স্বপ্না চাকমা
রাঙামাটি পাহাড়ের উঁচু-নীচু রাস্তায় দৌড়ে খেলে বড় হয়েছি। ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা করব কিন্তু পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় চাষাবাদ করা একজন বাবার পক্ষে মেয়েকে শহরে রেখে পড়াশোনা করানোটা একটু কঠিনই ছিল। কেননা দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে শহরে গিয়ে উপার্জন করাটা এতোটা সহজ নয়। বাবা-মায়ের অভাব অনটনের সংসারে আমাকে এসএসসির পরেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। এদিকে বিয়ের পর দেখি স্বামীর সংসারেও টানাপোড়েন। এটা ২০০৩ সালের কথা। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, কি করে সংসারে একটু স্বচ্ছলতা আনা যায়। তখন আমার হাতে দেড়শো টাকা ছিল, সেই টাকা দিয়ে নাইলন সুতা কিনে কিছু ব্যাগ বানাই। সেগুলো আমাদের বাড়ির পাশেই এক দোকানে বিক্রি করে এক হাজার টাকার মতোন পাই। ততোদিনে আমার পেটে সন্তান আসায় বন্ধ করে দিতে হয় ব্যাগ বানানোর কাজ। তবে সেই এক হাজার টাকা দিয়ে তখন দু’শ সেগুন গাছের চারা কিনে আমার শ্বশুর বাড়িতে রোপন করি। একটা চারা গাছের দাম ছিল তখন এক টাকা। এই গাছগুলোর বয়স এবং আমার সন্তানের বয়স এখন আঠারো বছর। আর একটা গাছের দাম এখন পাঁচ হাজার টাকা।

সময়ের পরিক্রমায় একটি ছেলে সন্তান জন্ম হলো। সে ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো। ছেলেকে স্কুলে আনা-নেয়া এবং সংসারের কাজ এ নিয়েই আমার দিন কেটে যাচ্ছিল। সে সময় কাজ করাটা আমার স্বামীও খুব একটা পছন্দ করতেন না। তিনিও চাইতেন, আমি যেন বাচ্চার পেছনে বেশি সময় দিই। তাই তখন আমিও আর বাড়তি কিছু করার চিন্তা করিনি। একসময় ছেলে যখন একটু বড় হয়ে একা একাই স্কুলে যাওয়া শুরু করল, বুঝতে শিখল অনেক কিছু, তখন আবার আমি নিজের কাজে ফেরার চিন্তা করলাম। কারণ নিজে একটা কিছু করার, স্বাবলম্বী হওয়ার সুপ্ত ইচ্ছাটা সবসময়ই ছিল মনে। পড়াশোনা বেশিদূর করতে পারিনি কিন্তু অন্যভাবেও তো স্বাবলম্বী হতে পারি, আমি এভাবেই চিন্তা করেছি। যে ভাবনা সেই কাজ, এবার আমার হাতে পুঁজি দু’শ টাকা। এই টাকা দিয়ে প্লাস্টিকের বেত কিনে এনে একটা ব্যাগ বানাই এবং এটা তিনশো টাকায় বিক্রি করি। এরপর তিনশো টাকার বেত কিনে আরো কয়েকটা ব্যাগ বানিয়ে বিক্রি করি। এরকম করে যত টাকা বিক্রি থেকে আসে সেই টাকা দিয়ে আরো ব্যাগ বানিয়ে বিক্রি করতে থাকি। এভাবেই আমার হাতে জমা হয় তিন হাজার টাকা।

আমি কাজগুলো করতাম সংসারের সকল কাজ সামলে, তারপর। স্বামী অফিসে যাওয়ার পর আমি কাজে বসতাম। আমার যেহেতু্ একটা জেদ ছিল কিছু করার, তাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি যেভাবেই হোক আমাকে এগিয়ে যেতেই হবে। আমার ভাইবোনেরা অবশ্য আমার কাজে উৎসাহ দিত এবং তারা আমার স্বামীকে বুঝাতো যে, ‘কাজ তো সংসারের স্বচ্ছলতার জন্যই করছে’। এভাবে আমার একান্ত চেষ্টায় কাজের পরিধি বাড়তে থাকে। আমার বানানো ব্যাগগুলো বিক্রি করতাম পরিচিত এক দোকানে। তারা আবার অন্য জায়গায় এগুলো বিক্রি করতো। পাশাপাশি তখন কাপড় বোনাও শুরু করলাম।
এর মধ্যেই চলে আসে করোনা মহামারি। দোকানিরা আর আমার ব্যাগ, কাপড় নিতে চায়না। করোনার কারণে তারাও বিক্রি করতে পারেনা বলে আমাকে জানায়। এভাবে ব্যাগগুলো আমার ঘরে পড়ে রইলো। আমি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ি। কিন্তু এই হতাশা আর খানিকটা দু:শ্চিন্তাই আমাকে নতুন পথ বাতলে দেয়। এই মহামারির মধ্যে অনলাইনে ব্যবসা খুব ভাল হচ্ছে এবং যারা এতোদিন কিছু করেনাই তারাও অনলাইনে বসে ভাল ব্যবসা করছে- এমন কথা একটু একটু করে আমার কানেও আসতে শুরু করে। আমি তখন ভাবলাম, আমার যে জিনিসগুলো পড়ে আছে ঘরে সেগুলো আমি যদি অনলাইনে বিক্রি করতে পারি তবে তো ভালই হয়। আমি তখন খোঁজ-খবর নিয়ে ‘হিল ই-কমার্স সোসাইটি’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের কথা জানতে পারি এবং সে গ্রুপে জয়েন করি। এরপর এখানেই আমি আমার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকি।

