শায়লা শবনম
“বুঝলি রে মা, মেয়ে হওয়াই ভালো। এখন তো মেয়েরাই বাপ-মারে দ্যাখে, সেবা-যত্ন করে।’
তিনু অবাক হয়ে বললো, ‘আপনি এই কথা বলছেন চাচি! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না!’
‘হয় রে মা! কই কী আর সাধে! এই-যে তোরা বোনেরা কী সুন্দর মায়েরে দেইখা রাখছোস, অসুখ বিসুখে কাছে নিয়া রাখছোস। ছেলে হইলেই কী সবাই করে এইগুলা?’
‘কেন চাচি, আপনার ছেলেরা আপনাদের দেখে না? সেবা-যত্ন করে না?’
তিনুর এ প্রশ্নে সুন্দরী চাচি’র কথার সুর বদলে যায়। তিনি ফিরে যান তার পুরনো রূপে। একটু হেসে বলেন, ‘আমি কী সেইটা বললাম নাকি? আমার ছেলেরা আমারে দ্যাখবে না ক্যান! তয় তোরা মেয়ে হইয়া যেমন করোস সেইটা কি আর ছেলেগো দিয়া হয়?’
তিনু জিজ্ঞেস করলো, ‘রাহাত এখন কী করে চাচি?’
‘রাহাত তো একটা সংস্থায় বড় চাকরি করে। বিশ-বাইশ হাজার টাকা বেতন পায়।’ বেশ গর্বের সঙ্গেই বললেন সুন্দরী চাচি।
‘ওহ, ভালো তো! আর রফিক ভাই, শফিক ভাই?’
‘শফিক তো সৌদি আরবে থাকে। ম্যালা টাকা পায়। রফিকও জমিজিরাত নিয়া ভালোই আছে।’
‘তাহলে মেয়ের জন্য দুঃখ করছেন কেন? ছেলেদের নিয়ে তো ভালোই আছেন।’
‘তা আছি। তয় তোদের বাপ মরণের সময় তোরা যেভাবে কান্নাকাটি করছিলি, ছেলেরা কি আর সেইটা করে?’ সুন্দরী চাচি আক্ষেপ করে বলেন।
‘কান্নাকাটি করার জন্যে তো মেয়ে দরকার নেই। ছেলেদের নিয়ে ভালো আছেন এটাই বড় কথা। আমি এখন যাই চাচি, মেয়ে দুইটা মনে হয় উঠে গেছে ঘুম থেকে।’
‘যাইবা? কিছু মুখে দিয়া গ্যালা না!’
‘এখন থাক, আবার আসবো চাচি।’
‘আচ্ছা মা, আইসো তাইলে। তোমাগো দ্যাখলেও শান্তি পাই মনে।’ তিনুকে কিছুটা এগিয়ে দেন চাচি।
প্রায় তিন বছর পরে গ্রামের বাড়িতে এসেছে তিনু। উৎসব পার্বণে ছুটিছাটা যে কয়দিন পায় শ্বশুরবাড়িতেই চলে যায়। দুয়েকবার ঢাকায় নিজেদের বাসায়ও ঈদ করেছে। আম্মা তো এখন বেশিরভাগ সময় তাদের কাছে ঢাকাতেই থাকেন। বড়আপা ডাক্তার, আর তিনু সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আম্মা কখনো তার বাসায়, কখনো আপার বাসায় থাকেন। আম্মা থাকলে তারাও বাচ্চাকাচ্চা রেখে নিশ্চিন্তে অফিস করতে পারে। এতো ঝক্কিঝামেলা করে গ্রামে আর আসতে ইচ্ছে করে না। এবার রিনু এসেছে অস্ট্রেলিয়া থেকে তিন বছর পর। বিয়ের পরে সেই-যে চলে গিয়েছিল তারপর এবারই এলো। তাই তারা ছুটি নিয়ে তিনবোন একসঙ্গে এবার গ্রামে এসেছে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে।
তিনু’র সকালে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস। বাসায় সকালে উঠেই একগাদা কাজ করতে হয়। দুই মেয়েকে নাস্তা খাইয়ে, টিফিন গুছিয়ে, স্কুলের জন্য রেডি করে, বাচ্চাদের স্কুলে ড্রপ করে তবে অফিসে যেতে হয়। মেয়েদের বাবা আসিফও হেল্প করে, কিন্তু মূল কাজগুলো তো তিনুকেই করতে হয়। সকালে ওঠাটা তাই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আজ সকালে ঘুম ভেঙে আর বিছানায় থাকতে ইচ্ছে হলো না। অন্য সবাই আরাম করে ঘুমোচ্ছে। তিনু আম্মাকে বলে হাঁটতে বেরিয়ে পড়লো। জমিতে নেমে খালি পায়ে হাঁটতে ভীষণ ভালো লাগছিলো। হাঁটতে হাঁটতেই রাহাতদের বাড়ির কাছে চলে এলো। বাড়ির প্রবেশপথেই রাহাতের সঙ্গে দেখা।
তিনু জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন আছিস রাহাত?’
