির রিপোর্ট ভালো আসেনি। ফ্যামিলি ডাক্তার ফারুক ভাই ( এডমন্টনে নামকরা বাঙালি ডাক্তার) বলেছেন তোমার থাইরয়েড ক্যান্সার । টুম্পার এ কথা শোনার পর আমি কিছুক্ষণ টুম্পার দিকে তাকিয়ে থাকলাম! আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি টুম্পার দিকে। দিব্যি আমি সুস্থ মানুষ । নিজের কান কে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না । নিজেকে কঠিন থেকে কঠিন করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলাম তখন । নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে । থামছেই না যেন। সে সময়ই হঠাৎ কবীর সুমনের গানটা মাথায় খেলছে..
“কখনো সময় আসে জীবন মুচকি হাসে ঠিক যেন প’ড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা”.. কেন আমার মনে গানটা বেজে উঠলো জানি না । কিছুক্ষণ পর মনে হলো সত্যিই তো । আমার জীবনটা মনে হয় কুড়িয়ে পাওয়া কিছু আনাই । যেখানে ১৬ আনার হিসাব মেলানোটা আমার জন্য নয়। আজ এটুকুই থাক…বাকি কথা না হয় অন্যদিন বলবো….।
শাহরিয়া হোসেন রিয়া, এডমন্টন কানাডা থেকে