0

পাঠ্যপুস্তকে নিজের জীবনের সফলতার গল্প নিজেই পড়ছি

Share

সারাবান তহুরা 

ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে গারো পাহাড়ের কাছে ছোট্ট একটি গ্রাম কলসিন্দুর। ময়ময়সিংহ থেকে তারাকান্দা হয়ে কলসিন্দুর যাওয়ার আঁকাবাকা রাস্তা ও নদীর দৃশ্য হয়তো মুগ্ধ করবে শহুরে মানুষদের। ধোবাউড়া উপজেলায় অবস্থিত পাহাড়ের কোলঘেষা ছোট্ট এ গ্রামেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তবে শহুরে মানুষদের জন্য যা সৌন্দর্য এখানকার বাস্তবতায় তা দুর্গম এলাকা। নানান সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত এখানকার মানুষ। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই খুব দরিদ্র। তবে অনেকেই বলে থাকেন এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশই কলসিন্দুর গ্রামের মেয়েদের অদম্য শক্তির প্রেরণা।

 আমাদের এ গ্রামের মেয়েদের সকাল হয় ফুটবলের ছন্দে। ছেলেদের পাশাপাশি ছোট ছোট মেয়েরাও বল নিয়ে খেলতে বেরিয়ে যায় ভোর হতেই। শহরের চাকচিক্য এখানে নেই। ফুটবল খেলার জন্য যে শক্তির অপচয় হয় তার জন্য প্রয়োজন বাড়তি এবং পুষ্টিকর খাবার। কিন্তু এখানকার বেশিরভাগ দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের জন্য সেই সুযোগ নেই। কিন্তু এখানকার মেয়েদের রয়েছে প্রকৃতির ছন্দে অদম্য মনোবাল নিয়ে বেড়ে ওঠার এক অপূর্ব প্রাণশক্তি। ২০১৪ সালে জাতীয় পর্যায়ে একসাথে ১০ জন কলসিন্দুরের মেয়ে ফুটবল খেলায় সুযোগ পাওয়ার পর থেকে এ গাঁয়ের মেয়েদের ফুটবলে আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে । 

ছোটবেলা থেকেই খুব দুরন্ত ছিলাম আমি। ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলা, মার্বেল খেলা, মাছ ধরা, সাইকেল চালানো আবার বাবার সাথে ধানচাষ করতেও চলে যেতাম মাঝে মাঝে। সবচাইতে বেশি নেশা ছিল ফুটবল খেলায়। তা দেখে গ্রামের মানুষ বলতো ‘মেয়েরা ফুটবল খেললে গুনাহ হবে’। এ কথা কত যে শুনতে হয়েছে আমাকে। এতকিছু বুঝতাম না আমি। শুধু অনুভব করতাম ফুটবলের প্রতি রয়েছে আমার অনেক বেশি টান। আমার বাবাও কখনো চাইতেন না আমি ফুটবল খেলি। 

আমার পাঁচ বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে আমি তৃতীয়। বড় ভাই আমাকে সবসময় উৎসাহ দিতো ফুটবল খেলতে। লুকিয়ে গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলতে নিয়ে যেতো। গ্রামে দুই ভাই-বোন দুই টিমে খেলতাম। খেলাতে দশ টাকা বাজিও ধরতাম । বাজিতে কখনো ভাইয়া জিততো কখনো আমি। এসব কত কথাই মনে পড়ে এখন।  ফুটবল আমার নেশা এবং রক্তের সাথে মিশে আছে এটা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি। 

 ছোটবেলায় শুধু ঢাকার নাম শুনেছি, কিন্তু এটা কোথায় তার কিছুই জানতাম না। আম্মুকে মাঝে মাঝেই জিজ্ঞাসা করতাম। আম্মু বিরক্ত হলেও পরে বলতো, ‘এটা বাংলাদেশেই’। ঢাকা থেকে কেউ আসলে তখন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। আর ভাবতাম, কবে ঢাকায় খেলতে যাব। আমার মন চলে যেতো সেখানে- যদি ঢাকায় কখনো খেলতে যেতে পারতাম এমন ভাবনা আমার মনে ডালপালা ছড়িয়ে বসতো। যদিও তখনও ময়মনসিংহ শহরটাই দেখা হয়নি।

