1

শুরুটা হয়েছিল একজন নারীর আত্মহত্যার দৃশ্য দেখে

Share

  সুলতানা ফারমানা মাফি

ওমিক্রনের নিবিড় আলিঙ্গনে দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হলাম। আমি একা নই।  মা, একমাত্র কন্যা, দুই ছেলে এবং সবচেয়ে কৃতজ্ঞ যার কাছে, যে নাকি আমার ব্যস্তময় জীবনকে সহজ করার জন্য দিন-রাত সাহায্য করে থাকে, আমার বাসার সেই সাহায্যকারী সহ। মানে বলতে গেলে পরিবারের সবাই। শারীরিকভাবে কাতর হয়ে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটু স্বস্তির খোঁজে চোখ বুলাচ্ছিলাম, তখনই চোখে পড়ল, ভারতের একটি রাজ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট্ট এক টুকরো মাথার কাপড় কেড়ে নিতে চাচ্ছে মুসলিম নারীর শিক্ষার অধিকার। 

 ভাবছিলাম কোন যুগে আছি! একটু স্মৃতির পাতায় চোখ মেলতেই মনে হতে লাগলো,  আমার পড়াশোনার যুগেও শিক্ষা ব্যবস্থা এতো সহজ ছিলো কি? বয়স বারো পেরোতে না পেরোতেই বিয়ের জন্য আমার পরিবারকে যথেষ্ঠ সামাজিক চাপ সহ্য করতে হয়েছিল। পাশাপাশি ছিল ইভটিজিং। বাসা থেকে স্কুলে যেতে প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার পথ মাড়াতে হতো। মনে পড়ে, আমার বাসা থেকে প্রায় দেড়, দুই কিলোমিটার দূর থেকে আরও প্রায় সাত আটজন জন মেয়ে আসতো। আমাদের বাসার কাছে আসলে তখন তাদের সাথে একসাথে স্কুলে যেতাম। 

মানুষের জীবনে সফলতার আরেক নাম শিক্ষা। মীনা -রাজুর সেই বহুল জনপ্রিয় কার্টুনে “শিক্ষা আমায় মুক্তি দিবে, মুক্তি ” সেই মেসেজে অনুপ্রাণিত হয়ে তখন মনে হতো, সামনে এগুতেই হবে, নারী মুক্তি ,নারীর গঠনমূলক স্বাধীনতা ,নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা,নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি, নারীর সর্বোপরি সফলতা। আর এ  সবকিছু বাস্তবায়ন সম্ভব শিক্ষা দিয়ে। এই কথাগুলো মনে গেঁথে নিয়েছিলাম সেই কিশোরী বয়সেই। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রাক্তন বিমান বাহিনী কর্মকর্তা বাবার সীমিত আয়ের, ডিসিপ্লিনড লাইফের প্রতি আকৃষ্ট বোধ করতাম বরাবরই। উনার শর্ত ছিল “কোনরকম কোচিং বা এক্সট্রা কেয়ার ছাড়া যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাও, তবেই ঢাকায় পড়াশোনা হবে, না হয় ময়মনসিংহ আনন্দমোহনেই ভর্তি হতে হবে ইংরেজি সাহিত্যে”। মনে পড়ে তখন এইচএসসি পাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কেবল আনন্দমোহনেই ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম।

তবে বাবার কথা রাখতে পেরেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম দর্শন বিভাগে । অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার পর বাসা থেকে আবার শর্ত জুড়ে দেয়া হলো, “চাকরি যদি করতেই হয় তবে বিসিএস ক্যাডার হতে হবে। বিসিএস ছাড়া অন্য কোন চাকরি করা চলবেনা। নয়তো বা ফাইনাল ডেস্টিনেশন, বিয়ে।” এখন বুঝতে পারি, শাসনের সুরে এই কথাগুলো বলা হতো যেন আমি নিজেকে প্রস্তুত করতে পারি। 

একমাত্র ভাই আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখাতো।  কিন্তু আমি মনে মনে ভাবতাম এ মহান পেশার যোগ্য আমি নই। আর এটা বুঝতে পেরেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড র‍্যাঙ্কে প্রথম মহিলা অফিসার হিসেবে  (৪৭ বিএমএ) যোগদানের ব্যর্থ চেষ্টা করি। হয়তো বাবার পেশাতেই নিজেকে কল্পনা করতাম মনে মনে। কিন্তু হলোনা। তারপর ভাইয়াই আমাকে বুঝালো, “ডিসিপ্লিনড লাইফে কাজ করার সুযোগ আরও রয়েছে। বিসিএস দিয়ে পুলিশ বাহিনীর গৌরবময় অধ্যায়ের অংশ হওয়ার সুযোগ আছে আমার জন্য।” 

যে কথা সেই কাজ। শুরু হয়ে গেলো রেস। জীবনের প্রথম বিসিএসের ভাইভা বোর্ডে চেয়ারম্যান বললেন, ‘নেক্সটে এসো’। চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন। ইতিমধ্যে পরের বিসিএসেও লিখিত পরীক্ষায় উওীর্ণ হয়ে যাই। অবশেষে বিসিএসেই স্বপ্ন পূরণ হলো আমার।

