2

হার না মানা ড. জেবউননেছা’র গল্প

Share

 ড. জেবউননেছা

মানুষের জীবনের প্রতিটি দিন এক একটি গল্প। এই গল্প লিখে শেষ করা যায়না। আমার এ জীবনে যেমন ঝড় এসেছে, এসেছে বৃষ্টিও । এক চিলতে রোদের আশায় সংগ্রাম করেছি,করে যাচ্ছি। একাগ্র চেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় অর্জন করি প্রথম শ্রেণী। পুরোটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কেউ হাত বাড়িয়ে দেয়নি দুটি পরামর্শ দিয়ে। জীবন চলার পথ কেউ বাতলে দেয়নি। বাবা মায়ের দেখানো পথ ধরে চলেছি।

১৩ মে ২০০৪  তারিখে এমএসএস পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়। ৫,৮৪০ দিনের জীবনের যুদ্ধের গল্পের শুরুটা সেদিন থেকেই। সেদিন ছিল আমার গায়ে হলুদ। আব্বু আম্মুর একমাত্র কন্যা সন্তান তাই বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যয় করতে কোন কার্পণ্যই তারা করেননি। নতুন জীবনে প্রবেশ করার সাত দিন পর ইউএনডিপি এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ফর জেন্ডার মেইস্ট্রিমিং’ প্রকল্পে চাকরি হয়। এই প্রকল্পে আমার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন, অষ্ট্রেলিয়ান একজন নারী, অধ্যাপক ড. শার্লি র‌্যান্ডেল। তাঁর সাথে আমি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘুরে বেড়িয়েছি। তাঁকে দেখেছি কিভাবে সময়কে কাজে লাগাতে হয়। এই প্রকল্পে দেশি বিদেশি অনেক প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির সান্নিধ্য গ্রহণের সুযোগ হয়।

ইউএনডিপিতে চাকরির তেরো মাসের সময় ঢাকার ইস্কাটনের বিয়াম মডেল স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। ফাঁকে ফাঁকে বিসিএস পরীক্ষার জন্যও প্রস্তুতি নেই। পাশাপশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ খান ম্যাডামের তত্ত্বাবধানে এমফিলে ভর্তি হই। একদিকে শিক্ষকতা,অন্যদিকে এমফিলের প্রথম বর্ষের ক্লাস সবই মন দিয়ে করি। এই সময়ের মধ্যে হয়ে পড়ি সন্তান সম্ভবা। ২০০৬ সালে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে চাকরির সুযোগ হয়। বিয়ামের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি। বাসা নিই মতিঝিলে। আমার অফিস সাভারে আর স্বামীর ব্যবসা মতিঝিল। তাই আমিই দূর থেকে আসা যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম।

একদিকে এমফিলের পরীক্ষা ঘনিয়ে আসে অন্যদিকে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের কঠোর নিয়ম-নীতি। অপরদিকে আবার গর্ভে সন্তানের বয়স বাড়ছিলো। তবুও হার মানিনি এই জীবনযুদ্ধে। অন্তসত্ত্বা অবস্থাতেই আবার ঢাকার বাইরে এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির জন্য কয়েকবার করে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য গিয়েছিলাম। বিশ্বাস ছিল অভিজ্ঞতা, মেধার মূল্যায়ন হবে। কিন্ত সে যাত্রায় হয়নি। আমার অপরাধ ছিল আমি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের পরিবারের সন্তান। আমাকে পিছন থেকে ঠেলে দেবারও কেউ ছিলনা বরং কিভাবে আরো পিছিয়ে যেতে পারি সে ষড়যন্ত্র করেছে কিছু কিছু মানুষ,সবাই নয়। কিন্তু আমি আমার সততা থেকে একচুলও পিছ পা হইনি। 

গর্ভবতী অবস্থার শেষ দিকে এমফিল পরীক্ষায় অবতীর্ণ হই। এর মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল ৮.৩০টায় উপস্থিত হবার কঠোর বাধ্যবাধকতা আর ছুটি বেলা ৪টায় । সহকর্মীদের বুঝতেই দেইনি আমি মা হতে চলেছি। কিন্ত সময়ের প্রেক্ষিতে তারা একসময় বুঝতে পারে। তবে এই অজুহাতে কোনদিন দেরি করে যাইনি, তাড়াতাড়ি ফিরিনি। সকাল ৬.৩০টার মধ্যে স্বামীর খাবার, নিজের খাবার তৈরি করে বের হয়ে যেতাম,বাসায় ফিরতাম ৬.৩০ টায়। সাভার থেকে মতিঝিলের বাসায় ফেরার পর পায়ে পানি নেমে পা ফুলে যেতো।

