কাজী আসমা আজমেরী
৩১ বছর বয়সে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বাংলাদেশি পাসপোর্টে ১০০ তম দেশ হিসেবে তুর্কমেনিস্তান ভ্রমণ করি। সময়টা ছিল ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর। আর ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার ৫০ বছর অর্জনের দিনটিতে ১১৬ তম দেশ হিসেবে লেবানন ভ্রমণ করি। ২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল ১২৫ তম দেশ জিম্বাবুয়ে ভ্রমণ শেষ করেছি। এখন ১২৬ তম দেশ কোথায় ভ্রমণ করব তা নিয়ে ভাবছি। বাংলাদেশি পাসপোর্টে ভ্রমণ খুব একটা সহজ নয় তা আমরা অনেকেই জানি। পাহাড়সম প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে ছুটে চলেছি অবিরাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষাতেই যদি বলি “সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায়না লেখা সহজে”। তবে সব বলতে না পারলেও কিছু কথা না বললেই নয়। আজকের এই ১২৫ টি দেশ ভ্রমণের শুরুর পথটা এতোটা সহজ ছিলনা। তবে শুরুর গল্পেই ফিরি।
‘মেয়েরা বিশ্ব ভ্রমণ করতে পারে না’। বন্ধুর মায়ের এমন তাচ্ছিল্যের সুরে বলা কথায় মনে ক্ষোভ জন্ম নেয়। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি অন্তত পঞ্চাশটা দেশ ভ্রমণ করেই ছাড়ব। কিন্তু টাকা পয়সার তো একটি ব্যাপার আছে। বাবা-মায়ের টাকা থাকা সত্ত্বেও ভ্রমণের জন্য টাকা দিতে রাজি ছিলেন না তারা। তখন বাধ্য হয়েই মায়ের কাছ থেকে নিজের গয়না-গাটি নিয়ে তা বিক্রি করে বিশ্বভ্রমণের পথে দু-পা বাড়িয়ে দিই। এখান থেকেই আমার পরিব্রাজক জীবনের শুরু। তারপর আর পিছু ফিরে তাকাইনি। দিন-রাত ছুটে চলেছি আমার স্বপ্ন পূরণে ও দেশের জন্য কিছু করার প্রত্যয়ে। এটা ২০০৯ সালের কথা। যদিও ভ্রমণের বীজটা বুনেছিলাম ছোটবেলাতেই। ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনি পড়ে কল্পনায় তার জায়গায় নিজেকে বসাতাম আর অপেক্ষা করতাম কবে আমি স্বাবলম্বী হব এবং বিশ্বময় ঘুরে বেড়াবো ডানা মেলে। যদিও সেটা ছিল একেবারেই কল্পনা।
আমার প্রথম ভ্রমণ ছিল ২০০৭ সালে থাইল্যান্ডে, পরিবারের সাথে। এভাবে বিশ্বময় ঘুরে বেড়াব সেরকম চিন্তা তখনও মাথায় ছিলনা। আমার পরিব্রাজক জীবনের শুরুর কথা বলতে গেলে তাই আমি তাই ২০০৯ সালকেই উল্লেখ করি। শুরুতে নিজের গয়না বিক্রি করে প্রথম দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, নেপাল, ভুটান, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় ভ্রমণ করি। ২০১০ সালে কষ্ট করে দেড় বছর চাকরি করে টাকা জমিয়ে ছয় মাসের জন্য ভ্রমণে বের হয়ে যাই। মিসর, মরক্কো, তুরস্ক, চীন, ফ্রান্স, ব্রুনেই, বেলজিয়ামসহ ১১ টি দেশ ভ্রমণ করি তখন। সেসময় আমাকে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রথমেই ভিয়েতনাম ইমিগ্রেশন জেলেই কাটাতে হয় ২৩ টি ঘন্টা। কারণ আমার বাংলাদেশি পাসপোর্ট এবং রিটার্ন টিকেট ছিলনা। একই বছর সাইপ্রাসে আমাকে নির্মমভাবে গলাধাক্কা দিয়ে ইমিগ্রেশন জেলে ঢুকানো হয়। এখানে জেলেই কেটে যায় আমার ২৭ টি ঘন্টা। শুধুমাত্র বাংলাদেশি পাসপোর্ট হওয়ায় আমাকে এই নির্মম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তাদের সন্দেহ যে ঢুকতে দিলে আর বাংলাদেশে ফিরত যাবনা। এর কারণ বাংলাদেশের অনেকেই স্টুডেন্ট এবং টুরিস্ট ভিসায় ভ্রমণের নাম করে এসে আর দেশে ফেরত যায়না।
তবে এ ঘটনায় আমার জেদ আরও বেড়ে যায়। প্রতিজ্ঞা করি বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়েই ছুটে বেড়াব বিশ্বময়। সারাবিশ্বে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার প্রতিজ্ঞা করি। বাংলাদেশিদের সম্পর্কে ভুল ধারনা ভাঙাতে ২০১০ সাল থেকেই ফেক স্টুডেন্ট ও ফেক ট্যুরিস্টদের নিরুৎসাহিত করতে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির কাজ শুরু করি। আমি ২০১২ সাল থেকে নিউজিল্যান্ডে বসবাস করলেও বাংলাদেশি পাসপোর্ট রেখেছি। আমি মনে করি, বাংলাদেশি পাসপোর্ট পরিবর্তন করলে শুধু আমার নিজের উন্নতি হবে। কিন্তু ১৮ কোটি বাংলাদেশির ভ্রমণের ক্ষেত্রে সমস্যা থেকেই যাবে এবং বিশ্ব ভ্রমণ করতে গিয়ে নানারকম সমস্যার মুখোমুখি হবে। সেই চিন্তা থেকেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট কে ব্র্যান্ডিং করার কাজে লেগে যাই।
