রায়না মাহমুদ
জীবনটা বেশ সুন্দর, গোছানো কেটে যাচ্ছিল তখন। ছবি তুলি, পাশাপাশি ছোট-খাটো কিছু বিজনেসের সাথেও জড়িত। দুই সন্তান ও স্বামী স্বনামধন্য ফটোগ্রাফার চঞ্চল মাহমুদ। এছাড়াও আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব। আজ এক প্রোগ্রামে তো কাল অন্য প্রোগ্রামে। সব মিলিয়ে দারুন কাটছিল দিনগুলো। এমন হাসিখুশি জীবনে হঠাৎই ক্ষয়ে যাবার শব্দ শুনি। জীবনে নেমে আসে ছন্দপতন, যেদিন প্রথম শুনেছি আমার শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যান্সার।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে টিউমার বায়োপসি রিপোর্টে প্রথম জানতে পারলাম আমার ক্যান্সার। একই বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই আমার চিকিৎসা শুরু করে দিই। ৪৯ বছর বয়সে আমার ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ে। শারীরিকভাবে তখন এমন কোন জটিলতা টের পাইনি যে,আমি বুঝতে পারব আমার শরীরে ক্যান্সার থাকতে পারে। কিন্তু আমার ব্রেস্টে কিছু ছোট ছোট টিউমার ছিল, যেগুলো আগে কয়েকবার অপারেশন করা হয়েছে। তবে ক্যান্সারের একটা স্ট্রং হিস্টরি ছিল আমার পরিবারে। আমার মা ব্রেস্ট ক্যান্সারে মারা যান ১৯৯৫ সালে।
তখন ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট এত সহজ ছিলনা। আর আমার মা প্র্রথমে বুঝতেও পারেননি কিছু। যখন আমরা জানতে পারলাম আমার মায়ের ক্যান্সার, তার এক বছর পর্যন্ত ফাইট করে মারা যান আমার মা। যেহেতু আমার স্ট্রং একটা হিস্টরি আছে যে আমার মা সারভাইভ করতে পারেননি, এসব জেনে ডাক্তার আমাকে কিছু টেস্ট করাতে দেন এবং তারপর আমাকে জানান সেই সংবাদটি। আমি জানতে পারলাম আমার শরীরেও ক্যান্সার এবং আমার স্টেজটা সেকেন্ড স্টেজে।

যেদিন আমি প্রথম জানতে পারি সেদিনও আমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছি খুবই স্বাভাবিকভাবে। এর আগে যেহেতু আমার ছোট ছোট টিউমার অপারেশন হয়েছে তাই সেদিনও আমি সেরকম একটা বিষয় মাথায় রেখেই গিয়েছিলাম ডাক্তারের কাছে যে আমার হয়ত টিউমারই হবে। আগে যেহেতু আমার ক্যান্সারের জার্ম আসেনি এবারও আসবেনা, সেই বিশ্বাসটা ছিল। ডাক্তার যখন জানালেন আমার ক্যান্সার, সেই মুহুর্তটা আসলে কোন লেখা দিয়ে বা বলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমার মনে হচ্ছিল ভুল শুনেছি।
আমার ছেলে মেয়ে সাথে ছিল, ওরা আগে থেকেই জানত। রিপোর্ট আমার মেয়ে তার এক ডাক্তার বন্ধুকে দেখায় এবং তারা আগে থেকেই জেনে যায়, কিন্তু আমাকে জানায়নি। আমি যখন আমি জানতে পারি তখন থরথর করে কাঁপছিলাম আর আমার সন্তানেরা আমায় ধরে রেখেছিল শক্ত করে। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। আমি ঠিক সেই মুহুর্তে ভাবছিলাম যেহেতু আমার মা’ও সারভাইভ করতে পারেননি আমাকেও হয়ত হার মানতে হবে ক্যান্সারের কাছে। মানসিকভাবে প্রচন্ড বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