‘ভালো। কবে এসেছেন?’ রাহাত গম্ভীর মুখে বললো।
‘গতকাল। কিন্তু তুই আমার সাথে ‘আপনি আপনি’ করছিস কেন?’ তিনু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘বাড়িতে মা আছে, যান।’ কথাটা বলে তিনু’র প্রশ্নের উত্তর না-দিয়েই দ্রুত বেরিয়ে গেলো রাহাত।
তিনু অবাক হয়ে তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তিনু আর রাহাত স্কুলে একই ক্লাসে পড়তো। সে-সময় অনেকভাবে রাহাত তাকে জ্বালিয়েছে। বহুবার প্রেমপত্র দিয়েছে। তিনু’র তখন পড়াশুনা ছাড়া অন্যকিছু মাথায় ছিলো না। অনেকবার রাহাতকে সাবধান করেছে। যতবার চিঠি পেতো প্রতিবারই এনে আম্মার হাতে তুলে দিতো। আম্মা সুন্দরী চাচিকে এ ব্যাপারে কিছু বললে তিনি ছেলের পক্ষ নিয়ে ঝগড়া করতে আসতেন কোমর বেঁধে। তার ছেলেদের মতো ভদ্র, শান্ত, ভালো ছেলে নাকি হয়ই না! তিনু’র মায়ের ছেলে নেই তো, তাই হিংসা করে নাকি তার ছেলেদের নামে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে!
এর আগে রফিক ভাইও নাকি বড় আপাকে অনেকভাবে ডিস্টার্ব করেছে। তার যন্ত্রণায় আপাকে তো পরে মামাবাড়িতেই পাঠিয়ে দেয়া হলো!
আম্মা একদিন কেঁদেকেটে বাবার কাছে কথাগুলো তুললে বাবা বলেছিলেন, ‘এইসব মানুষদের নিয়ে কথা বলার কিছু নাই। ওরা কি বুঝবে যে আমাদের ছেলের দরকার নেই? আমার মেয়েরা তো আমার কাছে এক-একটা রত্ন।
সেই রাহাত তিনু’র সাথে আজ ‘আপনি’ সম্বোধন করে কথা বলছে! প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়েই তিনু ওদের বাড়িতে ঢুকলো। সেখানেই সুন্দরী চাচি’র সাথে দেখা। সুন্দরী চাচি’র গায়ের রঙ উজ্জ্বল ফর্সা। আর গ্রামে তো গায়ের রঙ ফর্সা মানেই সুন্দর। তাই তার নামই হয়ে যায় সুন্দরী। চাচি তিনুকে দেখে খুশি হলেন। এরপরই তার সাথে উপরিউক্ত কথোপকথন।
বাড়িতে এসে তিনু দেখে আম্মা মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনিদের জন্য পিঠা বানাতে ব্যস্ত। তিনুও আম্মার সাথে হাত লাগায়। কাজের ফাঁকেই সে আম্মাকে সুন্দরী চাচিদের বাড়ি যাওয়ার কথা বললো।
আম্মা বললো, ‘ভালো হইছে গেছোস। সুন্দরী ভাবীরা একদমই ভালো নাই। ছেলেগুলা তো হইছে এক একটা অমানুষ। একটাও লেখাপড়া করলো না বেশিদূর।’
তিনু অবাক হয়ে বললো, ‘কেন চাচি যে বললো রাহাত এনজিওতে ভালো চাকরি করে! শফিক ভাই বিদেশে ভালো ইনকাম করে!’
‘এনজিওতে চাকরি না ছাই! রাহাতটা তো একটা টাউট। মানুষের কাছ থেকে উল্টাপাল্টা কথা বলে টাকা আনে, আর শোধ করে না। যৌতুকের জন্য বউরে ধইরা মাইরধোর করতো। আবার মানুষজনও পাওনা আদায়ের জন্য বাড়িতে এসে বউরে হুমকি দিয়া যাইতো। বউটা তো এসব যন্ত্রণাতেই বাপের বাড়ি গিয়া আর আসে নাই। রাহাতও পলাই পলাই বেড়ায়। শফিকও বিদেশ থেকে বাপ-মায়েরে টাকা পয়সা পাঠায় না। বউয়ের বাপের বাড়ির কাছে বাড়ি করছে, সেইখানেই সব পাঠায়।
‘আর রফিক ভাই? সে দেখে না চাচা-চাচিরে?’
‘অইটা তো কুঁড়ের একশেষ! বাপের জমি বিক্রি করে আর খায়। জমিজমা যা ছিল, তিনভাই মিলে সব তো বিক্রি করে শেষ করেছে। এখন বাপ-মায়েরে কেউ ঠিকমতো দেখাশুনা করে না, প্রায়ই গালিগালাজ করে। মাঝেমাঝে নাকি গায়েও হাত তোলে। আমি বাড়ি আসলে ভাবী তো প্রায়ই টাকাপয়সা চাইতে আসে। ছেলেদের নিয়া দুঃখ করে, কান্নাকাটি করে।
তিনু প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে আম্মার কথা শোনে। সেই সুন্দরী চাচি, যার রূপের দেমাগ ছিল ভীষণ। তিন ছেলের গর্বে মাটিতে যার পা পড়তো না। ছেলেদের অতি আদরে, প্রশ্রয় দিয়ে যিনি মাথায় তুলে রাখতেন। তার ছেলেদের নামে কেউ কিছু বললে যিনি তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিতেন। আজ তার এই হাল!
তিনু’র দুই মেয়ে উঠে পড়েছে ঘুম থেকে। তাদের দুজনকে কোলে নিয়ে তিনু আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। মায়ের এই আদর পাওয়ার সৌভাগ্য ওদের কমই হয়। অতিরিক্ত আবদার করার সুযোগ একেবারেই নেই ওদের। আজ এই অনাকাঙ্ক্ষিত আদর পেয়ে মায়ের আঁচলের নিচে নেতিয়ে যায় বাচ্চাগুলো।
আম্মা তিনু আর তাদের মেয়েদের কাণ্ড দেখে হাসেন, প্রশ্রয়ের হাসি, গর্বের হাসি।