ফারহানা সুলতানা
মাসিক বা পিরিয়ড নিয়ে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম ট্যাবু রয়েছে। রয়েছে অনেক অব্যবস্থাপনাও। আর এ কারণে প্রতিবছর স্কুল থেকে ঝরে পড়া মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়। বাংলাদেশের স্কুল ছাত্রীদের ক্লাসে অনুপস্থিতির তথ্য নিয়ে ২০১৮ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে ‘মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ম্যানেজমেন্ট অ্যামং বাংলাদেশি অ্যাডলোসেন্ট স্কুল গার্লস অ্যান্ড রিস্ক ফ্যাক্টরস এফেক্টিং স্কুল অ্যাবসেন্স: রেজাল্টস ফ্রম আ ক্রস-সেকশনাল সার্ভে’ শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়, মাসিকের কারনে দেশের ৪১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী মাসে গড়ে প্রায় তিন দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকেন। ২০১৮ সালের ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে থেকে দেখা যায় যে, বর্তমানে ৩০ ভাগ মেয়ে মাসিকের সময় স্কুলে অনুপস্থিত থাকেন। প্রায় ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই মাসিকের সময় স্কুলে অস্বস্তিতে ভোগেন।
ফেমিলারিটি, কমফোর্ট ও বাজেটের কারণে দেশের শতকরা ৫০ ভাগের বেশি নারী ও কিশোরী মাসিক ব্যবস্থাপনায় কাপড় ব্যবহার করেন। যদি হাইজিন মেইনটেইন করে মাসিকের কাপড় ধোয়া, শুকানো এবং সংরক্ষণ করা হয় তাহলে কাপড় ব্যবহার করা বরং বাজারে সহজলভ্য প্যাডের চাইতে স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশ বান্ধব। কারণ এতে কোন কেমিক্যাল নেই কিংবা সহজে মাটির সাথে মিশে যায়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এখন বরং কাপড়ের প্যাড ব্যবহারের হার বাড়ছে। কারন এটা পরিবেশ বান্ধব। এছাড়াও বাজারে বাণিজ্যিকভাবে যেসব স্যানিটারি প্যাড বিক্রি হয় , তাতে ৩ দশমিক ৪ গ্রাম প্লাস্টিক থাকে। জীবনব্যাপী একজন নারী প্যাড ব্যবহার করলে প্লাস্টিকের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৩ কিলোগ্রাম, যা মাটির সাথে মিশে যেতে সময় লাগবে ৫০০ থেকে ৮০০ বছর।

আইসিডিডিআরবি স্বল্পমূল্যে পরিবেশবান্ধব এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে কিভাবে মাসিক ব্যবস্থাপনা করা যায় তা নিয়ে কাজ করছে। এর আওতায় আমি ২০১৬ সালে ‘সুলতানা আইসিডিডিআরবি রিইউজেবল ক্লথ প্যাড’’ বানিয়েছি। পরীক্ষামূলক প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের শহর ও গ্রামের স্কুলগুলোতে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে যে শতকরা ৮৩ ভাগ মেয়েরা এটি পছন্দ করছেন। কারন এটা তাদের কমফোর্ট দিয়েছে। এছাড়াও এটি পরিবেশবান্ধব এবং পুনরায় ব্যবহার করা যায়। আর দাম মাত্র ৬০ টাকা। এছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় আমরা দেখেছি মাসিকের কারণে কিশোরীদের অনুপস্থিতির হার ৬ মাসের মাথায় ৮ ভাগ কমিয়ে আনতে পেরেছি।
বাংলাদেশে মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য যারা কাপড় ব্যবহার করেন তাদের বেশিরভাগই ট্যাবুর কারণে দেখা যায় ঠিকমতো ধোয়া, রোদে শুকানো, বা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করেন না। তাছাড়া স্কুল, বস্তি, কমিউনিটি, কর্মক্ষেত্র কিংবা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি এসব জায়গায় মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য ঠিকমতো সরঞ্জামাদি থাকেনা। যেমন ধরা যাক পানির স্বল্পতা, প্রাইভেসি কিংবা বিনের অভাব। ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি এবং সাবান দিয়ে মাসিকের কাপড় ধুতে পারেননা, স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় শুকোতে দেন । এর ফলে রিপ্রোডাক্টিভ ট্র্যাক্ট ইনফেকশানস, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশানস সহ নানা ইনফেকশান হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এসব বিষয়কে মাথায় রেখে আমি মাসিকের কাপড় ধোয়া এবং শুকানোর জন্য ‘সুলতানা ওয়াশার এন্ড ড্রায়ার ব্যাগ’ বানিয়েছি।

