সাবিনা ইয়াসমিন
সকালে কোন অ্যাসাইনমেন্ট না থাকার কারনে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি। সূর্যি মামা ততক্ষণে পৃথিবীকে আলো দেওয়ার কয়েক ঘন্টা হয়ে গেছে। হঠাৎ ভাইব্রেশন হতেই হাতে নিলাম ফোনটা। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে ‘সাবিনা কল্যাণপুরের বস্তিতে আগুন লেগেছে, তাড়াতাড়ি যান।’ এবার আরামের ঘুম হারাম করে উঠে বসলাম। বসেই নিজে নিজেই চট করে পরিকল্পনা করে নিলাম কি কি করতে হবে।
পাঁচ মিনিটেই রেডি হয়ে গেলাম। এক গ্লাস পানি খেয়ে ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এবার গন্তব্যের দিকে ছুট। রুম থেকে বের হয়ে আসার সময় ঘুম চোখে তিন বছরের মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।হয়তো কিছু বলতে চাইছিলো মেয়ে। কিন্ত কথা শোনার আগেই আমি রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। রাস্তায় নামতেই মাথার মধ্যে একটা ছক একে নিলাম। কিভাবে কি করতে হবে। কোন জায়গা থেকে ছবি তুললে সবচেয়ে ভাল ছবিটা পাওয়া যাবে। আর অফিসে কত দ্রুত তা পাঠাতে হবে।
কয়েক ঘন্টা ফায়ার সার্ভিসের চেষ্টায় আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। ততক্ষণে সকাল গড়িয়ে দুপুর। ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কাজ শেষ হলেও আমার কাজ অনেকাংশেই বাকি। পুড়ে যাওয়া বিল্ডিংয়ের পাশে বসেই ছবি বাছাই করতে থাকি। অনলাইনেই তাড়াতাড়ি ছবি পাঠাতে হবে। প্রাথমিক কাজ শেষ করে অফিসের দিকে রওনা দিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সূর্যের আলো আস্তে আস্তে মাথার উপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলতে শুরু করেছে। এর মধ্যে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় এক গ্লাস পানি ছাড়া পেটে আর কিছুই পড়েনি।
উপরের ঘটনাটি পড়ে অনেকে মনে করতে পারেন আগুন কি আর প্রতিদিন লাগে নাকি? তাদের জন্যই বলছি, আগুন প্রতিদিন না লাগলেও রাজধানী এ শহরে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ঘটনা ঘটে। যেটার খবর পড়ার জন্য পাঠকেরা অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সংবাদপত্রের দিকে চেয়ে থাকেন। তাই আমার ছুটে চলাও সকাল-দুপুর-রাত।

প্রতিদিনের এমন ব্যস্ততাই এখন আমার নিত্য দিনের সঙ্গী। ছোটবেলা থেকেই আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতাম। অনেক ভাবনার ডানা উঁকি দিতো আমার মনে। জীবনের ভাবনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতাম না। ভাবনাগুলো পাখির ডানা মেলে ছুটে চলতো শত শত মাইল। তেমনি আমার স্বপ্নগুলোও পাড়ি দিতো শত মাইল। রাজশাহী থাকলেও স্বপ্নটা ছিলো বড় কিছু করে দেখাতে হবে। আমার বাবা মায়ের আদর্শ সন্তান হতে হবে।
রাজশাহী থেকে ঢাকায় পড়তে আসার জন্য পা রাখাটা মোটেও সহজ ছিলনা আমার জন্য। আমরা পাঁচ বোন। বাবার রেলওয়ের সরকারি চাকরি। বাবা মা চাইতেন আমরা যেন রাজশাহীতে থেকেই পড়াশোনা করি। আর আত্মীয়স্বজনরাও চাইতেন না আমরা পড়াশোনা করি, চাকরি করি। সবার মধ্যে এরকম একটা মনোভাব ছিল যে, মেয়েদের এত দূরে গিয়ে পড়াশোনা করার কি দরকার। সেই তো বিয়েই দিতে হবে । কিন্তু আজ আমরা সব বোনেরাই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। আর এটা সম্ভব হয়েছে আমার মায়ের জন্য। আমার মায়ের চাকরি করার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় পেরে উঠেননি। কিন্তু সবসময় চাইতেন তার মেয়েরা যেন সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়। আমার ঢাকায় আসার পেছনে আমার প্রিয় মানুষের অবদানও অনেক বেশি।
আমি ২০০৮ সালে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হই। আমি যখন ঢাকায় পড়ার জন্য থাকতে আসি তখন সেই সময়টা আমার জন্য খুব কঠিন ছিল। আমি সাবলেট থাকতাম। এটা মোটেও ভাল চোখে নিতেন না আত্মীয় স্বজনরা। আর যেখানে সাবলেট থাকতাম সেখানকার আশেপাশের লোকজনও খুব একটা ভাল চোখে দেখতোনা। কখন বাসায় ফিরতাম, বের হতাম কেমন যেন বাঁকা চোখে তাকাতো আশেপাশের লোকজন। এই বিষয়গুলো খুবই যন্ত্রণার ছিল। তবে আমি এ বিষয়গুলো তেমন একটা আমলে নিতাম না। কারন চোখে মুখে তখন স্বপ্ন কেবল সাংবাদিক হবার।

