মিনারা নাজমীন
“সকাল আমার গেল মিছে, বিকেল যে যায় তারই পিছে গো”—-বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের গানের ভাষ্যের মতো আমার কোনো সকালই মিছে যায় না। অবাক করা বিষয় হলো সকালটা তো অবশ্যই, আমার প্রতিটা মূহুর্তই অসম্ভব সুন্দর সত্যে ভরপুর থাকে নিত্য । সেই সত্যের নাম ব্যস্ততা, অমিয় অনিন্দ্য নিত্যতার পথে ছুটে চলা। আমার জগৎ; আমার পরিবার আর দেশমাতৃকার কল্যাণে অবিরাম কাজে লেগে থাকারই আরেক প্রতিশব্দ যেন। রূপসার তীরে জন্ম নেয়া মা- বাবার আদুরে একমাত্র তনয়া’র জীবনের গতি বহমান খরোস্রোতা রূপসার মতো এতো ক্লান্তিহীন আর অবিরাম হবে, অতীত দিনগুলিতে কখনও ভাবিনি। তবে হ্যাঁ, এখন ভাবতে খুবই অবাক লাগে, এই আমি যে কিনা কোনোদিন রসুইঘরই ভালোমতো চিনতাম না, সেই আমিইতো হাল সময়ে লবন-হলুদ-মরিচের রসায়ন থেকে শুরু করে জাতিপুঞ্জের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনও সমানতালে হৃদয়াঙ্গম করি। দু’হাতে সমানে সামলাতে পারি ঘর-দোর থেকে শুরু করে সরকারি দায়িত্ব। কি পারি না! অন্য দশজন থেকে বরং একটু বেশিই পারতে হয়, পারিও।শুকরিয়া।

দাদা বাড়ি উত্তরের জনপদ নওগাঁ’র পাহাড়পুরে। যেখানে ঐতিহাসিক পাহাড়পুর, বা সোমপুর বৌদ্ধ বিহার অবস্থিত। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্রটির এই বিশাল স্থাপনা আবিষ্কার করেন। এই বিহার কোলঘেঁষা পারআদাইপুর গ্রামেই আমার শিক্ষক পিতার জন্ম। আর আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা খুলনায়। পদ্মার শাখা নদী রূপসা বিধৌত বাণিজ্য কেন্দ্র আর ঐতিহ্যের মিশেল এই নগরীর এক সম্ভ্রান্ত ভূপতির ঘরে আমার মায়ের জন্ম। উত্তর-দক্ষিণের মিলন আর ইতিহাস- ঐতিহ্যের রসায়নই আমার পৃথিবী নামক গ্রহের আলো অবলোকনের পূর্বকথা। গৌরবময় অতীত পরম্পরায় সেই আমাকেই পিতার পছন্দে স্নাতক ও স্নাতোকোত্তর ডিগ্রী গ্রহণ করতে হয়েছিল রসায়ন শাস্রে। এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতো প্রতি মুহূর্তে সমাজ ও কর্মের পারস্পরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার সমান উপস্থিতির তালাশ করতে করতেই চলমান দিন-দুনিয়া আমাকে যুক্ত করে বাংলাদেশের অতি মর্যাদাবান প্রশাসন ক্যাডারে। তারপর থেকে সমাজ ও কর্মের বিশাল ফারাকের অভিজ্ঞতা-ঝুড়ি দিন দিন শুধু ভারীই হয় না, যেন পাহাড়ে পরিণত হতে থাকে। রাষ্ট্রের নিয়ম আর সরকারি আদেশের চুল পরিমাণ ব্যত্যয় না ঘটিয়ে হাকিমের দায়িত্ব-ব্রত পালন শুরু করি ভাওয়াল রাজার ইতিহাস খ্যাত গাজীপুর জেলায়। সুনাম আর অভিজ্ঞতার তিন বছর পেরোতে না পেরোতেই পাড়ি দেই আমার চেনা জানা খুলনা জেলায়। ন্যায়-বিচারের তারাজুকে সুউচ্চে তুলে ধরতে নিয়মিত আদালত-এজলাসের বাইরেও ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা আর নানা কিসিমের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে থাকি সব বিপত্তি ডিঙিয়ে। এই পথ চলায় নিজেকে প্রতিদিন নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকি। সমাজ আর কর্ম কখনও কখনও চোখে আঙ্গুল দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়ার দুঃসাহস দেখায়; তুমি নারী। আমি এই মনে করিয়ে দেয়াটা গ্রহন করি, কিন্তু মানতে পারি না। আমার মনের গহীনে একটি আলোর দেয়াল আছে, সেটা আমাকে তা মানতে বাঁধা দেয়। এই বাঁধার প্রাচীর আমাকে শক্তি যোগায় আরো আরো চ্যালেঞ্জকে স্বাগত জানাতে। সাথে আছে আমার শক্তির আঁধার বর-বন্ধু আর সন্তানেরা।