 মাথায় ছোট চুল আর ফুটবল খেলার নেশা দেখে আমায় মেসি বলে ডাকতো অনেকে। আমি যখন গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে কোথাও যেতাম তখন অনেকে বলতো “এই মেসি কই যাও?”  যদিও খুশি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তখন আমার খুব রাগ হতো মেসি ডাক শুনে, কারণ এই মেসিকে আমি জানতামই না।  

কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব প্রাথমিক জাতীয় নারী ফুটবল প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমার আনুষ্ঠানিকভাবে ফুটবলে হাতেখড়ি হয়। তখন থেকেই ফুটবলে গোল করা আমার অভ্যাসে পরিণত হতে থাকে। এরপর আর থেমে থাকিনি। অল্প সময়ের মধ্যেই আমার গায়ে ওঠে বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের জার্সি ।

 এরপর উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে খেলায় একাধিক পুরস্কার পাই। তখন থেকেই আমাদের গ্রামের মানুষ বলতে শুরু করে “তুমি শুধু আমাদের কলসিন্দুরই নও ময়মনসিংহ এবং পুরো দেশের গর্ব’। আমার সফলতার পরপর যখন আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয় তখন গ্রামের মানুষ বলতো, “তোমার জন্যই আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে।” 

আন্তর্জাতিক ফুটবলে এখন পর্যন্ত আমার গোলের সংখ্যা ৪৫ টি। এছাড়াও রয়েছে পাঁচটি হ্যাটট্রিক। ২০১৬ সালে প্রথম হ্যাটট্রিক স্বাগতিক তাজিকিস্তানের বিরুদ্ধে এএফসি অনূর্ধ্ব -১৪ এর আঞ্চলিক আসরে। তখন ৪ ম্যাচে সর্বোচ্চ গোল করি ১০ টি।  তারপর ২০১৭ সালে ঢাকায় সাফ অনূর্ধ্ব -১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করি। ২০১৮ সালে মার্চে হংকংয়ে অনূর্ধ্ব-১৫ জকি কাপে দুটি হ্যাটট্রিক সহ ১৬ টি গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জিতেছি। একই বছরে ভুটানের  থিম্পুতে  সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে  দুটি গোল করি। ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশ হারলেও যুগ্মভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা নির্বাচিত হয়েছি।

 ২০১৯ সালে থাইল্যান্ডের আইপিই চনবুরি স্টেডিয়ামে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে নিজেদের শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষে দুটি গোলই করেছি আমি। যা এএফসি কাপে বাংলাদেশের মেয়েদের সেরা সাফল্য। এর ফলে প্রথমবারের মতো এশিয়ান বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে পয়েন্ট পেয়েছে বাংলাদেশ। 

এরপর অনুর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল দলেও জায়গা করে নিই। ২০২১ সালে কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে সাফ অনুর্ধ্ব – ১৯ নারী ফুটবলের ফাইনালে ভারতের বিরুদ্ধে ১-০ গোলে শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই আমরা। এর আগেও ২০১৭ সালে কমলাপুর স্টেডিয়ামে ভারতকে হারিয়ে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা  জিতি আমরাই। তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে আমাদের দলকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোল করায় আমার অনেক প্রশংসা করেন। এটা আমার জন্য অনেক গৌরবের ছিল। 

 ২০১৯ সালে ‘রূপচাদা প্রথম আলো বর্ষসেরা নারী ফুটবলার’ এর পুরস্কার দেয়া হয় আমাকে। সেই পুরস্কারটি অন্য একটি খেলার জন্য নিজে উপস্থিত থাকতে পারিনি তাই আমার বাবা গিয়েছিলেন। তখন আমার বাবাও বলেছিলেন, একসময় তিনি  মেয়ের খেলা পছন্দ না করলেও এখন মেয়ের জন্য গর্ব করেন। এছাড়াও আগে যে গ্রামের মানুষ আমার খেলা করতে নিষেধ করতো এখন তারাই আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। আর সকলের এই অনুপ্রেরণাই আমাকে প্রতিদিন নতুন করে শক্তি যোগায়।

