0

মেঘ উড়ে যায় মেঘের দেশে

Share

শায়লা শবনম

বিশ্ব একটি বই এবং যারা ভ্রমণ করেন না তারা কেবলমাত্র বইয়ের একটি পৃষ্ঠা পড়েন। বলেছেন কোনো মনীষী। আমি বইয়ের একটি পৃষ্ঠা নয়, পুরো বইটাই পড়ে দেখতে চাই। ভ্রমণের নেশা আমার রক্তের প্রতিটি কণায় কণায় প্রবাহিত। ক্লাস থ্রি বা ফোরে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ পড়ে পর্যটক হওয়ার ভীষণ ইচ্ছে জেগেছিল। পাঠ্যবইয়ের কোনো একটা লেখায় মোনালিসা সম্পর্কে পড়ে খুব ইচ্ছে হতো প্যারিস যাব, লুভ’র মিউজিয়াম দেখব। সুইজারল্যান্ডের স্বর্গভূমি সম্পর্কে পড়ে আর বিভিন্ন সিনেমা দেখে ওখানেও যাওয়ার স্বপ্ন চোখে খেলা করতো দীর্ঘদিন। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কিশোর বেলায় যতটা না নিষিদ্ধ আনন্দ দিয়েছিল, তার চাইতে হিমালয়, কৈলাসের মানস সরোবর ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে জাগিয়েছিল বেশি। টাইম মেশিন আর সায়েন্স ফিকশন পড়ে ইচ্ছে হতো মহাশূন্যচারী হব, সময়ে পরিভ্রমণ করব। তবে দেশের বাইরেই নয়, আমাদের দেশেই এমন সব চমৎকার স্থান রয়েছে যেগুলো ভ্রমণের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য দারুণ সঞ্জীবনী সুধা। 

বেশ কিছুদিন থেকেই প্রচণ্ড হাঁসফাঁস লাগছিল। গত কয়েক মাসে লেখালেখি এবং চাকরির ব্যস্ততার চাপ এত বেশি অনুভব করেছি যে এই যান্ত্রিক জীবন থেকে পালাতে ইচ্ছে হয়েছে বারবার। এর মধ্যে সহকর্মী মোহসিনার কাছে শুনলাম ট্রাভেলিং গ্রুপ ‘গৃহত্যাগী’র সাথে সাজেক যাচ্ছে। সাথে আরেকজন সহকর্মী রূপা মিসও যাচ্ছে। অনেকদিন থেকে আমারও মেঘের দেশ সাজেক দেখার ভীষণ ইচ্ছে। কিন্তু একসাথে তিনজন শিক্ষককে কী ছুটি দেবে কর্তৃপক্ষ! তবুও ইচ্ছেটা জানালাম। এবং পৃথিবীর অষ্টমতম আশ্চর্য, আমাদের ছুটি মঞ্জুর হলো! অতঃপর দুদিনের জন্য পুরোপুরি নেটওয়ার্কের বাইরে যাত্রা। 

২৩ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে ফকিরাপুল থেকে বাসে চড়ে বসলাম আমরা। ২৪ তারিখ সকালে খাগড়াছড়ি গিয়ে পৌঁছালাম। ওখান থেকে সাড়ে তিনঘন্টার পথ সাজেক, যেতে হবে চান্দের গাড়িতে। কিন্তু গাড়ি ছাড়তে দেরি হবে। কারণ হিসেবে জানা গেল সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রতিদিন সকাল ১০টা- সাড়ে ১০টায় সবগুলো গাড়ি একসাথে ছাড়ে। বিকেল ৩টা- সাড়ে তিনটার দিকে আরেকবার। উল্টোদিক, মানে সাজেক থেকেও একইসময়ে একসাথে গাড়ি ছাড়ে। নিরাপত্তার জন্যেই এই ব্যবস্থা। 

একটা বড়সড় রেস্টুরেন্টে আমাদের সকালের নাস্তা এবং অপেক্ষার ব্যবস্থা করেছে ‘গৃহত্যাগী’। তখনও কারও সাথে সেভাবে পরিচয় হয়ে ওঠেনি। নাস্তা খেতে খেতে পরিচয় পর্ব হলো। আমরা তিনজন, সাতক্ষীরা থেকে দুই মেয়ে পরমা এবং রিতাকে নিয়ে তাদের বাবা-মা, প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার আইনজীবী তুহিন ভাই, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হাসিব ও নিশীতা দম্পতি, মাস্টার্সের ছাত্র আলআমিন এবং হোস্ট ফয়সাল। সর্বমোট ১২জন আছি আমরা দলে। খেতে খেতেই টুকটাক আলাপ হলো সবার সাথে। মোহসিনা ওদের সাথে আগেও ট্যুর করেছে। ওর কল্যাণে সবার সাথে সম্পর্কটা সহজ হয়ে গেল। 

