নাজিয়া জিহান তানিয়া
ছোটবেলা থেকেই আমি অনেক ইমোশনাল ছিলাম। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। উনার বদলির চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের অনেক জায়গায় থাকার সুযোগ হয়েছে। মিশেছি অনেক রকম মানুষের সাথে। বাবা যখন তিন বছর পরপর বদলি হয়ে যেতেন, প্রতিবারই নতুন নতুন বন্ধু তৈরি হতো আর তাদের ছেড়ে আসার সময় কষ্টে বুকটা ফেটে যেতো। পড়াশোনার জন্য বড়কালে একদিন ঢাকাতেই স্থায়ী হতে হলো। বাবা-মা চাইতেন আমি ডাক্তার হবো। আমারো তেমনই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলাম না। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে না পেরে খারাপ লেগেছিল। কিন্তু তাই বলে আমি হতাশ হয়ে পড়িনি।
পড়াশোনা শুরু করলাম ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ নিয়ে। ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়তে পড়তেই আমার মনে হলো ব্যাংকের চাকরিই হবে আমার জন্য পারফেক্ট। আমার খুব ডিসিপ্লিনড লাইফ পছন্দ। এলোমেলো অগোছালো সময় কাটানো আমার ধাতে নেই। ভর্তি হলাম বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এ। এখানকার পড়াশোনা বেশ সিস্টেমেটিক। আমার মনে পড়ে বিআইবিএমে ভর্তির পর দুই বছর পর্যন্ত কোন ফ্যামিলি গেদারিং এ যাওয়ার সুযোগ পাইনি।
ব্যাংক ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স শেষ করে জয়েন করলাম ইস্টার্ণ ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে। শুরু হলো আমার করপোরেট লাইফ। একইসাথে শুরু হলো কঠিন কর্ম জীবন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবেই আমি ব্যাংক জবের প্রচন্ড প্রেশার এবং একইসাথে একাধিক বিষয়ের কাজগুলো খুব এনজয় করতাম। সত্যি বলতে বিআইবিএম ব্যাংক জবের জন্য আমাকে পুরোপুরি তৈরি করে দিয়েছিল। প্রতি মাসের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত দিন ছিল বেতনের দিনটা এবং এখনো যেটা সবচেয়ে বেশি কাঙ্ক্ষিত। যাই হোক করপোরেট লাইফে অনেক কিছুই শিখছি প্রতিনিয়ত।
সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা, ভেবেচিন্তে কথা বলা, ভাল না লাগলেও অনেক সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া- এসব করতে করতে কিভাবে যেন ছোটবেলার সেই প্রচন্ড ইমোশনাল আমিই হয়ে গেলাম চরম প্র্যাকটিক্যাল। এক সময় যোগ দিলাম প্রাইম ব্যাংকে। এখন এখানেই আছি সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে। আজকের এই পর্যায়ে আসতে সময় লেগেছে সতেরো বছর। করপোরেট সেক্টরের পথটা মেয়েদের জন্য খুব স্মুথ নয়। এখানে প্রতিনিয়ত নিজেকে অনেক বেশি প্রমাণ করে টিকে থাকতে হয়। মেয়েরা লিডারশিপ পর্যায়ে যাবে এটা অনেকেই মানতে পারেনা।
তবে কিছু পজিটিভ দিক তো অবশ্যই আছে। যেমন কাজের পরিবেশটা বেশ নিরাপদ। আর্থিক বেনিফিটটাও অস্বীকার করার উপায় নাই। তবে একজন ছেলে যেমন শুধু ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজটা করে যেতে পারে আমাদের মেয়েদের জন্য কিন্তু সেই সুযোগটি কম। আমরা শুধু ক্যারিয়ার নয়, একইসাথে আমাদেরকে সমান তালে সংসারও সামলাতে হয়। অনেক সম্ভাবনাময় মেয়েকে দেখেছি বেশ সিনিয়র পজিশনে যাওয়ার পরেও বাচ্চার দেখাশোনা করার জন্য চাকরি ছেড়ে দিতে। পরবর্তীতে তাদের অনেককেই প্রচন্ড হতাশ হতে দেখেছি। তাই মেয়েরা কখনো অযোগ্যতার কারণে ঝরে পড়ে সেটা আমি বলবোনা। প্রতিষ্ঠিত বা ভাল পজিশনে যেতে না পারার অন্যতম কারণও পরিবারের সাপোর্ট না থাকা।
এ ব্যাপারে আমার ভাগ্য বেশ ভালই বলতে হয়। যে কোন বিপদে আপদে বাবা-মা, ভাই-বোনকে পাশে পেয়েছি। আরো কিছু মানুষের কথা না বললেই নয়- আমার বর এবং শ্বশুর শাশুড়িও অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন। আসলে পরিবারের সাপোর্ট না থাকলে ফুল টাইম জব করা মেয়েদের জন্য কঠিন। সারা সপ্তাহ কাজের পর ছুটির দিনগুলি খুব এনজয় করি। বাচ্চাদেরকে নিয়ে ঘুরতে যাই, ওদেরকে নিয়ে ছাদে বাগান করি, রান্না করি । বাচ্চাদের বিভিন্ন এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিতে ব্যস্ত রেখেছি যাতে ওরা ওদের সময়টা উপভোগ করতে পারে আর একাকীত্বে না ভুগে।
রাতে ঘুমানোর আগে আধা ঘন্টা সময় শুধুই আমার। ঐ সময়টা আমি গল্পের বই পড়ি। আমার মনে হয় নিজেকে চাঙ্গা রাখার জন্য প্রতিদিন ‘মি টাইম’ টা একান্ত জরুরি। আরেকটা কাজ আমি খুব এনজয় করি, সেটা হচ্ছে বাগান করা। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্নরকম ফুলের গাছ লাগাতাম। প্রতিবার যখন বাবার বদলির জন্য অন্য জায়গায় চলে যেতাম, তখন কিছু গাছ সাথে নিতাম আর কিছু ফেলে যেতে হতো। এখন বাসার ছাদে সুন্দর একটা বাগান করেছি। অনেক রকমের ফুল-ফলের গাছ আছে আমার বাগানে। সকালে বাগানে বসে এক কাপ চা খাই। এটা খুব রিফ্রেশিং!
গানটাও শিখেছিলাম ছোটবেলায়। একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলাম। কিন্তু পরে আর সময় দিতে পারিনি। তবে এখনও সময় পেলে শখের বশে হারমোনিয়াম নিয়ে বসি। ছেলের সাথে পিয়ানো বাজাই। হাওয়া বদলের জন্য একটু দেশের বাইরে ঘুরতে যাই। রিফ্রেশ হয়ে আবারো পুরোদমে কাজে লেগে পড়ি। এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিন কর্ম-ব্যস্ততায়। সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা আমাকে একটা সুস্থ সুন্দর জীবন উপহার দেওয়ার জন্য।
নাজিয়া জিহান তানিয়া, সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রাইম ব্যাংক