0

উদ্যোক্তা বাঁচলে কারিগর বাঁচবে, কারিগর বাঁচলে শিল্প বাঁচবে

Share

কাজী শবনম

শখের বশে সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলাম কিছুদিন। যদিও সাংবাদিকতা আমার খুব ভাল লাগার একটি জায়গা কিন্তু পেশা হিসেবে করপোরেট সেক্টরকেই বেছে নিই। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে করপোরেট অ্য়াফেয়ার্স সেকশনে জয়েন করি। তারপর আরো একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছিলাম বেশ কিছুদিন। বাচ্চাকে ডে-কেয়ারে রেখে অফিস করতাম। এই অফিস আমাকে বিকাল চারটার মধ্যে ছুটি দিয়ে দিতো। আমি সেভাবেই বলে নিয়েছিলাম জয়েন করার আগে। কারণ বিকাল পাঁচটার পর ডে-কেয়ার বন্ধ হয়ে যেতো। বাসায় এমন কেউ ছিলোনা যার কাছে বাচ্চা রেখে অফিস করতে পারি। একসময় আমার অফিসের সেই বস অবসরে চলে যান। এরপর আমি আর বিকাল চারটার মধ্যে ছুটি পাচ্ছিলাম না। অন্যদিকে আমার সন্তানকে পাঁচটার পর ডে-কেয়ারেও রাখতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়েই চাকরিটা ছেড়ে দিই। এখানে চাকরি ছাড়ার পর অনেক চেষ্টা করেছি এমন কোন অফিস, যেখানে আমাকে চারটায় ছুটি দিয়ে দিবে। কিন্তু এভাবে কোন অফিস রাজি হয়নি। আর আমিও আমার চাকরি জীবনের এখানেই ইতি টানলাম। 

২০১৭ সালে বলতে গেলে এক বান্ধবির অনুরোধেই ‘শাড়িকাব্য’ দিয়ে শুরু হয় আমার উদ্যোক্তা জীবন। ব্লক, স্ক্রিনপ্রিন্ট, টাইডাই এর ডিজাইন করতাম শাড়িতে । এরপর ২০১৮ সালের বইমেলা আমার জন্য খুবই স্মরণীয় একটি সময়। বইমেলায় নারী কবিদের জন্য আমি বেশ কিছু স্ক্রিনপ্রিন্টের শাড়ি তৈরি করেছিলাম। যেখানে তাদের কবিতা দিয়ে শাড়ির আঁচলের ডিজাইন করা হয়েছিল। নারী কবিরা তাদের কবিতার শাড়ি পরে বইমেলায় গিয়েছেন এই বিষয়টি মনে হলে এখনও আমার মনে অন্যরকম এক ভালোলাগা তৈরি হয়। কাজটি বেশ জনপ্রিয়তা পায় তখন। এই সফলতার পর আমার কাজে উৎসাহ আরো বাড়তে থাকে।

রিকশা পেইন্টের প্রতি আমার বেশ আগ্রহ ছিল সবসময় এবং দেখলাম অনেকেই বাসায় ব্যবহৃত নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন তৈজসপত্রে রিকশা পেইন্ট করে ব্যবসা করছে এবং মানুষও পছন্দ করছে। আমিও রিকশা পেইন্ট নিয়ে কাজ করব বলে সিদ্ধান্ত নিই। সেই উদ্দেশ্য একসময় পুরানো ঢাকার বিভিন্ন রিকশা  গ্যারেজে যাই শিল্পীর খোঁজে। ওখানে গিয়ে যেটা দেখতে পেলাম, অরিজিনাল রিকশা পেইন্ট একেবারে নেই বললেই চলে। যেগুলো আছে তা ডিজিটাল প্রিন্ট, আমরা সবাই সেটা বুঝতে পারিনা। অনেক কষ্টে অরিজিনাল রিকশা পেইন্টের কারিগর পেলাম। সঠিক পারিশ্রমিকের অভাবে তাদের অনেকেই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। মনে মনে স্থির করলাম বিলুপ্ত হতে বসা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করব এবং অরিজিনাল কারিগরদের নিয়েই কাজ শুরু করব।