কিন্তু চিকিৎসা নিতে গিয়ে বুঝলাম, না, ক্যান্সার হলেও তার ট্রিটমেন্ট আছে। আমি একটু একটু করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছিলাম। সেই মুহূর্তে আমার পরিবার, সন্তান এবং বন্ধুরা শক্তভাবে আগলে ধরেছিল আমাকে, যেটা ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। শুধু মানসিক নয় অর্থনৈতিকভাবেও আমি সবার সহযোগিতা পেয়েছি। আর ছিল আল্লাহর অশেষ রহমত।
ক্যান্সার চিকিৎসাটা ব্যয়বহুল। বলেনা, একটা পরিবারে যদি ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী থাকে সেই পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে যায়। আর আর্থিক সাপোর্টও তো সবাই পায়না, পেলেই কতটুকু পায়। আমার প্রতি আল্লাহর রহমত ছিল তাই বোধহয় আমার কাছের মানুষগুলো নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে এসেছে আমার জন্য। ক্যান্সার হবার পর আমার চলার গতিপথটাই বদলে গেল। যখন আমি চিকিৎসা নিচ্ছি তখন তো আমি একটা বাইন্ডিংসের মধ্যে চলে এলাম। আমি কারও যত্ন নিতে পারবোনা পরিবারের, সবাই আমার যত্ন নিবে। নিজেকে অসহায় লাগতো। তবে মানসিক শক্তিটা ধরে রেখেছিলাম। আমার জীবনের সবকিছুই নতুন করে শুরু করতে হবে যদি আমাকে সারভাইভ করতে হয়, এই মনোবলটুকু ধরে রেখেছি ভেঙে না পড়ে।
মাঝে মাঝে ভয়ে কুঁকড়ে গেছি আবার সাহস সঞ্চার করেছি। ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু করার আগে পুরো বডির একটা চেকআপ করা হয় যার নাম ‘পেট-সিটি স্ক্যান’। চেকআপের জন্য যখন আমাকে মেশিনে ঢোকানো হলো, আমার হাত বাঁধা, পা বাঁধা। তখন আমি চোখ খুলিনি, আমার কেবলই মনে হচ্ছিল কবরের ভেতরে চলে যাচ্ছি। সেই মেশিনের ভেতরে থাকতে থাকতেই আমি আল্লাহর কাছে বলেছি, তুমি আমাকে অসুখ দিয়েছ এবং এ থেকে উদ্ধার করার দায়িত্বও তোমার। তুমি আমাকে উদ্ধার করো।

আমার বিশ্বাস ছিল আল্লাহ আমাকে নতুন জীবন দেবেন। আমি পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ পড়ে কেবল আল্লাহর কাছেই চেয়েছি। মানুষ বাবা মার কাছে সবকিছু আবদার করে। কিন্তু আমার বাবা মা নেই, তাই আমি তোমার কাছেই চাইছি। আমার মনে হয়েছে, সবসময় আল্লাহ আমাকে নিজ থেকে ফেরেশতা পাঠিয়ে আমার পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। না হয় এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা আমার কিভাবে হলো? নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার পাশে ছিলেন বলে। ক্যান্সারের পুরো জার্নিটায় শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক এই তিনটা বিষয়কে মাথায় রেখে একজন ক্যান্সার পেশেন্টকে যুদ্ধ করতে হয়।
আমি সবসময় চোখে কাজল পরি ছোটবেলা থেকেই। কাজল না পরলে আমার আব্বু বলতো, “মা তোমার কি অসুখ। চোখে কাজল পরনি কেন?” ছোটবেলায় সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর চোখে কাজল লাগিয়ে দিত আমার মা । এরপর সবসময় আমার বাবার সন্তুষ্টির জন্য আমি চোখে কাজল নিতাম। তবে এই সময় তো আমার চুল পড়ে যাচ্ছে, চোখের পাপড়ি পড়ে যাচ্ছে তাই আমার চোখের কাজলের কথা মাথায় থাকতোনা। কিন্তু আমি যখন কেমো নিতে যেতাম তখন আমার হাজব্যান্ড বলতো, তুমি কাজল ছাড়া কখনও কেমো নিতে যাবেনা। আমি সবসময় পরিপাটি হয়ে কেমো নিতে যেতাম, সবাই আমাকে চেনে ওখানে যে আমি সুন্দরভাবে হাসিমুখে কেমো নিতে যাই আবার বাসায় ফিরে আসি হাসিমুখে।