এখানে দুটি ব্যাগ আছে যার বিশেষত্ব হলো নারী ও কিশোরীরা এর ভেতরে মাসিক ব্যবস্থাপনার কাপড় নিয়ে সাবানের গুঁড়ো দিয়ে হাতের স্পর্শ ছাড়াই ধুতে পারবেন। এবং ধোয়ার পর অন্য যে ব্যাগ রয়েছে তার ভেতরে করেই রোদে শুকাতে দিতে পারবেন। পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা শহরের দুটি বস্তির নারী ও কিশোরীদের মধ্যে এই ব্যাগগুলো বিতরণ করা হয় এবং ৬৫ ভাগের বেশি নারী এবং কিশোরীদের কাছ থেকে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া গেছে। এই প্রজেক্টগুলো নিয়ে আরও গবেষণা চলেছে এবং বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করতে কস্ট ম্যানেজমেন্ট এবং ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট ইত্যাদি অনেক বিষয়ে কাজ চলছে।
এগুলোই শেষ নয়, কারণ আমি ভাবছিলাম কিভাবে নারীদের স্বল্প দামে পরিবেশ বান্ধব স্যানিটারি প্যাড দেয়া যায়। নিরাপদ মাসিক ব্যবস্থাপনার প্রজেক্টের অংশ হিসেবেই ‘বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন’ এর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড. মোবারক আহমেদ খানের সাথে সমন্বয় করে আমরা পাটের সেলুলোজ ভিত্তিক স্যানিটারি প্যাড তৈরি করেছি। এ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পরবর্তীতে ২০২১ সালে ‘আমেরিকান সোসাইটি ফর ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন’ (এএসটিএমএইচ) আয়োজিত ‘চতুর্থ ইনোভেশন পিচ’ প্রতিযোগিতায় প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে গ্র্যান্ড পুরস্কার অর্জন করি। এএসটিএমএইচ প্রতিবছর এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। পাট দিয়ে স্যানিটারি প্যাড তৈরির জন্য যে মেশিনের প্রয়োজন সেটার উপর একটা উপস্থাপনা দিয়েছিলাম প্রতিযোগিতায়। এতে বিভিন্ন দেশের বিচারকদের পাশাপাশি অডিয়েন্স পোলের মাধ্যমে ভোটের সুযোগ ছিল। সব বিবেচনায় আমাদের প্রস্তাবনা প্রথম হয়েছে।

এ অ্যাওয়ার্ডের মূল্যমান পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার। পাট দিয়ে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে নারীরা আরাম পাচ্ছেন কি না, স্বাস্থ্যসম্মত কি না, এই প্যাড ব্যবহারের পর মাটিতে ফেললে তা মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে কি না—এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা চলছে। আর এই প্যাড এখনও হাতে তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বাজারে ছাড়তে হলে তা মেশিনে বানাতে হবে। আর এ নিয়ে আরো গবেষণা চলছে । এছাড়াও বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের ক্ষেত্রে আর্থিক বিষয়টিও জড়িত। এই সব বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে কাজটির অগ্রগতি আরো খানিকটা এগুবে বলে আশা করছি। বর্তমানে কাজ করছি ‘নিউট্রিয়েন্ট বার’ নিয়ে। যা মাসিকের সময় নারী ও কিশোরীদের রক্তস্বল্পতা বা অন্যান্য পুষ্টিজনিত সমস্যা কমাবে বলে আশা করছি।

আমার পড়াশোনা নৃবিজ্ঞান নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএইচ করেছি। কিশোর কিশোরীদের স্বাস্থ্যের উপর লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের উপর একটি কোর্সও সম্পন্ন করি। এখন পাবলিক হেলথ এন্ড প্রিভেনটিভ মেডিসিন এর উপর অষ্ট্রেলিয়ার মনাস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি।
প্রতিটি নারী যাতে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ডিগনিটির সাথে তার মাসিক ব্যবস্থাপনা করতে পারেন সে বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। প্রতিটি নারীর মাসিক বিষয়টিকে সম্মান করতে শিখতে হবে। কারণ এটি সুস্বাস্থ্যের চিহ্ন বহন করে। কাপড় বা প্যাড যাই ব্যবহার করুননা কেন তা চার থেকে ছয় ঘন্টা পরপর বদলাতে হবে। অন্যথায় মাসিকের রক্ত বাতাসের সংস্পর্শে এসে যে ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে তা প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। দেশের প্রতিটি নারী যেন স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মাসিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারেন তার জন্য স্বল্প মূল্যে বিকল্প সমাধান খোঁজার লক্ষ্যে আমি কাজ করে যেতে চাই সবসময় ।
ফারহানা সুলতানা, (সহকারী বিজ্ঞানী) আইসিডিডিআরবি