0

 গুটি গুটি পায়ে বহুদূর ‘গুটিপা’

Share

তাসলিমা মিজি 

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রাজনৈতিক আবহে কাটে বেশিরভাগ সময়। মিছিলে, আন্দোলনে, দাবী আদায়ে সরব থাকতাম সম্মুখ সারিতে। বন্ধুদের বেশিরভাগই ছিল কোন না কোন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সদস্য, যাদের সাথে মেলামেশা আমার জীবন দর্শনকে দারুনভাবে প্রভাবিত করে। রাজনীতির সংস্পর্শে থাকা আর সমাজবিজ্ঞানে পড়ার সুবাদে আমার মাঝে সমাজ পরিবর্তনের চিন্তা আর চেতনা তৈরী হয়। পড়াশোনা সমাজ বিজ্ঞানে হলেও সাংবাদিকতার সাথে পরিচয় ঘটে বন্ধুবান্ধবদের সংস্পর্শে এসে। তাই মাস্টার্স উত্তীর্ণ হওয়ার পর সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিই। প্রথম সারির দুটি পত্রিকায় দীর্ঘদিন কাজ করার পর একটা সময় আমার ব্যক্তিগত জীবনে কিছু পট পরিবর্তন হয়। আমার সন্তান জন্মের পর আমার পেশাগত জীবনকে কাটছাঁট করতে হয়, শুরু হয় উদ্যোক্তা হিসেবে আমার পথচলা। 

আমার প্রথম উদ্যোগ ছিল তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত একটি ব্যবসা। হার্ডওয়্যারের খুচরা বিক্রেতা ও সরবরাহকারী হিসেবে অনেকটা আনকোরা একটি পেশায় নিজেকে যুক্ত করলাম। কিন্তু এখানে খুব একটা ভাল করতে পারছিলাম না, তারচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল আমার আগ্রহটা হারিয়ে যাওয়া। একঘেয়ে হয়ে ওঠার  আগেই আমি খুঁজতে লাগলাম দ্বিতীয় একটি ব্যবসা শুরু করা যায় কোথায় থেকে। এ সময় পরিবার থেকেও কিছুটা চাপ আসে নতুন কোন চাকরি খুঁজে নিতে।

কিন্তু আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম এমন কিছু, যেখানে আমি পণ্যটিকে সৃষ্টি করবো এবং আমার কাজে পূর্ণ আনন্দ উপভোগ করতে পারবো। চামড়ার ব্যাগ এবং জুতার প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল বেশ আগে থেকেই। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর ব্যাগ আমি দেখতাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। শুরুতে কারিগরি জ্ঞান ছিলনা আমার। কিভাবে একটা ম্যাটারিয়াল থেকে ডিজাইনটি তৈরি হয় এবং ফাইনালি তা প্রোডাক্টে পরিণত হয় তা নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করলাম নিজে নিজে। এভাবে ভাবতে ভাবতেই শুরু করলাম চামড়া শিল্পে আমার উদ্যোগের যাত্রা। 

২০১৬ সালের শুরুতেই প্রথম কাজ শুরু করলাম একটি ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে। নাম দিলাম ‘গুটিপা’। সেই সময় আমার পরিবার আমার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা ছেড়ে দিয়েছে। ভেবেছে, ও তো রসাতলে গেছে, ওকে দিয়ে আর কিছু হবেনা। কিন্তু আমি ছিলাম খুব আত্মবিশ্বাসী, মনে হলো আমি যেন আমার রাস্তা খুঁজে পেয়েছি। 

প্রথমে কিছু ব্যাগের ডিজাইন করি এবং বানিয়ে নিই অন্য কারখানা থেকে। মোবাইল দিয়েই ছবি তুলে ফেসবুক পেইজে আপলোড করার পর আমার বন্ধুরা খুব উৎসাহ যুগিয়েছে। শুরুতে ফেসবুক পেইজের মাধ্যমেই পরিচিত বন্ধু-বান্ধবের কাছে বিক্রি শুরু করি। এভাবে গুটি গুটি পায়ে এগুতে থাকে গুটিপা। 

যখন বৃহৎভাবে শুরু করার কথা ভাবলাম তখনই সামনে ফাইন্যান্সের বিষয়টি চলে আসলো। যেটা কোথাও পাচ্ছিলাম না। এমনকি ব্যাংকের কাছে লোন নিতে গেলেও কেউ আমাকে বিশ্বাস করতে পারছিলনা। এরকম একটা জায়গা থেকে নিজেকে প্রমাণ করতে আমার বেশ সময় লেগেছে এবং একটা সময় পেরেছি। 

আমি এখন নিজের কারখানায় ৩৫ জনের মতো কর্মী নিয়ে কাজ করি এবং আমার বিজনেস বাড়াতে সামনেই আরো বেশ কিছু লোক নিয়োগ দেয়া হবে। একজন নারী হিসেবে কাজ করার অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, সেটাকে মোকাবিলা করে যাচ্ছি প্রতিদিন।। গুটিপার মূল ফোকাস হলো ওয়ার্কিং ওমেনদের জন্য প্রয়োজনীয় এবং একই সাথে ফ্যাশনেবল ব্যাগ তৈরি করা।

দেশের বাইরে নেদারল্যান্ডস এর একটি ডিজাইনার ব্র্যান্ডের জন্য আমরা কাজ করি। এছাড়াও ইউএসএ এবং জার্মানীতেও রপ্তানী করছি। গুটিপা নিয়ে আমার স্বপ্ন হচ্ছে আমরা দেশীয় ম্যাটারিয়েল দিয়ে প্রোডাক্ট তৈরি করব, যেগুলো দেশের মানুষ ব্যবহার করবে এবং দেশের বাইরেও রপ্তানী করব। আর এগুলো হবে আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন এবং এভাবেই এগুচ্ছে সবকিছু।

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি যে, কিছু শুরু করার নির্দিষ্ট কোন বয়স নেই। তাই সময় পার হয়ে গেছে বলে হতাশ হওয়া যাবেনা। বিশ্বের অনেক নামীদামী ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা আছেন যারা শুরু করেছেন বেশি বয়সে। আর কোন উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হলেই সেখানেই শেষ এমনটা ভাবা চলবেনা। ব্যর্থতাগুলো অনেক বড় অভিজ্ঞতা হিসেব কাজ করে। একটা মানুষ তখন আরো বেশি পরিপক্ক হয়।

আমার আজকের এ অবস্থানে আসতে ছাত্রজীবনের রাজনীতি, পড়াশোনা, চারপাশের মানুষ এবং ব্যর্থতাগুলোই  নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

তাসলিমা মিজি (উদ্যোক্তা) গুটিপা