কেমোথেরাপি নেয়ার শারীরিক কষ্ট অনেক। এর যন্ত্রণা যেন কোন শত্রুকেও আল্লাহ না দেন। হাত পায়ে জ্বালাপোড়া, হাড্ডি বা অস্থির ভেতরের যে জ্বালাপোড়া তা সহ্য করার মতো নয়। সেই কষ্টটাকেও আমার কষ্ট মনে হয়নি। কিন্তু সেকেন্ড কেমো নেবার পর যখন মাথার লম্বা লম্বা চুলগুলো হাতের মুঠোতে চলে আসছিল, সেদিন আমি অনেক কেঁদেছিলাম। আমার খুব কষ্ট লাগছিল যে, মাথার চুলগুলো এভাবে পড়ে গেল! ক্যান্সারের চিকিৎসার কোন কষ্ট ছিলনা আমার। আলহামদুলিল্লাহ আমি সেই জায়গা থেকে বের হয়ে এসেছি আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া।

ক্যান্সারের চিকিৎসার সময় ডক্টরের কথাগুলো ভালভাবে শোনে সেভাবে চলা উচিত।কোন খাবারটা খাব কোন খাবারটা খাবনা। যেমন চিনি খাওয়া নিষেধ। কাঁচা ফল খাওয়া নিষেধ। তিনটা ফল খেতে পারতাম তখন আমি। কারন কেমো যখন নেয়া হয় তখন একজন মানুষের ইমিউন সিস্টেম জিরোতে নেমে যায়। তাই যে ধরনের খাবার হজম হবেনা সেগুলো খাওয়া নিষেধ ছিল। প্রচুর লেবুর রস খেয়েছি। ভিটামিন সি ক্যান্সারের জন্য ভাল। ভিটামিন সি এবং ভিটামিন ডি দুটোই নিয়েছি আমি।
একটা জিনিস আমি খুব বুঝেছি, একজন নারীর নিজেকে ভালবাসতে হবে সবার আগে। আমি একটা মানুষ এজন্য যেমন আমার নিজেকে ভালবাসতে হবে। আর আমি একজন নারী সেজন্য আমাকে আরও বেশি ভালবাসতে হবে। কারণ একজন নারী হলো একটা সংসারের প্রাণ। নিজের জন্য, ছেলেমেয়েদের জন্য, তার পরিবারকে আগলে রাখার জন্য। আমি যদি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকি তবে আমার পুরো সংসারটাই অচল হয়ে থাকবে। আর নিজেকে ভালবেসে নিজের স্বাস্থ্যের যত্নটা ঠিকঠাকভাবে নিতে হবে। সবসময় একটা রেগুলার চেকআপের মধ্যে থাকতে হবে প্রতিটি নারীকে। রেগুলার চেকআপের মধ্যে থাকলে কোন অসুখ থাকলেও অল্পের মধ্যেই জানা এবং সেভাবে দ্রুত চিকিৎসা নেয়া যায়। আর ক্যান্সারের মতো অসুখ থেকেও সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব হয়।
ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট শুরু করার আগে মনোবল শক্ত রাখতে হবে সবার আগে। কারন এ লড়াইটা শুধু নিজের মনের সাথে নিজের শরীরের। চিকিৎসার পুরো সময়টায় মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই যে তিনি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা আমার বন্ধুদের প্রতি আমার পাশে থাকার জন্য। স্বামী সন্তানদের প্রতি কৃতজ্ঞ আমাকে আগলে রাখার জন্য।
.
.
উপরের অংশটুকু ছিল আমার প্রথম দফায় ক্যান্সার জয়ের গল্প। তবে আবারও আমার মাঝে ফিরে এসেছে ক্যান্সার এবং এ স্টেজটা থার্ড স্টেজ-এ। আবারও আমি একইভাবে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছি মনোবল শক্ত রেখে। ইনশাআল্লাহ আবারও লড়াই করে ফিরে আসবো সকলের দোয়ায়। আল্লাহ যেন আমার মনোবল ধরে রাখবার শক্তিটুকু রাখেন।
রায়না মাহমুদ, আলোকচিত্র শিল্পী ( ক্যান্সার যোদ্ধা )