এসব প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়েই এগিয়ে চলতে থাকি। পড়াশোনার পাশাপাশি ফটোগ্রাফিটাও শিখতে চাচ্ছিলাম। ২০০৯ সালে ভর্তি হই পাঠশালাতে। ছোটবেলা থেকেই ছবি তুলতে আমার ভালো লাগতো। আমার মায়ের শখের ক্যামেরা ইয়াসিকাতেই আমার হাতেখড়ি। সবাই যখন ল্যাপটপ কিনে আমি তখন কিনেছি ক্যামেরা। এছাড়াও ফিল্ম সোসাইটি, কন্ঠশীলন, ডিবেট ক্লাব, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সহ বেশ কিছু সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হই।
স্নাতক করার পর নিউজ নেটওয়ার্ক নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ফেলোশিপ করি । নিউজ নেটওয়ার্ক থেকেই ২০১২ সালে ইন্টার্নশীপ করার জন্য পাঠানো হয় দৈনিক প্রথম আলোতে। দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকায় ইন্টার্নের সুযোগ পেয়ে তখন বেজায় খুশি। চোখে মুখে শুধু একটাই স্বপ্ন সাংবাদিক হব। আমি প্রতিবেদক হিসেবে এখানে কাজ করছি আর ক্যামেরা নিয়েই চলতাম, তাই পাশাপাশি ছবিও তুলতে শুরু করি। প্রতিবেদন করার পাশাপাশি ছবি তুলছি। একই সঙ্গে দুটো কাজ করার কারনে সবাই খুব প্রশংসা করতো। অনেকে বিশ্বাস করতে পারতো না দুটো কাজ একজন একই সময়ে করছে আবার ভালো করছে কিভাবে?
একসময় প্রথম আলো থেকে আমাকে বলা করা হয় ইন্টার্ন শেষে ফটো সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার জন্য। তবে এটাও ছিল পরীক্ষামূলক। যদি ভাল কাজ দেখাতে পারি, তাহলে নেওয়া হবে। এরপর আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে প্রথম আলোর স্টাফ করে নেয়া হয় ২০১৩ সালে। এই প্রথম আমি ফটো সাংবাদিক হিসেব স্বীকৃতি পাই। আমার কাজের দক্ষতা প্রমাণ করি।