এর মধ্যেই বিসিএস লিখিত পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসে। অতঃপর মৌখিক পরীক্ষায় ভালোভাবে অংশগ্রহণ করেও নিরাশ হই। পাশাপাশি ঘনিয়ে আসে সন্তান জন্মদানের সময়ও। সন্তান জন্মের ২৪ দিন পূর্বে বিনা বেতনে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে এক পুত্র সন্তানের মা হই। কিন্তু বাচ্চাকে দেখাশোনা করার মতোন কেউ নেই, কারণ আমার শ্বশুরবাড়ি চাপাইনবাবগঞ্জ। শাশুড়ি মারা গিয়েছেন ১৯৯১ সালে। সবাই যে যার মতো। নিরুপায় হয়ে তিন মাস সাতদিন পর আমার সন্তানকে রেখে আসি নারায়ণগঞ্জে মায়ের কাছে। প্রতি বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জ যেতাম শুক্রবার ফিরতাম।

 এই সময়ের মধ্যে এমফিলের গবেষণাপত্র জমা দেয়ার সময় চলে আসে। কিন্ত সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। তত্ত্বাবধায়ক শাহনাজ খান ম্যাডাম ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ম্যাডাম বললেন, তত্ত্বাবধান করতে পারবেননা। আমি দিশেহারা হয়ে বিভাগের শিক্ষকবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করলাম। কিন্ত কারো কাছ থেকে তেমন সাড়া পেলামনা। অবশেষে বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোহাব্বত খান স্যার শাহনাজ খান ম্যাডামের অনুরোধে তত্ত্বাবধানের জন্য সম্মত হন। বাবার বাড়ি থেকে কম্পিউটার নিয়ে আসি গবেষণাপত্রটি লেখার জন্য। ভাগ্যের পরিহাস,কম্পিউটারটি নষ্ট হয়ে যায়। পরে এক দোকানে বসে বসে লিখে গবেষণাপত্রটি জমা দেই।

এই সময় নারায়ণগঞ্জে আম্মুর কাছেই ছেলে আসির বড় হতে থাকে। সে কখন কথা বলছে, কি করছে কিছুই অনুভব করতে পারিনা। কত রাত যে বালিশে মুখ গুজে কেঁদেছি। তা জীবনসঙ্গীকে বুঝতে দেইনি। বিভিন্ন জায়গায় দরখাস্ত করি কোথাও সরকারি চাকরি হয়না। মনে পড়ে, এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য আবেদন করেছিলাম, মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে জিজ্ঞেস করেছিল কেন শিক্ষকতায় আসতে চাই। আমি বলেছিলাম, এই পেশাটি নারীদের জন্য সম্মানজনক। তখন বোর্ডের প্রধান বলেছিলেন,আমরা কি তোমার জন্য চ্যারিটি নিয়ে বসেছি। আমি নিরাশ হয়ে ফিরে আসি।

কিছুদিনের মধ্যে আমার জীবনের শুভ সূচনা হয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটিরী কমিশনে সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) পদে চাকরি হয়। এই সময়ের মধ্যে আব্বু-আম্মুকে অনুরোধ করলাম ঢাকায় আসার জন্য এবং তারা আমার জন্য নারায়ণগঞ্জের মায়া ত্যাগ করে ঢাকায় আসেন। ছোট ভাই জাবের বিন জালালকে ঢাকার সেন্ট জোশেফ কলেজে ভর্তি করিয়ে দেই। আব্বু আম্মু যখন ঢাকায় এলেন, তখন আসিরের বয়স আড়াই বছরের উপরে। এখানেও নানা জটিলতা। আম্মুকে অনেকে প্রশ্ন করত, মেয়ের সাথে থাকেন ? আমার মা উত্তর দিতেন,মেয়ে আমার সাথে থাকে। ইতিমধ্যে পিএইচডি গবেষণার জন্য ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোহাব্বত খান স্যারের তত্ত্বাবধানে ভর্তি হই। ভর্তি হবার কিছুদিনের মধ্যে জাপানেও পিএইচডি গবেষণা করার সুযোগ পাই। কিন্তু আসির ছোট ছিল বলে যেতে পারিনি।

এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে প্রভাষক পদে চাকরি হয়। এখানেও পড়েছি ষড়যন্ত্রে। প্রথমবার দরখাস্ত করেও প্রাক্তন দু’জন সহকর্মীর ষড়যন্ত্রের কারণে দরখাস্ত তুলে নিতে বাধ্য হই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার অফিসের টিচিং শাখার কর্মকর্তাবৃন্দ এই ঘটনার স্বাক্ষী। পরবর্তীতে পুনরায় মৌখিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে আল্লাহর অশেষ রহমতে শিক্ষকতার সুযোগ পাই। এরপর থেকে আমার স্বপ্নের দ্বার নিজে নিজে আলাদীনের প্রদীপের মত জ্ব¦লতে শুরু করে। জীবনসঙ্গী ব্যবসা বাণিজ্যে অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করতে থাকে। নিজেদের জন্য গাড়ী কেনা হয় এবং ফ্ল্যাট কেনা হয়। ২০১০ সালে আমি চলে আসি আমার ফ্ল্যাটে। কিন্ত যতক্ষণ বাসায় না ফিরতাম, ততক্ষণ আব্বু আসিরকে দেখাশোনা করতেন এবং স্কুল থেকে আনা নেওয়া করতেন। আমি ফেরার পর আব্বু চলে যেতেন।

জাহাঙ্গীরনগরে শিক্ষকতার পাশাপাশি পিএইচডি গবেষণার দুটি সেমিনার উপস্থাপনা করে গবেষণা প্রায় শেষের দিকে যখন চলে এসেছিল, তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোহাব্বত খান স্যার আমার গবেষণাপত্রটি মূল্যায়ন কমিটি বিভাগে জমা দেন। কিন্তু বাধ সাধে অন্য জায়গায়। তত্ত্বাবধায়ককে না জিজ্ঞেস করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করে মনগড়া গবেষণাপত্র মূল্যায়ন কমিটি ( কমিটির কপি আমার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে) গঠন করে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডীন অফিসে কমিটি প্রেরিত করে। বিষয়টি জানতে পেরে সমাজ বিজ্ঞান অনুষদে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন সহ ডীন বরাবর আবেদন করি (আবেদনপত্রের কপি আমার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে)।

 দীর্ঘ এক বছরে প্রশাসনিক সমস্যার সমাধান না হওয়ায় অনেকটা জেদের বশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি পিএইচডি গবেষক হিসেবে ভর্তি বাতিলের জন্য (এই আবেদনপত্রের কপিটিও আমার কাছে আছে)। মাঝখান দিয়ে হারিয়ে যায় আমার জীবন থেকে বেশ কয়েকটি বছর। আমি হতাশ হয়ে যাই। কি করব এই ভেবে। এর মধ্যে ল্যাপটপের হার্ডডিস্ক নষ্ট হয়ে যায়। কোন ধরনের ব্যাকআপ না থাকায় পূর্ববর্তী গবেষণাপত্রটিও হারিয়ে যায়। সেই হার্ডডিস্ক বাংলাদেশে ব্যাকআপ বের করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমার স্বামী থাইল্যান্ডের বিশ্বখ্যাত কোম্পানি আইডিআর ল্যাবে নিয়ে যায়। কিন্ত কোনভাবেই কোন ডকুমেন্ট উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সেই কোম্পানি থেকে প্রেরিত ইমেইলটি এখনো সংরক্ষিত আছে আমার ইমেইলে। আসলে আমিই বোকামি করেছিলাম কোন ধরনের ব্যাকআপ না রেখে।

যাই হোক তখন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোহাব্বত খান স্যার পরামর্শ দিলেন ভারতে পিএইচডি গবেষণা করার জন্য। সে লক্ষ্যে স্যার যোগসূত্র ঘটিয়ে দিলেন ভারতের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান ড. রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য স্যারের সাথে। শুরু হলো যোগাযোগ রবিন স্যারের সাথে। একটার পর একটা নতুন নিয়মের সাথে পরিচিত হতে লাগলাম। ভিসার জন্য আবেদন, কাগজপত্র সংগ্রহ করা। ভিসা অফিসে জমা দেয়া সবই করতে থাকলাম। বৃত্তির জন্য আবেদন করার সুযোগ এবং যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আবেদন করিনি। কারণ, আমি মনে করেছি নিজ খরচে গবেষণাটি করলে এক ধরনের স্বাধীনতা থাকবে। তখনকার সময়ে ভিসা প্রক্রিয়া খুব জটিল বিষয় ছিল। কিন্ত ভিসা প্রক্রিয়ার আগে ভারতের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষক হিসেবে ভর্তি হবার প্রক্রিয়াটি ছিল আরো জটিল। 

