নিবেদিতা দাস
অন্য সঙ্গীরা যে বয়সে পুতুল খেলতে ভালোবাসে, ঠিক সেই বয়সেই আমার নেশা চেপে বসে সাঁতারের। বাড়ির পাশের পুকুরে যখন রাজবাড়ী সাঁতারুদের অনুশীলন চলত তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম তন্ময় হয়ে। সেই থেকে একটা ভালোলাগা শুরু হয় সাঁতারের প্রতি। সাঁতারের সাথে আমার সম্পর্ক ক্লাস ফোরে পড়ার সময় থেকেই। আমাদের বাড়ি রাজবাড়ির দক্ষিণ ভবানীপুরে। স্টেডিয়ামের পাশে বাসা হওয়ায় বলতে গেলে একরকম খেলাধুলার আবহেই বড় হয়েছি। সাঁতারের প্রতি আমার আগ্রহ দেখে একদিন প্রশিক্ষক কৃষ্ণা বসু বললেন, “তুমি প্রতিদিন এসে ওদের প্র্যাকটিস দেখছ তাহলে তুমিও চলে আস কাল থেকে তোমাকেও সাঁতার শেখাবো”। আমি খুব সহজেই রাজি হয়ে যাই। আমার পরিবারও তখন আমাকে সাপোর্ট করে। তাই দেরি না করে পরেরদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় আমার সাঁতারে প্রশিক্ষণ নেয়ার কাজ। তখনই সঙ্গী সাথীদের পেছনে ফেলে আমি পৌঁছে যেতাম পুকুরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
এর কিছুদিন পরেই জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতারে আমাকে ৫০ মিটার ব্যাক স্ট্রোক সাঁতারের প্রতিযোগী করা হয়। ছোট বলে প্রথমে আমাকে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে দেয়া হচ্ছিল না। কিন্তু পরে দেখা গেল ওই প্রতিযোগিতায় একটি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে একটিতেই প্রথম হয়ে জাতীয়ভাবে রানার্সআপ পুরস্কার জিতে নিই। এর পর শুধুই এগিয়ে যাওয়ার পালা। প্রতিবছরই দুই তিনটি করে স্বর্ণপদক আমার ঝুলিতে যোগ হতে থাকে। ১৯৯৫ সালে এক বছরেই নয়টি স্বর্ণপদক অর্জন করি। এর মধ্যে ছয়টিতেই জাতীয় রেকর্ড গড়ে সেরা সাঁতারু নির্বাচিত হই। এটা আমার জীবনের অন্যতম একটি স্মরণীয় ঘটনা।
তবে বড় হয়ে সাঁতারুই হবো এমন চিন্তাভাবনা কখনো ছিলনা বরং চেয়েছি সবার আগে পড়াশোনাটা ঠিকমতো চালিয়ে যাব। আর অসম্ভব ভালোলাগার সাঁতারটাও থাকবে পাশাপাশি। তবে সাঁতারের প্রতি এই ভালোবাসাটাই একসময় আমাকে এনে দিয়েছে পরিচিতি ও খ্যাতি। একসময় রাজবাড়িতে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে।
১৯৯৭ সালে ১৭তম জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অংশগ্রহণ করে চারটি স্বর্ণ এবং দুটি রৌপ্য পদক সহ দ্রুততম মানবী হওয়ার গৌরব অর্জন করি। আমার একার এই সাফল্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলগত ভাবে সেদিন তৃতীয় স্হান অধিকার করে। খেলাধুলায় অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে শামসুন্নাহার হল রজতজয়ন্তীর স্বর্ণপদক পেয়েছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। এছাড়াও ২০০১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়াক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মান “ব্লু” অ্যাওয়ার্ড অর্জন করি। এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে একসঙ্গে কেউ জাতীয় পর্যায়ে এত পদক অর্জন করতে পারেনি আমার জানামতে।
সবাই বলতো ঝুলিভর্তি সোনালি কাব্য। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এই দশ বছরে মোট পদকের সংখ্যা ৭৮ টি। জাতীয় পর্যায়ে সাঁতার প্রতিযোগিতায় ৪৮ টি স্বর্ণপদক,নয়টি রৌপ্য ও দুটি ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করি। ১৯৯৭ সালে ইরানে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ইসলামিক মহিলা গেমসে রৌপ্য পদক অর্জন করি। একই বছর ভারতের মুর্শিদাবাদে ৫৪ তম বিশ্ব দূরপাল্লা সাঁতারে ভাগীরথী নদীতে ১৯কিলোমিটার ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে সফলতার সাথে শেষ করি। ১৯৯৭ সালেই বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি কর্তৃক সেরা সাঁতারু অ্র্যাওয়ার্ডটি যুক্ত হয় আমার ঝুলিতে ।
রাজবাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে সাঁতারের জন্য ছুটে বেরিয়েছি বিশ্বের নানা প্রান্তরে। এরপর পড়াশোনার জন্য বেশ খানেকটা সময় বিরতি নিতে হয়। তখন সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। আর সাঁতারের সাথে আমার ক্লাসের রুটিন মিলছিল না। তাই মনে হলো এবার একটু পড়াশোনার দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ এবং এই ক্যাম্পাসই হয়ে ওঠে আমার প্রাণের ঠিকানা। তবে এর মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তহল , আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এথলেটিকস ,হ্যান্ডবল ,ভলিবল খেলায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছি। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম বাংলাদেশ গেমস ভলিবল প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় স্হান অধিকার করে। আমি সেই টিমের একজন খেলোয়াড় ছিলাম।