মূলত সম্পাদক মতিউর রহমানের আগ্রহতেই আমাকে ফটো সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এখানে প্রতিনিয়তই আমাকে পুরুষ ফটো সাংবাদিকদের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হয়েছে। আমাকে অনেকেই পরোক্ষভাবে বোঝাতো যে, আমি একটা মেয়ে কেন আমি ফটো সাংবাদিক হব। পরিবার, আত্মীয় স্বজনরাও তেমনটিই মনে করতো। কিন্তু সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে কাজ চালিয়ে গেছি। ‘আমি বাবা মা এর শত আদরের মেয়ে’ ছোট বেলায় মিনা কার্টুন দেখে অনুপ্রাণিত হতাম। আমি সাহসী মীনা হবো, সবার ভালো করবো। কিন্তু কিভাবে তা জানতাম না। তা প্রথম আলোর মাধ্যমে অনেকটা বুঝে গেলাম।
সবচেয়ে ভাল লাগে যখন আমার তোলা কোন ছবি প্রকাশিত হয় এবং সেটা কারো জীবনকে বদলে দেয়। এরকম অনেক কাজ আছে আমার যেটা প্রকাশিত হবার পর অনেকেই এগিয়ে এসেছে সহায়তায় জন্য। পাল্টে দিয়েছে কিছু অসহায় মানুষের জীবন। এই আত্মতৃপ্তির কাছে সকল কষ্ট, সংগ্রাম বাধা হার মেনে যায়।
বিয়ে করি ২০১৬ তে। আমার বর আমার কাজকে সমথর্ন করলেও শ্বশুরবাড়ির অনেকেই একজন ফটো সাংবাদিক মেয়েকে বউ হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। এখানেও আমাকে শুনতে হয়েছে কেনো আমাকে ফটো সাংবাদিকতাই করতে হবে। অনেক সহজ কাজ আছে তা করেও তো জীবন ধারণ করা যায়। তবে আমার বর সবসময় আমাকে সমথর্ন করেছে। তার ইচ্ছে অনুযায়ী আমিও এগিয়ে যেতে সাহস পেয়েছি। আমার শ্বশুর পাবনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি ২০১৪ সালে মারা যান। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন আমাকে কাজে উৎসাহ দিয়েছেন।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ইস্যু কাভার করার সময় আমি বুঝতে পারি আমার ভেতরে অন্য একটি প্রাণের অস্তিত্ব। নির্দিষ্ট সময় পার করার পর জন্ম নিল মেয়ে অন্নপূর্ণা। তখন থেকে শুরু হয় আমার নতুন আরেকটি যুদ্ধ। একদিকে সন্তান, সংসার অন্যদিকে কাজের প্রতি ভালোবাসা।
এর মধ্যে আমি বেশ কিছু পুরস্কারও পাই ফটো সাংবাদিক হিসেবে। ‘বেস্ট ফটো সাংবাদিক’ পুরস্কার পাই নিউজ নেটওয়ার্ক থেকে ২০১৩ সালে। ‘মীনা এওয়ার্ড’ পাই ২০১৮ সালে। এছাড়াও টিআইবি পুরস্কার সহ আরো কিছু পুরস্কার পেয়েছি বিভিন্ন সময়ে। আমর প্রথম ফটো এক্সিবিশন হয় দৃক গ্যালারীতে ২০০৯ তে। আমার বাবার ছবি নিয়ে ছিল এই এক্সিবিশনটা, এটা ছিল দলীয় একটি প্রদর্শনী। এরকম গ্রুপ ফটো এক্সিবিশন হয়েছে আরো কিছু।
২০২১ সালে করোনা সময়ে আমার একক এক্সিবিশন ‘অন্তর্দন্ধ’ হয় দৃক গ্যালারিতে। এই কাজটা ছিল মূলত করোনার সময়ের দিনের নিজেকে নিয়ে। একদিকে আমার কাজ অন্যদিকে সংসার।

বাংলাদেশে নারী ফটো সাংবাদিকের সংখ্যা অনেক কম। অনেকে সাহস করে আসলেও পরে নানা প্রতিবন্ধকতায় ঝরে পড়েছে। তবে প্রথম আলো আমার ফটো সাংবাদিক হবার স্বপ্নকে সফল করেছে। নিজেকে তৈরি করার সুযোগ দিয়েছে। আমার পরিবার, আমার বাবা-মা এখন আমাকে নিয়ে গর্ব করেন।
শত প্রতিবন্ধকতায় আমার একটাই প্রাপ্তি যখন আমার কাজের মাধ্যমে কিছু মানুষের উপকার হয়। এটা আমাকে মানসিক শান্তি দেয় এবং কাজের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। আমি কিছুতেই থেমে যেতে চাইনা। ভবিষ্যতে নিজেকে ফটো সাংবাদিকতায় একটা শক্ত অবস্থানে দেখতে চাই। আর আজীবন ছবি তুলে যেতে চাই।

সাবিনা ইয়াসমিন, ফটোসাংবাদিক, প্রথম আলো