0

মানুষের মাঝে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে চাই

Share

মাকসুদা আখতার প্রিয়তি

আমার প্রথম বিদ্যাপীঠ নাজনিন স্কুল। স্কুলটি ছিল ফার্মগেটের রাজাবাজারে। পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলাম বলে ক্লাস ওয়ানে নয়, একেবারে থ্রিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন বাবা। কিন্তু স্কুলের প্রধান শিক্ষক যখন জানতে পারলেন মাত্র তিন বছর বয়সে আমাকে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করানো হয়েছে, তখন স্কুল থেকেই বের করে দিলেন আমাকে। 

প্রধান শিক্ষক হয়তো ভেবেছিলেন, এত কম বয়সে ক্লাস থ্রিতে কীভাবে আমি পড়ব? কিন্তু ওয়ানের বই আমার একদম মুখস্থ ছিল। যাই হোক পরে ‘মর্নিং গ্লোরি’ নামে একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে শুরু হলো আমার শিক্ষাজীবন।

বাবা প্রয়াত আব্দুর রশিদ ও মা প্রয়াত মোছেন আরা। খুব ছোটবেলাতেই, মাত্র আট বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতে হলেও ১২ বছর বয়সে পাড়ি জমাই আয়ারল্যান্ডে। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি মডেলিংয়ের সাথে যুক্ত হই।

এরপর আমার ১৯ বছর বয়সে মাও চলে গেলেন। কিন্তু থেমে যাইনি নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে। খুব ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম নতুন ও বিশেষ কিছু করার। পরিশ্রম ও ইচ্ছাশক্তিকে সঙ্গী করে এগিয়ে যেতে শুরু করি।

মডেলিং আমার প্যাশন কিন্তু স্বপ্ন ছিল বৈমানিক হবার। আর সে ইচ্ছা বাস্তবে রূপ দিয়েছি ধৈর্য্য ও পরিশ্রমের মাধ্যমে। আমি একজন পেশাদার পাইলট। মডেলিং আমার নেশা আর উড়োজাহাজ চালনা আমার পেশা। মডেলিংয়ে নিয়মিত হলেও পাশাপাশি বেসরকারি পাইলট হিসেবে নিয়মিত উড়োজাহাজ চালনা করি।

অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, একসাথে এতকিছু কি করে করি? আমি আসলে কাজ ভাগ করে নিই। মডেলিংয়ের সময় মডেলিং আর বৈমানিক হিসেবে কাজ করার সময় শুধুমাত্র সেই কাজেই মন দেই। মাঝে মধ্যে কষ্ট হয়, তারপরও সময়টা ব্যালেন্স করে নিই।

২০১৪ সালে ৭০০ প্রতিযোগিকে পেছনে ফেলে ‘মিস আয়ারল্যান্ড’ হওয়ার মুহূর্তটি আমার জন্য ছিল গৌরবের। শুধু বাংলাদেশ নয়, এশিয়া মহাদেশ থেকে এই প্রতিযোগিতায় একমাত্র প্রতিযোগী ছিলাম আমি। এখানে সবাই খুব উৎসাহ দিয়েছেন।

সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সফলতা পাওয়া খুব সোজা ছিল না। আর আমি একজন বাংলাদেশি। আমার বেলায়তো সেটা আরও কঠিন। কিন্তু আমার আত্মবিশ্বাসের কমতি ছিল না।

জীবনে কখনও হতাশা ভর করেনি। আমি আমার কাজের প্রতি সব সময় সিরিয়াস ছিলাম। আর কাজের প্রতি সৎ থাকলে দেরিতে হলেও সেখানে সফলতা আসবে এটা আমি মানি। আমি চেষ্টাও করেছি প্রচুর।

এরপর আরও অনেক কিছু, যা আগেই বহুবার বলা হয়েছে। আয়ারল্যান্ডের শীর্ষ মডেলদের একজন হিসেবে আমার ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে অনেক আন্তর্জাতিক সম্মাননা। মডেলিং ও অভিনয় জীবনেও রয়েছে অনেক স্বীকৃতি ও পুরস্কার। যদিও এসবই পুরোনো কথা।

আমি যেখানে যেভাবেই থাকি না কেন, আমার দেশ বাংলাদেশ। দেশের প্রতি সব সময় অন্যরকম একটা টান কাজ করে। এ বিষয়গুলো বাংলাদেশের মেয়েদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। নিজের মাধ্যমে যদি অন্য কাউকে অনুপ্রেরণা যোগাতে পারি তাই পুরোনো কিছু কথা টেনে আনলাম।