২০১৪ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়টাতেই ৫০ তম দেশ ভ্রমণের উদ্দেশ্য সেখানে যাই। তখনই ভয়েস অব আমেরিকার নজরে আসি। তারপর বিভিন্ন সময় বিদেশি পত্র-পত্রিকা থেকে শুরু করে টিভি, রেডিও সবরকমের মিডিয়াতেই বাংলাদেশকে আলোকিত করার চেষ্টা করেছি। এছাড়াও বিবিসি বাংলা, চায়না রেডিও, জার্মানির ব্রায়ান২, সুইডেনের লোকাল রেডিও, উজবেকিস্তানের টিভি, রাশিয়ার নিউজ পেপার, তুর্কমেনিস্তানের ন্যাশনাল টেলিভিশন, নিউজ পেপারে আমার ১০০ টি দেশ ভ্রমণের আর্টিকেল ছাপা হয়েছে। এছাড়াও ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা, টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য হিন্দু আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনগুলোতে ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বভ্রমণের বিভিন্ন তথ্যের পাশাপাশি স্কুল, কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের ভ্রমণের গল্প বলার মাধ্যমে তরুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করা হয়। “ট্রাভেলিং ইজ ফান ওয়ে টু লার্ন”- এই শিরোনামে তরুনদের ভিতরে স্বপ্ন দেখাতে এবং তাদেরকে আত্মবিশ্বাসী হতে অনুপ্রাণিত করে সেই প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হয়।
২০২০ সালে মুজিববর্ষে এক লাখ শিক্ষার্থীর কাছে ভ্রমণের গল্প বলার মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করার কাজ শুরু করলেও করোনার কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে পৃথিবীর প্রায় ৫০০ স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এবং বিভিন্ন অর্গানাইজেশনে প্রায় ৫০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী ও নারীর মাঝে ভ্রমণের গল্প শোনাই এপ্রিল পর্যন্ত। একজন ভ্রমণকারী হিসেবে সবুজ ও পরিচ্ছন্ন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। ‘ক্লিন এন্ড গ্রিন ওয়ার্ল্ড’ এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে ১০০ তম দেশ তুর্কমেনিস্তানে গাছ লাগানোর মাধ্যমে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে একটি করে গাছ লাগানোর প্রতিজ্ঞা করেছি। এছাড়াও বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষ, রিকশাচালক, গৃহকর্মী ও বাসার নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিতদের প্রতি মানবিক হওয়ার জন্য মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
ছোটবেলা থেকেই সন্ধানী ডোনার ক্লাব, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল এর সাথে জড়িত ছিলাম। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবক অর্গানাইজেশনের অ্যাম্বাসেডর ও ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ স্যোসাইটির কান্ট্রি এসিট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে আছি। ৭ থেকে ১৯ বছরের ছেলে মেয়েদের মধ্যে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার বিকাশ ও এক্সট্রা কারিকুলামে উৎসাহিত করার জন্য আমার জন্মস্থান খুলনার ৮৫, রায় পাড়ায় একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করি। নিউজিল্যান্ডের রিয়েল এস্টেট, স্টক এক্সচেঞ্জ ও রেডক্রসের মতো ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে চাকরি করেছি।
আমি শুধু নিজেই ভ্রমণ করতে চাই না। সবুজ পাসপোর্টে বাংলাদেশের মানুষের ভ্রমণের পথকে সুগম করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। আমি ১৭ এপ্রিল ১২৫ তম দেশ হিসেবে জিম্বাবুয়ে ভ্রমণ শেষে তুরস্কে যাই। সেখানে ভ্রমণ শেষ করে এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছি। যদিও এ দুটো দেশ আগেই দেখা। নতুন কোন দেশে আমি পা ফেলব সে চিন্তাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি বাংলাদেশের পর্যটক আর পতাকা আমার দেশপ্রেমের চিহ্ন। এর মাঝেই লুকিয়ে আছে ১৮ কোটি মানুষের ভালোবাসা।
আমি যখন বিভিন্ন দেশে বিদেশিদের আমন্ত্রণে তাদের বাসায় যাই তখন বাংলাদেশি খাবার পরিবেশন করি। অনেকেই আমাকে বাংলাদেশ নামে ডাকে। আমি বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিতে চাই বাংলাদেশি পাসপোর্টেও বিশ্ব ভ্রমণ করা যায়। আর বাংলাদেশিদের বোঝাতে চাই নারীরা শারীরিকভাবে ভিন্ন হলেও তারা পুরুষদের সাথে সমানভাবে এগিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের মেয়েদের উদ্দেশ্য বলতে চাই একবার হলেও একা ভ্রমণে যাওয়া উচিত। এতে নিজেকে জানার পাশাপাশি নিজের যোগ্যতা সম্পর্কেও জানা যায় এবং আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়।
কাজী আসমা আজমেরী, বিশ্ব পরিব্রাজক