দিন যায়, মাস যায়, যায় বছর, আমি আরো পোক্ত হই। দায়িত্বও বাড়ে। রাষ্ট্রের আদেশ এইবার আরেকটু চ্যালেঞ্জ নেয়ার; উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসাবে পদায়িত হই নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায়। জানতাম, এই এক মহা চ্যালেঞ্জ, কিন্তু জানতামনা এখানেই হবে সাত খুনের মতো নারকীয় ঘটনা, আর আমার উপস্থিতিতেই খুঁজে পাওয়া লাশের উত্তোলন। দেশ-দুনিয়ার তাবৎ গণমাধ্যমের উপস্থিতি আর অসহায় পরিবারগুলোর গগনবিদারী কান্নার আড়ালে নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমি কারো মেয়ে, কারো মা কিংবা আমারও পরিবার আছে। এতগুলো মরদেহ একসাথে দেখার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, এতো আহাজারি ও এতো মানুষও এইরকম পরিবেশে দেখিনি। নিজের ভিতরে নিজেই যেনো হারিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু না, হারানো যাবে না; আবেগ নয় আইনই আমার বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু এই এক ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা। এরপর আমি অনেক বার লাশের দীর্ঘ সারি দেখেছি। কিন্তু সেই দিনটা ছিল একটু আলাদা। কষ্টের সেই দৃশ্যগুলো আমাকে সেইদিনের পর অন্তত সাতদিন খেতে দেয়নি । আমার স্বামী, যিনি নিজেও একজন সমপদের কর্মকর্তা তিনি আমাকে নানাভাবে সহায়তা করে সহজ করার চেষ্টা করেছেন। ভিতরে ভিতরে আমার কি যে হয়ে গিয়েছিল সেটা আমার বাইরে সে ছাড়া আর কেউ আঁচ করতে পারেনি।

এ তো বিভীষিকাময়, আছে অনেক সুখকর অভিজ্ঞতাও। জোর করে চাপিয়ে দেয়া বিয়ের আসর থেকে কোনো বালিকাকে যখন উদ্ধার করে স্কুলে পাঠাই, তখন তার তৃপ্তির হাসি আমার জীবনকে আরো অর্থবহ করে তুলে। মেয়ে হিসাবে আমিওতো হতে পারতাম এরকম নিষ্ঠুরতার শিকার। কিংবা ভূমিখেকো’র হাত থেকে কোনো অসহায় নারীর মাথা গোঁজার একমাত্র অবলম্বন জমির টুকরা উদ্ধার করে দেই, তখন অসহায়ের জীবনের যে নিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়, তা কি পরিমাণ আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায় আমার ভেতরে, তা ভাষায় প্রকাশ প্রায় অসম্ভব। এই রকম শত বিষয়ে অভিজ্ঞতার ঝোলা ভর্তি করে পাড়ি দেই মার্কিন মুল্লুকে নারীর উন্নয়ন নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নিতে। যাবার আগে স্বরাষ্ট্র ও পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়েও কাজ করেছি, আইন শৃঙ্খলা ও আদিবাসীদের উন্নয়ন নিয়ে। দেশমাতৃকার টানে ফিরে এসে এখন কাজ করছি সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। বাজারের অসম প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ নিয়েই আমার দিনরাত্রি। বাদ যায় না রান্না-বান্না, স্বামী-সন্তান দেখভালের মতো অতি আপন কাজও। সকাল ছয়টায় শুরু হয়ে আমার দিন শেষ হয় রাত ১০/১১টায়। কি করে সব সামলাই পরম আনন্দে? সেই সব টোটকা আজ থাক। আর জমে থাকা সব বাস্তব বৃত্তান্তও থাক জমা আরেক দিনের জন্য, এই কথাগুলো অশেষ।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো করেই বলি—- “একটি কথা বাকি রইলো, থেকেই যাবে”।
মিনারা নাজমীন, সিনিয়র সহকারী সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
(বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন-এ সংযুক্ত) ।
Darun, ak kothai Darun laglo. Anek shubho kamona ♥️♥️♥️