আসলে আমাদের সবারই সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করার মাইন্ডসেট থাকতে হবে, পরিকল্পনা থাকতে হবে। তখনই একাধিক কাজে মনোনিবেশ করতে অসুবিধা হয় না। আর যে কোন পরিকল্পনায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে। এই প্রতিশ্রুতি আর কারও সাথে নয়, নিজের সাথে।

আমাদের দেশে (বাংলাদেশ) যেহেতু একাডেমিক কোয়ালিফিকেশনকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়, তাই আমি বলব পড়াশোনার জায়গাটা ঠিক রেখে বাকি সব করতে হবে। আমি নিজের বেলাতেও তাই করেছি।

মা কষ্ট করেছিলেন আমার পড়াশোনার জন্য, আমি সেদিকে নজর রেখেছি।  যদিও পশ্চিমা বা উন্নত দেশগুলোর প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে যে কোন সময়ে যে কোন মানুষ তার পছন্দ অনুযায়ী ক্যারিয়ার বাছাই করে কাজ শুরু করতে পারেন। 

প্রতিবন্ধকতা থাকবেই। আর এ সকল কিছুকে ডিঙিয়ে মেয়েদের এগিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিবাদ করতে হবে, যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। আমাদের দেশে কোন নারী যৌন নিপীড়ন নিয়ে অভিযোগ করলে প্রথমে আমরা তাকেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিই।

এক্ষেত্রে প্রথমেই আমি বলব, কোন পরিস্থিতিতে এসে একজন নারী তার প্রতি যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে কোন নারীর কথা বলার অধিকার আমরা ছিনিয়ে নিতে পারি না। অপরাধী যেই হোক না কেন, হোক সে তার স্বামী, প্রেমিক, বন্ধু, সহকর্মী বা পরিচিত কেউ।

একজন নারী তার শরীরকে নিয়ে কেমন অনুভব করছেন এবং কেমন অনুভব করিয়েছেন বা করাচ্ছেন সেটা সম্পূর্ণ আপেক্ষিক। এখানে আমরা আমাদের নিজস্ব বিচার এনে তার কণ্ঠ আটকে দিতে পারি না। একজন নারী যদি মনে করেন তিনি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাঁকে বিচার না করে কথা বলতে দিতে হবে। 

যখন দেখব আমরা মুক্তকণ্ঠে কথা বলতে পারি, তখন যে কোনো নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমরা মুখ খোলার সাহস যোগাতে পারব। আমি মনে করি, বাংলাদেশের সমাজে নারীরা সবচেয়ে বেশী যৌন নিপীড়নের শিকার হন তার পরিবারে, স্বামীর কাছ থেকে কিংবা প্রেমিকের কাছ থেকে। কতজন পারেন সেই নিপীড়নের কথা মুখ ফুটে বলতে?

কারণ আমরা আগেই জাজমেন্টাল হয়ে যাই, সেই নারীকেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেই। পাশাপাশি স্যোশাল মিডিয়া ট্রায়াল, বুলিং তো আছেই। কারও হয়তো স্যোশাল মিডিয়ায় কিছু লাইক-ফলোয়ার আছে, সেটাকে পুঁজি করে মসল্লা লাগিয়ে লেখালেখি শুরু হয়ে যায়। 

অনেক কথাই বলা হয়ে গেল। এবার একটু নিজের কথায় ফিরে আসি। ভবিষ্যতে আমি আমার কাজের মাধ্যমে মানুষের মাঝে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে চাই, যাতে তাদের জীবনেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। অনেক আগেই এটি নিয়ে আমি কাজ শুরু করেছি। এখন আরও মনোযোগী হয়েছি এখানে সময় দেওয়ার। 

এছাড়া আমার যাপিত জীবনে মডেলিং, অভিনয়, পাইলটিং, লেখালেখি, পড়াশোনা নিয়ে আমি ব্যস্ত। নিজেকে প্রতিনিয়ত রূপান্তর করার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি আরো গুরু দায়িত্ব আমার দুই সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি। এইতো …

মাকসুদা আখতার প্রিয়তি, মিস আয়ারল্যান্ড-২০১৪, মডেল, পাইলট, অভিনেত্রী