প্রথমে গবেষণা প্রস্তাবনা বোর্ড অব রিসার্চ ষ্টাডিজ (বিআরএস) জমা দিতে হয় যেখানে বিভাগের সকল অধ্যাপক উপস্থিত থাকেন গবেষণা প্রস্তাব নিয়ে মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের জন্য। সেই মৌখিক পরীক্ষায় উপাচার্যের সুপারিশের ভিত্তিতে দু’জন শিক্ষক সদস্য হিসেবে উপস্থিত থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ থাকেন। আমার বোর্ড অব রিসার্চ ষ্টাডিজের সভা সভাপতিত্ব করেছেন উপাচার্য,কারণ তখন ডীন ছিলেন না। এরপর বোর্ড অব রিসার্চ গবেষণা প্রস্তাবটি প্রেরিত হয় ফ্যাকাল্টি অব কাউন্সিলে, যেখানে কলা অনুষদের সকল অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান উপস্থিত থাকেন। সভাপতিত্ব করেন ফ্যাকাল্টি অব কাউন্সিলের সচিব। সেখান থেকে গবেষণা প্রস্তাবনা অনুমোদিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষক হিসেবে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যায়। এসকল নিয়মনীতি পালন করে পিএইচডি গবেষক হিসেবে ভর্তি হলাম। যে যাত্রা শুরু করেছিলাম  ২০০৯ সালে সেই যাত্রার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাই ২০১৭ সালে। অর্জন করি পিএইচডি ডিগ্রী।

এরপর ২০২১ সালে ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া পার্লিস থেকে ‘স্কুল অব বিজনেস ইনোভেশন এন্ড টেকনোপ্রোনারশীপ’ এ পোষ্ট ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করি। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক। এছাড়াও ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের অতিরিক্ত পরিচালক এবং মহামান্য হাইকোর্ট নির্দেশিত ‘যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগ কমিটি’ এর আহবায়ক।

অন্তবর্তীকালীন সময়ের মধ্যে গবেষণার কাজে যখন যেতাম তখন জীবনসঙ্গীও সঙ্গ দিতো। আর আসিরকে সঙ্গ দিতেন আব্বু আম্মু । আসির দেশের নামকরা স্কুল মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ইংরেজী ভার্সনে পড়ার সুযোগ পায় (এখন সে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে পড়ছে)। এবার আব্বু আম্মু তাদের নিজ নিবাসে ফিরে যেতে চান এবং আসিরের আট বছর বয়সের সময় আব্বু আম্মু নারায়ণগঞ্জে চলে যান। শুরু হয় আব্বু আম্মু ছাড়া আরেক নতুন যুদ্ধ। গত পাঁচ বছরে আব্বু আম্মুকে ছাড়া আছি তবু এত প্রতিকূলতার মাঝেও শিক্ষার্থীদের ক্লাস  নিতে কোন দিন দেরি করে যাইনি। বিভাগের কোন কাজে ফাঁকি দেইনি। বিভাগের সকল শিক্ষা সফরের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সরব থেকেছি। 

বিভাগীয় ছাত্র কল্যাণ উপদেষ্টা পদেও দায়িত্ব পালন করেছি। ২০১৭ সালে আসির যখন ঢাকা রেসিডেন্সিয়ালে ভর্তি হলো তাকে  প্রথমদিন স্কুলে নিয়ে যেতে পারিনি। আসিরকে আব্বু-আম্মুর কাছে দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গিয়েছিলাম শিক্ষা সফরে খাগড়াছড়ি। মুঠোফোনে আম্মু কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান ,স্কুলে বল লেগে আসিরের চোখের কর্নিয়া ফেটে গিয়েছে। সেদিন বাধ মানেনি আমার কান্না। আজ পর্যন্তও আব্বু ঐ তারিখে ডায়েরীর পাতায় কিছু লিখতে পারেননি। বাসায় ফিরে দেখি আসিরের চোখে ব্যান্ডেজ। এর আগে আসিরের পাঁচ বছর বয়সের সময় আসিরকে রেখে শিক্ষার্থীবৃন্দদের নিয়ে ভারতে শিক্ষা সফর করি এবং সেখানে নিজ উদ্যোগে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় সফর করি।