 ফুটবল আমার জীবনটাকে বদলে দিয়েছে। একসময় মেসি ডাকলে আমি রাগ করতাম এখন মেসি ডাক শোনে আমার খুব ভাল লাগে। আমাকে এলাকার মানুষ কলসিন্দুরের মেসি বলেই ডাকে। মারিয়া, সানজিদারাও আমাকে মেসি বলে ডাকে। গ্রামের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আমাকে দেখতে আসে। এখন আমি মেসির ভক্ত। আমার প্রিয় ফুটবলার জাতীয় দলের স্ট্রাইকার সাবিনা খাতুন। জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়ে যখন সাবিনা আপুর সাথে অনুশীলন করতাম তখন খুব ভাল লাগতো।  

এবার অন্য এক ভাললাগার কথা বলবো। এই অনুভূতি কোন ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এ বছরই আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি। আর এ বছরই উচ্চ মাধ্যমিকের ইংলিশ ফর টুডে বইয়ের ৮৮ পৃষ্ঠায় দ্য ‘আনবিটেন গার্লস’ ( অপরাজেয় মেয়েরা) শিরোনামে কলসিন্দুরের মেয়েদের ফুটবলের জ্যোতি ছড়ানোর গল্প  ওঠে এসেছে। সেখানে লড়াই সংগ্রাম করে ফুটবলে আমার নিজের জীবনের গল্প আর সাফল্য নিজেই পড়ব। এতদিন বিখ্যাত সব মানুষের জীবনের গল্প পড়েছি। এ যেন স্বপ্ন আর কল্পনার মাঝামাঝি কিছু একটা। 

আর আমাদের গল্প পড়ে যদি দেশের অন্য মেয়েরাও অনুপ্রাণিত হয় সেটা তো আরো গর্বের। আমিও চাই মেয়েরা এভাবেই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ওঠে আসুক। একজনই আরেকজনের অনুপ্রেরণার শক্তি হয়ে উঠুক। আমি ছাড়াও  সানজিদা, মারিয়া,  শামসুন্নাহার, শিউলি আজিম, নাজমা আক্তার, মারজিয়া আক্তারের গল্পও আছে। তবে এই আনন্দের মাঝেও সাবিনাকে হারানোর কষ্টটা আমাদের রয়েই গেছে। ২০১৭ সালে সাবিনা খাতুনের অকাল মৃত্যুটা আমাদের সবসময় কষ্ট দেয়। তার কথাও লেখা আছে বইতে।

 আজকের এই অবস্থানে আমি সহ কলসিন্দুর গ্রামের মেয়েদের এই জয়ের পথটা যারা চিনিয়েছেন তাদের নাম তো বলতেই হবে। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিনতি রানী আর ক্রীড়া শিক্ষক মফিজ স্যার আমাদের সেই অনুপ্রেরণা। এছাড়াও কদ্দুস স্যার, মোকগুল স্যার, বোরহানউদ্দিন স্যার, সুলতান স্যার, মালা রানী সরকার ম্যাডাম, রাজীব দাদা, জুয়েল ভাই তাদের উৎসাহেই কলসিন্দুরের মেয়েরা এখন জয় করে চলেছে একের পর এক।

 কলসিন্দুরের মতো একটি দুর্গম গ্রামের মেয়েরা ফুটবল খেলবে এ অবিশ্বাস্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন তারাই। আর ছিল আমাদের প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি। আমি মনে করি ইচ্ছাশক্তির কাছে সবকিছু পরাজিত হতে বাধ্য। ফুটবল নিয়েই বহুদূর এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি । দোয়া করবেন যেন আমি দেশকে ভাল কিছু উপহার দিতে পারি।

সারাবান তহুরা, স্ট্রাইকার, (জাতীয় মহিলা ফুটবল দল)

(অনুলিখন: তাসকিয়া মাইশা)