 এখন অনেক রিকশা পেইন্টের কাজ আমরা দেখতে পাই, যেগুলো আসল রিকশা পেইন্ট থেকে অনেক আলাদা। অরিজিনাল কারিগরদের কাজ এবং যারা এখন করছেন তাদের কাজের মধ্যে অনেক পার্থক্য। হাতে গোনা দুই একটি প্রতিষ্ঠান আছে যারা অরিজিনাল কারিগরদের নিয়ে কাজ করে থাকে। আমার মনে হলো যেটা যার কাজ সেটা তাদেরই করতে দেয়া উচিত। এতে করে এই শিল্পটা যেমন বেঁচে থাকবে তেমনি এর সাথে জড়িত মানুষগুলোরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। 

আমি ক্ষুদ্র পরিসরেই শুরু করলাম অরিজিনাল রিকশা কারিগরদের নিয়ে  বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরির কাজ। আমার একটা ছোট্ট স্টুডিও রয়েছে যার নাম ‘নৈসর্গিক’। এখান থেকে লাভের একটা বড় অংশ আমি কারিগরদের দিই। কারণ আমি শুধুমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এটা করছিনা, আমার উদ্দেশ্য এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা। যে কোন ছবি এঁকে এটাকে রিকশা পেইন্ট বলতে রাজি নই আমি। অনেক ভ্যারাইটিজ আনতে গিয়ে সেটাতে আর ঐতিহ্যবাহী রিকশা পেইন্টের অস্তিত্ব থাকছেনা। রিকশা পেইন্টের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে সিনেমার নায়ক-নায়িকার ছবি, গানের কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। নির্দিষ্ট কিছু ফুল আছে রিকশা পেইন্টের। এখন যদি সুন্দর দেখাতে গিয়ে পদ্ম ফুলের জায়গায় অন্য কোন ফুলের ছবি আঁকি সেটা আর ঐতিহ্যবাহী রিকশা পেইন্ট থাকছেনা। আমার অনুরোধ আমরা যেন মোটিভগুলো ঠিক রাখি।

সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে রিকশা পেইন্ট এর শিল্পী তৈরি করা বা তাদের ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাব।  আমি সবসময় বলি, ‘উদ্যোক্তা বাঁচলে কারিগর বাঁচবে আর কারিগর বাঁচলে শিল্প বাঁচবে’। আমাদের এত সুন্দর একটা শিল্প যাতে বিলুপ্ত না হয় সে ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে নজর দেয়ার অনুরোধ করছি। এটা আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। আমি চাই যেসব রিকশা পেইন্ট শিল্পীরা কাজ ছেড়ে দিয়েছেন তাদের পুনর্বাসন করতে। যদিও রিকশাতে অপেক্ষাকৃত কম দামে ডিজিটাল প্রিন্ট পাওয়া যাচ্ছে তাই প্রকৃত শিল্পীরাও হারিয়ে যাচ্ছে। তাই তাদের কাজগুলো শুধু রিকশা কেন্দ্রিক না রেখে সারা দেশের রিকশা শিল্পীদের কাজগুলোকে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। এজন্য দরকার সরকারি- বেসরকারি উদ্যোগ। এছাড়াও এই ঐতিহ্যকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়ার উদ্যোগও নেয়া প্রয়োজন। বিমানবন্দর, বড় বড় হোটেলগুলোর একটা কর্নার শপে যদি রিকশা পেইন্টের জিনিস রাখা হয় তবে দেশের বাইরেও আমাদের এই শিল্পকে তুলে ধরা সম্ভব। 

আমাদের ‘নৈসর্গিক’ এর  রিকশা পেইন্টের অনেক জিনিস দেশের বাইরের ক্রেতারাও পছন্দ করছেন। কিন্তু বাইরে পাঠাতে গিয়ে যে খরচ তাতে আমরা পুষিয়ে উঠতে পারিনা। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য নিয়মগুলো শিথিল করা যায় কিনা একটু ভেবে দেখার জন্য। এছাড়াও বর্তমানে দেশে প্রচুর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালে অনলাইন কেন্দ্রিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অনেকে বেড়েছে। অনেকে আবার অনেক আইডিয়া নিয়ে বসে আছে কিন্তু কিছু টাকার অভাবে শুরু করতে পারছেনা। আমি মনে করি,ব্যাংক লোন দেয়ার ক্ষেত্রে যদি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য নিয়মগুলো শিথিল করা যায় তবে আরো নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। এতে করে দেশে চাকরির বাজারে চাপ কমে আসবে এবং বেকার সমস্যা দূর হবে।

কাজী শবনম, (উদ্যোক্তা) নৈসর্গিক