২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে বিভাগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলাম। শত বাঁধা পেরিয়ে আমার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে সেই সময় বিভাগের দায়িত্ব পালন করেছি। উক্ত দায়িত্ব পালন সময়ের সকল ঘটনা মনের মনিকোঠায় সংরক্ষিত করে রেখেছি। পরে সেই স্মৃতিগুলো লিখব বলে পরিকল্পনা রয়েছে। বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।

শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের সাথেও যুক্ত আছি। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ,বাংলা একাডেমি, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ,বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র, ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলামনাই এসোসিয়েশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোকেয়া হল এলামনাই এসোসিয়েশন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি পাবলিক এডমিনিষ্ট্রেশন এ্যালামনাই এসোসিয়েশন, চয়ন সাহিত্য ক্লাব, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ,বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, পেশাজীবী নারী সমাজ, ভারতে শিক্ষালাভকারী শিক্ষার্থী সংগঠন, ই-গভর্ন্যান্স প্লাটফর্ম ফর এ্যাকশন এর আহবায়ক, ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ এর নেটওয়ার্ক শিক্ষক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মাদক বিরোধী সচেতন ছাত্র সমাজ এবং জেইড স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন অব নারায়ণগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত অভিযোগ কমিটির বহিস্থ সদস্য। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ও বাংলাপিডিয়ার একজন নিবন্ধক হিসেবে আছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন কর্তৃক প্রকাশিক ‘যাত্রিক’ প্রকাশনার সম্পাদনা পরিষদের সদস্য এবং ‘উত্তরন’ পত্রিকায় প্রদায়কের দায়িত্বে পালন করছি। অস্ট্রেলিয়ান একাডেমি ফর বিজনেস লীডারলীপের একজন ফেলো সদস্য। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ এথিক্যাল কমিটির একজন সদস্য হিসেবেও কাজ করছি।

লেখালেখির সাথে জড়িত আছি বলতে গেলে ছোটবেলা থেকেই। বিভিন্ন বিষয়ে আমার লেখা ১৩ টি গ্রন্থ প্রকাশনা করেছি। এখন বেশ কয়েকটি গ্রন্থের কাজ এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ থেকে প্রকাশিত তিনটি গ্রন্থের সম্পাদনা পরিষদের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছি। এছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও জার্নালে লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত আছি। আমি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

অর্জন করেছি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঢাকা বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ জয়িতা , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোকেয়া হল স্বর্ণপদক, ‘চত্বর’ সাহিত্য পদক, এম এ কুদ্দুস শ্রেষ্ঠ শিক্ষয়িত্রী পদক,মৃত্তিকা পদক, বিনোদনধারা পারফরম্যান্স এ্যাওয়ার্ড, আমরা কুঁড়ি পদক, বঙ্গবীর ওসমানী স্মৃতি পুরষ্কার, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক পরিষদ, নক্ষত্র সাহিত্য পদক, অক্ষর সম্মাননা এবং জাতীয় সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা।

এই বিশাল যজ্ঞে আমার ক্যারিয়ার গড়ার সকল দুঃখ যন্ত্রণার স্বাক্ষী জীবনসঙ্গী মোঃ মবিন উদ্দিন। তিনি পুরোটা সময় আমার ক্যারিয়ার গড়ার জন্য মানসিক সমর্থন দিয়ে গেছেন। পিএইচডি গবেষণার সময় ব্যবসা বাণিজ্য ফেলে আমাকে নিয়ে ভারতে গেছেন। আমার দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তা করেছেন আর আমার হাসিতে হেসেছেন। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। আর আব্বু আম্মুর ঋণ শোধ করার মত নয়। আমার একমাত্র সন্তান আসিরও এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। সে এখন দশম শ্রেনির শিক্ষার্থী, ক্ষুদে লেখক এবং গীটার বাদক। সাহস যুগিয়েছেন শিক্ষাগুরু অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোহাব্বত খান স্যার।