পড়াশোনা শেষ করে ২০০৫ সালে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা পদে পাঁচ বছর চাকরি করলেও মন পড়ে থাকতো খেলাধুলার প্রতি। এই ভালোবাসার টানেই পরবর্তীতে ২০১০সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর পদে যোগদান করি। এছাড়াও বিভিন্ন সময় ঢাকা ক্লাব,গুলশান ক্লাব, ক্লাব আমাজন সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুইমিং কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। বর্তমানে চাকরির পাশাপাশি সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ,বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের অধীনে মহিলা ভলিবল উপকমিটির সম্পাদিকা এবং ঢাকা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
২০১৪ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ওমেনস স্পোর্টস লিডারশীপ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করি। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক সাঁতার সংস্থা (FINA) আয়োজিত “সুইমিং ফর অল সুইমিং ফর লাইফ” প্রোগ্রামে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ অর্জন করি। ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ জাতীয় সাঁতার দলের টিম অফিসিয়াল হিসেবে দায়িত্ব পালন করি । ২০১৯ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত “বঙ্গমাতা এশিয়ান সেন্ট্রাল জোন ওমেনস ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপ” এ জাতীয় মহিলা ভলিবল দলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
২০১৯ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত ১৩ তম সাফ গেমস এ জাতীয় মহিলা ভলিবল দলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। ২০২১ সালে “গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ” নামে খ্যাত বিশ্বের সর্ব বৃহৎ খেলার আসর জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমস “টোকিও ২০২০”এ বাংলাদেশ জাতীয় সাঁতার দলের কোচ হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছি ।২০২২ সালে ক্রীড়া ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ সম্মান “জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার” ক্রীড়াবিদ সাঁতার (২০১৮) অর্জন করি । গত ১ নভেম্বর উজবেকিস্তানে সুইমিং রেফারি কোর্সে অংশগ্রহণ করেছি। উক্ত প্রশিক্ষণে রেফারি (সাঁতার) হিসেবে বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করতে পেরে বেশ ভাল লেগেছে।
এই যে এত অর্জন, এতো সফলতা এর শুরুর পথটা আজ থেকে ৩০ বছর আগে এতোটা মসৃণ ছিলনা। যদিও এখন মেয়েদের খেলাধুলার পরিবেশটা অনেকটাই সহজ হয়েছে। আমাদের সময় মেয়েরা পারবে কিনা এই একটা প্রশ্ন ছিল সবার মাঝে। সেখানে নিজেকে যোগ্যতার প্রমাণ করে এ পর্যন্ত আসতে হয়েছে। যদিও আমার পাশে বাবা, বড় ভাইরা এবং রাজবাড়ী জেলার কিছু শুভাকাঙ্খী ছিলেন। তাদের উৎসাহ আমাকে এ পর্যায়ে আসতে সহযোগিতা করেছে।
এই প্রজন্মের মেয়েরা যাতে প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে সাঁতারে আসার সুযোগ পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে সংগঠক হিসেবে সুইমিং ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটিতেও কাজ করছি। একজন সংগঠক হিসেবে নারীদের খেলাধুলাকে এগিয়ে নিতে চাই। এ কাজে আনন্দ খুঁজে পাই আমি। আমি চাই বাংলাদেশের মেয়েরা সাঁতার সহ অন্যান্য খেলাধুলায় অনেক দূর এগিয়ে যাবে। আমি স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের মেয়েরা একদিন ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিবে।
একইভাবে স্বপ্ন দেখি সাঁতার না জানার কারণে আর একটি প্রাণও যেন পানিতে ডুবে মারা না যায়। দেশে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ বিষয়ক কমিটিতে কাজ করছি তাই দেশে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার কমবে সেই প্রত্যাশাও রাখি এবং স্বপ্ন দেখি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই একটি বিষয়ে সরকারিভাবে পদক্ষেপ নিলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার অনেকাংশে লাঘব হবে বলে বিশ্বাস করি। তাই আহ্বান জানাই সবাইকে নিজে সাঁতার শিখুন এবং পরিবারের সবাইকে সাঁতার শেখার সুযোগ করে দিন।
নিবেদিতা দাস, সাঁতারু/ সহকারী পরিচালক (শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়