এই গ্রুপের মাধ্যমে দেশীয় পণ্যের প্রচার করা হয়। আমাদের ঐতিহ্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। আমিও তখন শুধু ব্যাগ আর কাপড় বোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে কাজের পরিধি আরো বাড়াতে শুরু করলাম। এখানে এখন আমি তাঁত বুনন,পাহাড়ের বিভিন্ন রকমের ফল, জুমের হলুদ, বিনি চাল এসব নিয়ে কাজ করে থাকি। গত এক বছরে এখান থেকে আমি বলতে গেলে শূন্য থেকে লাখপতি হয়েছি। যে আমি কাজ শুরু করেছিলাম দেড়শ টাকা দিয়ে সেই আমি আজ লাখপতি। পেয়েছি ‘লাখপতি সেলার শুভেচ্ছা স্মারক’ সম্মাননা। এক সময়ের কিছুই না জানা, না বুঝা সেই আমি এখন অনেক কিছুই জানি এবং বুঝতে পারি। গত এক বছরে এই গ্রুপের মাধ্যমে আমি অনেক কিছু অর্জন করেছি। চেনা-অচেনা অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি, পেয়েছি অনুপ্রেরণাও। বিশেষ করে হিল ই-কমার্স সোসাইটির উদ্যোক্তা মনি পাহাড়ি আপু আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। মনি আপুর সহযোগিতা ছাড়া আমার এতদূর আসা সম্ভব হতোনা।
আর এ সকলই সম্ভব হয়েছে আমার ধৈর্য ধরে কাজে লেগে থাকার কারণে। আমি যখন অনলাইনে কোন পণ্য বিক্রি করি সেই পণ্যটি সম্পর্কে শতভাগ গুণগত মান নিশ্চিত হয়েই পোস্ট করি। আর ক্রেতার কাছে সময়মতো এবং সবচেয়ে ভাল জিনিসটাই দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার ভালোবাসা আমার কর্ম এবং আমার ক্রেতারা। মাঝে মাঝে ডেলিভারির আগে সারারাত জেগেও অর্ডার করা জিনিসটি প্রস্তুত করতে হয় সঠিক সময়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কথায় বলে, সময়ের চাইতে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। আবার সেই জীবনকে ভাল রাখতে সময়ের কাজটা সময়ে করে ফেলতে হয়। এমনকি অসুস্থ শরীর নিয়েও আমি আমার কর্মস্থলে থাকতে বাধ্য থাকি মাঝে মাঝে। হাজারো ব্যস্ত মানুষের ভিড়ে আজ আমিও একজন। ভবিষ্যতে আমি আমার ব্যবসার পরিধি আরো বাড়াতে চাই।

আমাকে দেখে এখন আমার আশেপাশের অনেক মেয়েই পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছে। আমিও তাদেরকে নানাভাবে উৎসাহ দিয়ে থাকি। আমি চাই আমাদের পাহাড়ের প্রতিটা মেয়েই যেন স্বাবলম্বী হয়। আমার জীবন কেবলই আমার। আমার ভাল-মন্দের দায়িত্বটা অন্যের হাতে তুলে দিলে সে আমাকে দুর্বল ভাবতে থাকবে প্রতিটা মুহূর্তে। আর সেকারণেই প্রতিটা মেয়ের স্বাবলম্বী হওয়া উচিত। পাশাপাশি পড়াশোনাটাও যাতে করে সে ব্যাপারেও উৎসাহ দিই সব মেয়েদের। মনে রাখতে হবে কারো কথায় আমাদের থেমে গেলে চলবেনা। নিজের ইতিবাচক ইচ্ছেগুলোকে ডানা মেলে উড়তে দিতে হবে। আমি মনে করি কাজ মানুষের জীবনে কল্যাণ বয়ে আনে, তৈরি করে সুন্দর ভবিষ্যত, জীবনকে করে আলোকিত। কাজে থাকলে মনে প্রশান্তি থাকে এবং দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকা যায়। শরীর, স্বাস্থ্যও সুন্দর থাকে। তাই আমি বলব কর্মব্যস্ত জীবন গড়ুন সুস্বাস্থ্য রক্ষা করুন।
স্বপ্না চাকমা, (উদ্যোক্তা) রাঙামাটি