দিনশেষে জীবন নিয়ে আমার অনুভূতির পাল্লাটি অনেক ভারী। বাবা মায়ের আদরের সন্তান ছিলাম । দাদু বাড়ি,নানু বাড়ির আদরের মধ্যমণি ছিলাম। শ্বশুরবাড়ির কনিষ্ঠ ছেলে বউ তাই সেখানেও আদরের কমতি নেই। কিন্ত ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে যে কষ্ট স্বীকার করেছি তা আমার ফেলে আসা সোনালী শৈশবের স্মৃতিগুলোকে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছিল। পদে পদে বাঁধা এসেছে, প্রতিহিংসার শিকার হয়েছি,পিছন থেকে ঠেলে দেবার কেউ ছিলনা, পারলে কেউ কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনভাবে ষড়যন্ত্র করেছে যেন আর শিরদাঁড়া করে দাঁড়াতে না পারি। কিন্ত আমার অদম্য ইচ্ছাশক্তি,সততা আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবার পথে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

 আমার প্রতিজ্ঞা ছিল, সফলতার জন্য সৎভাবে পরিশ্রম করে যাব এবং হার মানবনা। পাহাড় সমান বাধা এসেছে, সে পাহাড় ডিঙিয়েছি। লেখাটি যখন লিখছি চোখের মাঝে ভাসছে কত স্মৃতি, কত সংগ্রাম, প্রতিকূলতা। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর গুরুজনের আশীর্বাদ আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে স্বপ্নপূরণের দিকে। হাজার প্রতিকূলতা পেরিয়ে, সবকিছু ছাড়িয়ে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে পৌঁছার জন্য এখনো যুদ্ধ করে যাচ্ছি। শিক্ষাজীবনে আমার পরিচয় ছিল ‘জেবউননেছা’ নামে। আজ আমি ‘ড. জেবউননেছা’ হতে পেরেছি, শ্রদ্ধাভাজন বাবা মায়ের অনুপ্রেরণা এবং সবার দোয়া – ভালোবাসায়।

মনীষী থিউডোর জেলডিন বলেছেন,‘স্বপ্ন দেখতে জানলে জীবনের কাঁটাগুলোও ধরা দেয় গোলাপ হয়ে’। সত্যিই আমার জীবনের পথে পথে কাঁটা বিছানো ছিল, সে কাঁটা বেছে আজ আমি গোলাপ হাতে নিয়েছি। আম্মু একটি কথা সবসময় বলতেন,‘ধৈর্য ধরো,জীবনে অনেক সময় আছে আনন্দ উপভোগ করার । এখন লেখাপড়া করো’। সেই কথাটি ছিল আমার জীবনের মূলমন্ত্র। এই মূলমন্ত্রের সূত্র ধরে আজ যখন মিলাতে যাই,তখন দেখি সত্যি আমার চারপাশে আজ কিছুর অভাব নেই। শুধু প্রাপ্তি আর প্রাপ্তি। তবুও মনে হয় পথ আরো অনেক বাকি আছে । আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। ‘যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ’ আমি এই নীতিতে বিশ্বাসী। যে পরিবারের বড় হয়েছিলাম সে পরিবার আমাকে কন্যা নয়, মানুষ হিসেবে বড় করে তুলেছেন। তাইতো যে বাড়ীতে বেড়ে উঠেছিলাম সে বাড়িটিকে আব্বু আমাদের চারভাইবোনকে সমান অংশ দিতে কুন্ঠাবোধ করেননি।

তবে, জীবনের এই প্রান্তে এসে আমার প্রতিজ্ঞা কোন অশুভ শক্তি যদি সমাজকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় ,আমি তার বিরুদ্ধে রুদ্রমূর্তি হয়ে দাঁড়ানোর মানসিক ক্ষমতা অর্জন করেছি, আমি সততা দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছি। আগামীতে আমার এই সততাই হবে আমার শক্তি। সমাজের অন্যায়কারী,মিথ্যাবাদী,দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান আজীবন একরকমই থাকবে। আমি অন্যায়ের কাছে হার মানিনি আর কখনও মানবওনা। যতদিন বেঁচে থাকব সত্য ও সুন্দরের পথে সমাজকে আমার মাধ্যমে যতটুকু পথ দেখানো যায় ততটুকুই দেখাব ইনশাআল্লাহ।

ড. জেবউননেছা, অধ্যাপক ও প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, লোক প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়