 আব্বাকে পেয়েছি আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা, স্বাধীনচেতা, কর্মঠ, প্রতিবেশী এবং আত্মীয়ের প্রতি বন্ধুবৎসল, দায়িত্বশীল একজন মানুষ হিসেবে। অবাধ স্বাধীনতায় সন্তানদের বেড়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছেন।  কখনও লক্ষ্য বেঁধে দেননি, শুধু ভালো মন্দটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। 

 অন্যদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরপ্রতীকের সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে আমার আম্মা ছিলেন সবার বড় । একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং একজন স্ত্রী হিসেবে আম্মা ছিলেন অনেক দৃঢ়চেতা, কখনও হতাশ হতে দেখিনি। শত প্রতিকূল অবস্থাতেও হাল ছেড়ে দেন না তিনি।  একাত্তরের যুদ্ধ শেষে যখন নানা আর আব্বার বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছিলো, প্রতিবেশীরা সবাই যখন আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, আম্মা যদিও ভেতরে ভেতরে গুমড়ে কেঁদেছিলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে কাউকেই বুঝতে দেননি। এসব কথা শুনেছি বহু পরে।

আব্বা এবং আম্মার দুজনের চিন্তা ভাবনা, জীবনযাপনে প্রভাবিত হই। কখনও থেমে যাওয়া যাবেনা। সামনে এগুতেই হবে। গঠনমূলক কাজে এগিয়ে যেতে হবে। স্লিপ কাটা যাবেনা, কাটলেও সাথে সাথে সোজা হয়ে আবার  দাঁড়ানোর মতো শক্তি সঞ্চার করতে হবে। এই মনোবল নিয়েই এগিয়ে গেছি । জার্নিতে পাশে পেয়েছি আম্মাকে, বড়বোনকে, একমাত্র ভাইকে। পরিবারের সহযোগিতা ছাড়া সামনে এগিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন। 

আমার এই পেশায় জনগনের জন্য কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে।  চাকরি জীবনের শুরু থেকেই যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি সকল শ্রেণি পেশার মানুষের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করার। চাকরি জীবনের শুরুটা হয়েছিল একজন নারীর আত্মহত্যার করুণ দৃশ্য দেখে। স্তম্ভিত হয়ে যাই সেদিন। মানুষের সীমাবদ্ধতার কথা ভাবছিলাম। না পাওয়ার ব্যর্থ হিসেবের কাছে পরাজয়ের বাস্তব চিত্র অবলোকনের মাধ্যমে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করি সেদিন। মনে মনে সংকল্পবদ্ধ হই, যতটুকু পারি ওদের পাশে থাকব। অর্থ, জনবল দিয়ে না পারলেও মনোবল দিয়ে উজ্জীবিত করব। 

সাধ্য অনুযায়ী করেছি, করছি। আরও করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নারী হত্যা, শিশু হত্যা, নারী অপহরণ, শিশু অপহরণের মত মামলাগুলো খুব যত্ন সহকারে তদন্তের জন্য দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকি। নিরীহ মানুষ যেন অযথা হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখি।  মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে বাদীর পাশাপাশি আসামী পক্ষও যেন অযথা হয়রানির শিকার না হয় সেজন্য অধীনস্থদের প্রতি সবসময়ই  নির্দেশনা দিয়ে থাকি। নারী, শিশুসহ সকল শ্রেণীর, পেশার নিরীহ মানুষকে সাধ্যমত আইনী সহায়তা দিতেও তৎপর। 

তাছাড়া দেশের অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার সাথে জড়িত বিষয়গুলো নিয়েও সততার সাথে কাজ করতে গিয়ে সাধারন মানুষের পুলিশের প্রতি অগাধ আস্থা ,বিশ্বাস,  প্রত্যাশা অনুভব করেছি। সেই তাগিদ থেকেই একধরনের দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করে থাকি । চেষ্টা  করি সেই ভরসার জায়গাটা ধরে রাখতে।

বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতনী এবং সন্তান হিসেবে দেশের ও দশের মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ সবসময়ই আমায় তাড়া করে। তাইতো একমাস কম দুই বছরের  শিশু কন্যা রেখে  ২০১১-২০১২ সালে হাইতি মিশনে (MINUSTAH) ভূমিকম্প বিধ্বস্ত দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব স্বরূপ অত্যন্ত সফলতার সাথে ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করি।

সারদায় বেসিক ট্রেনিং সমাপ্তে ‘নারী কন্টিনজেন্ট কমান্ডার’, পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় পুলিশ সপ্তাহে  ‘নারী কন্টিনজেন্ট’ এর কমান্ডার, জাতীয় প্যারেডে “সম্মিলিত নারী কন্টিনজেন্ট” এর কমান্ডার হিসেবে বহুবার দায়িত্ব পালন করেছি। স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৬ সালে “আইজিপি ” ব্যাজ প্রাপ্তি। 

বৈশ্বিক করোনা মহামারীতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে জনগনকে যথাসাধ্য সাহায্যে অংশগ্রহণ করেছি। তবুও মনে হয়, আমার অপূর্ণতা রয়ে গেছে। পুলিশ বিভাগকে আরও অনেক কিছু দেয়ার বাকি রয়ে গেছে, জনগনের জন্য আরো অনেক কিছু করা উচিত, দেশের জন্য আরও অনেক কিছু করার বাকি আছে আমার। আর সেই প্রত্যয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

      সুলতানা ফারমানা মাফি, বিশেষ পুলিশ সুপার, সিআইডি, কিশোরগঞ্জ জেলা