রোহানা ফাহমিদা
বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা নেত্রকোনায়। বোটানিতে অনার্স পড়ার সময় বিয়ে হয়ে যায় পারিবারিকভাবে। যার ফলে মাস্টার্সটা আর করা হয়ে উঠেনি। কিছুদিন পরই পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে পাড়ি জমাই যুক্তরাষ্ট্রে বরের কাছে। সেটেল্ড ম্যারেজ ছিল তাই ভয়টা তো একটু ছিলই, কারণ চেনাজানাটা আগে থেকে ছিল না। সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রে যাচ্ছি বসবাসের জন্য। কেমন হবে সে জায়গাটা আমার জন্য, সে ভয়েও ভীত ছিলাম কিছুটা। তবে দুটো ভয়ই আমার কেটে যেতে থাকে সেখানে যাওয়ার পর। এটা ২০০৪ সালের কথা।
ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারছি পরিবারের পছন্দে যাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছি তিনি মানুষটা নেহায়েত মন্দ নন। কারণ বরকে (জহির) বন্ধুর মতো পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আমি এখানে আসার পর সে অনেক চেষ্টা করেছে আমি যাতে বোর ফিল না করি। সে বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সবসময় মানসিক সাপোর্ট দিতো আমাকে। ধীরে ধীরে আমি ঘর থেকে বের হওয়া শুরু করি। আমরা থাকি ওয়েস্ট পাম বিচ, ফ্লোরিডায়। এক কথায় চমৎকার জায়গা। চারপাশে পাম গাছ আর সমুদ্র। সুন্দর প্রকৃতি, সমুদ্রের নীল জল – এসবের সাথেই সখ্যতা হতে থাকে আমার। বিশ্বের অনেকস সেলিব্রেটির বাড়ি আছে এখানে। কোন এক ভ্যাকেশনে বেড়াতে চলে আসেন বছরে একবার হলেও।

সময় কাটানোর জন্য তখন আমি পাশের একটা কফি শপে গিয়ে বসে থাকি একা একা। দীর্ঘ সময় বসে বসে আমি বিভিন্ন দেশের মানুষকে বোঝার চেষ্টা করে চলেছি মনে মনে। এই কফি শপটা চালান একজন ভারতীয় নারী। তার বয়স তখন আনুমানিক ৫০ বছর হবে । আমার প্রতিদিন কফি শপে যাওয়া এবং একা বসে থাকাটা খুব সম্ভবত উনি প্রথম থেকেই নোটিশ করেছেন। একদিন কি মনে করে আমাকে বললেন, “তুমি কি জব করবে, চাকরি দরকার তোমার? প্রতিদিন চুপচাপ বসে থাকো, তুমি চাইলে আমাদের এখানে জয়েন করতে পারো।” কফি শপটার নাম ছিল ‘ডানকিন ডোনাটস’। আমি ভদ্রমহিলার এমন অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হই। সেদিন কোন কথা দিইনি উনাকে। কিন্তু ভালোবাসায় সুন্দর এক অনুভূতি নিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম সেদিন।

জহিরের সাথে পরামর্শ করি জয়েন করব কি না। সে জানায়, আমার ভাল লাগলে করতে পারি অথবা তার বিজনেসেও জয়েন করতে পারি। তখন ভেবে চিন্তে আমি ‘ ডানকিন ডোনাটস’ এ জয়েন করার সিদ্ধান্ত নিই এবং সরাসরি ম্যানেজার পদে। সেই সময়ে আমার সেখানকার যে স্যালারি সেটা বেশ আকর্ষণীয় ছিল। এখানে আমার কাজেও খুব সন্তুষ্ট ছিলেন তারা। মূল কথা, ইন্ডিয়ান ভদ্রমহিলা আমাকে খুব ভালবেসে ফেলেছিলেন কোন এক অজানা কারণে।
এর মধ্যেই এই শপে একজন বাংলাদেশি নারীর জবের ব্যবস্থা করি। তিনি এখানে একটি বিশেষ কারণে খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলেন এবং উনার একটা চাকরির খুব দরকার ছিল। কিন্তু ইংরেজি না জানায় প্রথমে নিতে রাজি ছিলেন না মালিক। আমি রিকোয়েস্ট করলে প্রথমে উনাকে পেছনের দিকে একটা কাজের সুযোগ দেওয়া হয়। এবং পরবর্তীতে উনিও নিজেকে তৈরি করে নেন এবং ভাল করতে থাকেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে তিনি এখন ইউএসএ তে বেশ ভাল অবস্থায় আছেন। তবুও আমার সাথে দেখা হলে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। এই এতটুকু ভালবাসা আমাকে কতটা আনন্দ দেয় সেটা বোঝাতে পারব না।

আমার বড় সন্তান জন্মের পর জবটা ছেড়ে দিই। একটা পর্যায়ে স্বামীর বিজনেসেই জয়েন করে তাকে সহযোগিতা করতে শুরু করি এবং ভালোবাসা থেকে পার্টটাইম বাচ্চাদের স্কুলে পড়াই। ফ্লোরিডার দিনগুলো আমার অনেক আনন্দে কাটলেও মন পড়ে থাকে দেশে বাবা-মায়ের কাছে। আমি প্রতি বছর না পারলেও দুই বছর পরপরই দেশে যাই। বাবা-মাও বেড়াতে আসেন। এরপর আমার কোলজুড়ে আসে দ্বিতীয় সন্তান। দুই সন্তানের মধ্যে বয়সের অনেক ব্যবধান। বড়টা কলেজে এবং ছোটটার তিন বছর বয়স। ছোট ছেলের জন্মের সময় থেকে পরবর্তী অনেকটা সময় আমার মায়ের সাপোর্ট পেয়েছি। আমার মা দেশ থেকে এসেছিলেন। কারণ ওর জন্মের পর শারীরিকভাবে একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম।

এখন ফ্লোরিডায় বেশ কিছু সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত। বাঙালি কমিউনিটির সাথেও আমার বেশ সুসম্পর্ক রয়েছে। এখানে বসবাসকারী বাংলাদেশের মানুষ আমাকে খুব ভালোবাসেন- এটা আমার অনেক বড় পাওয়া। আমিও আমার সামর্থ্য অনুযায়ী সংগঠনের মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগতভাবেও অনেক বাংলাদেশি নারীর পাশে থাকার চেষ্টা করি। আমাদের বিজনেসে অনেক বাংলাদেশির কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেবার চেষ্টা করি আমার সাধ্যমতো এবং এই কাজগুলো করে আমি একটা মানসিক তৃপ্তি পাই।

আর আমার এসব কাজের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা বাবা-মা। ফ্লোরিডায় বেশ ভালই আছি আমি তবুও দেশের জন্য মন কেমন করে। মন মাঝে মাঝেই উঁকি দেয় শৈশবে। নেত্রকোনা শহরের অলিগলি আমাকে বেশ টানে। স্বপ্ন দেখি, একটা সময় দেশে ফিরে গিয়ে সেখানকার অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার।
রোহানা ফাহমিদা, ওয়েস্ট পাম বিচ, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র