সাইদা সুলতানা মিলি
আমি সাইদা সুলতানা মিলি। মিলি নামেই পরিচিত। একদম সংসারী মানুষ। দুটো বাচ্চা। একসময় তুমুল লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলাম। কাজ করেছি প্রথম সারির নিউজ পেপারের সাথে। একসময় এই ভাল লাগার জায়গা ছেড়ে দিতে হলো বিয়ে,সংসার , তারপর বাচ্চাদের কথা ভেবে।
ছোটবেলা থেকেই আমার ক্র্যাফটিংয়ের প্রতি ভীষণ ঝোঁক ছিল। আমার ছোটবেলা মানে অনেক আগের কথা। তখন এ কাজে তেমন কেউ আগ্রহী ছিলো না । ২০০২ সালে অনার্সে পড়ার সময় বিসিক এর সিরামিক ডিপার্টমেন্ট থেকে মাটির পটারি তৈরি করা শিখেছি । পটারির উপর পেইন্ট,ক্র্যাফটিং করতাম। তখন এসব কাজ একেবারেই নতুন। মানুষ খুব পছন্দ করতো। আমার বিক্রিও বেশ ভালই হতো। বাসায় বসেই সব করতাম। ড্রয়িংয়ের হাতটা খুব ভালো থাকায় আমার কাজগুলো কিছুটা আলাদা হতো এবং সবার নজরে আসতো। এছাড়াও ক্র্যাফটিং এর নানা ক্যাটাগরিতে ট্রেনিং নিয়েছি আমি।

এরপর সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়লাম। বিয়ে, বাচ্চা এবং তাদের স্কুলে এডমিশন এইসব করতে গিয়ে কেটে গেছে ১৩ টি বছর। ২০১৭ সালে ভাবলাম এখন সংসার একটু স্থিতিশীল পর্যায়ে আছে। বাচ্চারাও একটু বুঝতে শিখেছে। কিছু একটা করি..করাটা দরকার ছিল নিজের জন্যে,নিজের ভাবনাগুলোকে ডানা মেলে উড়তে দেওয়ার জন্য সর্বোপরি স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য।
আব্বু তখন জীবনের শেষ প্রান্তে।ক্যান্সার লাস্ট স্টেজে। ভীষণ কষ্টের সময় যাচ্ছে আমাদের। তখন আল্লাহর ইচ্ছা আর রহমতে আমি ক্র্যাফটিং এর কাজ দিয়েই ব্যবসার কাজ শুরু করি। কোথা থেকে কি হলো জানি না। আমার কাজে মা,স্বামী,বোন,ভাই,এমনকি ছোট্ট দয়ীতা ও উমাম প্রাণ দিয়ে সাহায্য করা শুরু করলো। শুরু হলো নতুন জীবন, নতুন পরিচয়।

আমি এর প্রচারণার জন্য ফেসবুকে ‘দয়ীতা’ নামে একটি পেইজ ওপেন করি। তবে পেইজ ওপেন করার দুই মাস আগে থেকে কাজ শুরু করি। আমার মূল প্রোডাক্টগুলো হাতে আঁকা। আমার সিগনেচার প্রোডাক্ট হচ্ছে নিজস্ব অথেন্টিক ডিজাইন করা কপালের টিপ। এখন পিউর দেশি সুতোয় হাতে তৈরি নানা রকম গহনাও করছি। আট থেকে দশ রকম ক্যাটাগরির গহনা আমি তৈরি করি। এর প্রতিটা ডিজাইনের রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। আমার করা টিপগুলো আমার নিজস্ব নকশা। আগে কেউ কখনো এমনটা করেনি। ফলে নতুন ধরণের টিপের চাহিদা এবং এই টিপের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে ক্রেতাদের। দয়ীতার পেইজ ওপেন করার ২৪ দিনের মধ্যেই দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ফিচার করা হয় ।

দয়ীতার হ্যান্ডমেইড টিপের ‘ব্র্যান্ড কোয়ালিটি মেইনটেইন’ এর জন্য আমি প্রফেশনাল টিপের পাতা ছাপায় নিয়েছি। দয়ীতার সকল টিপের ডিজাইন ও গহনা শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে কপিরাইট করা। ওটা ছিল আমার আরো ভালো কিছু করার, আরো একধাপ এগিয়ে যাওয়ার পথে বিশাল অনুপ্রেরণা।
এরপর ধীরে ধীরে গত প্রায় চার বছরে বিভিন্ন দৈনিকে দশ থেকে বারোটা ফিচার ছাপা হয় দয়ীতা নিয়ে। এছাড়াও আমন্ত্রিত হয়েছি কয়েকটি টিভি ইন্টারভিউতে।
উদ্যোক্তা হিসেবে “চাকরি খুঁজবো না ,চাকরি দিব” গ্রুপ থেকে উদ্যোক্তা সম্মাননা পুরস্কার ২০১৮ পেয়েছি। বাংলাদেশ সরকারের এসএমই উদ্যোক্তা হিসেবে এনলিস্টেড হয়েছি কাজের জন্য। পেয়েছি উই তারা এন্টারপ্রেনার অ্যাওয়ার্ড ২০১৯। হয়েছি বেস্ট ইন ক্র্যাফট এ উইনার। এটা আমার জন্যে, আমার কাজের জন্য অনন্য স্বীকৃতি।

আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। আমার বেশিরভাগ গ্রাহক সেলিব্রেটি। এখন অফলাইনে ইভেন্ট এর কারণে সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও অনেক ভাল সাপোর্ট ও অনুপ্রেরণা পাই। তারা সবাই খুব আন্তরিক। আলহামদুলিল্লাহ। বলতে গেলে আমি “ওয়ান ওমেন আর্মি”। জুতা সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব একাই আমাকে করতে হয়। আমার এ শ্রমসাধ্য পথচলায় আন্তরিক ভাবে পাশে আছে আমার পরিবার।
আরও একটি আনন্দের বিষয় যে, দয়ীতার টিপ দেশের বাইরের ক্রেতাদের হাতে হাতেও পৌঁছে যাচ্ছে এর মধ্যে ১৪/১৫ টা দেশে বাংলাদেশীদের হাতে পৌঁছে গেছে রিসেল ও পার্সোনাল ব্যবহারের জন্য। আর দেশে প্রথম শ্রেণির তিনটা ফ্যাশন হাউজেও দয়ীতার টিপ রিসেল করা হয়। এর মধ্যে বিপ্লব সাহার ‘বিশ্বরঙ’ অন্যতম।

আমি শুধু একজন ক্র্যাফটার নই। পাশাপাশি জাতীয় প্রশিক্ষক হিসেবে আছি এসএমই ফাউন্ডেশনের সাথে। আমার নিজের একটি ট্রেনিং সেন্টার আছে পান্থপথে। যার আরেকটি শাখা আছে শান্তিনগরে।অনেকগুলো কোর্স এই ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে আয়োজিত হয়। ধন্যবাদ সবাইকে দয়ীতার পাশে থাকার জন্য, দয়ীতাকে ভালোবাসার জন্য। সবসসময় দয়ীতার পাশে থাকবেন। উদ্যোক্তা হিসেবে সবার পাশে থাকতে চাই,সবাইকে পাশে চাই। আরো চাই প্রতিটি মেয়ে তার নিজস্ব গুণাবলীকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে আসুক অনুপ্রেরণার পথে, হোক স্বাবলম্বী।
সাইদা সুলতানা মিলি (সিইও) দয়ীতা