সাড়ে দশটায় একসাথে প্রায় শ’খানেক চান্দের গাড়ি ছাড়ল। কিছুদূর এগিয়েই হাসিব ভাই গান শুরু করলেন। তার নিজের লেখা ও সুর করা বরিশালের ভাষায় ‘ও মনু ডাইলে লবণ দেছো নাকি দেবা’ সবাইকে ব্যাপক বিনোদিত করল। গানের সাথে অন্যদের ধুয়ো তোলাটা দারুণ মজার ছিল। আমরাও কিছুক্ষণ হেঁড়েগলায় এটাসেটা গাইলাম। 

আস্তে আস্তে খাগড়াছড়ি শহর, মাইনী নদী, সমতল ভূমি পেরিয়ে আমরা এগিয়ে যাই পাহাড়ি রাস্তায়। পথের দুপাশে পাহাড়িদের ঘরবাড়ি। আমরা যতো সামনে এগোই দীর্ঘ আর উঁচু হচ্ছে পাহাড়ের সাড়ি। দুচোখ ভরে আমি দেখছি দূর পাহাড়ের মুগ্ধ করা সবুজ সৌন্দর্য। নিজের অজান্তেই বারবার বলে ফেলছি, ওয়াও। এটা নিয়ে আলআমিন কিছুক্ষণ ক্ষেপাল আমাকে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষক আমি দ্রুতই বাংলায় চলে এলাম। আমার মুখ থেকে এরপর বারবার শোনা যাচ্ছিল ‘অদ্ভুত সুন্দর’, ‘কী অসাধারণ’ শব্দগুলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে শুনি বাকিরা বলছে ‘ওয়াও’, ‘ওয়াও’!

খাগড়াছড়ি ভেতর দিয়ে রাঙামাটি প্রবেশ করে উঁচু পাহাড়ের উপর সাজেকের অবস্থান। রাস্তাগুলো ভীষণ আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু। কোথাও কোথাও ৪০-৪৫° এঙ্গেলের হবে বোধহয়। চান্দের গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে একবার নিচু থেকে উঁচুতে উঠছে, পরক্ষণেই আবার শা করে নেমে যাচ্ছে একেবারে নিচুতে। এমন রোলার কোস্টারে চড়ে সবাই একটু পরপর হইহই করে উঠছে। 

পথের দুপাশে পাহাড়িদের ঘরবাড়ি। এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে প্রতিটি বাড়ির সামনে ছোট ছোট বাচ্চারা দাঁড়িয়ে আছে। তিন থেকে সাত-আট বছর তাদের বয়স। তারা প্রত্যেকেই হাত নেড়ে স্বাগত জানাচ্ছে গাড়ির যাত্রীদের। এরকম অনেকগুলো ছেলেমেয়ে চোখে পড়লো পুরো পথে। কিছুক্ষণ পরে বাচ্চাগুলোকে দেখলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবার হাত নাড়ানো শুরু হলো। আমি প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে এই অপার্থিব দৃশ্য দেখে যাই।  মনে প্রশ্ন জাগে কে বা কারা পাহাড়ের এই ছেলেমেয়েদের এমন অভিনবভাবে স্বাগত জানালো শেখালো!!          

দূর থেকে আমরা দেখছিলাম পাহাড়ের উপরে ছোট ছোট ঘরবাড়ি। ফয়সাল জানাল ওটাই সাজেক ভ্যালি। কিন্তু অনেকটা রাস্তা ঘুরে এসেও মনে হলো আবার একই স্থানে আছি আমরা। পাহাড়ের গায়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে রাস্তাগুলো উঠে যাওয়ায় এমনটা হচ্ছিল। পথে স্থানে স্থানে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে পড়ছে। উল্টোদিক থেকে গাড়ির সাড়ি নেমে আসায় তাদের জায়গা দিতে হচ্ছে। ভ্যালির একদম কাছাকাছি এসে আমাদের বাহন বন্ধ হয়ে গেল। জানা গেল পথে থেমে গাড়িকে বিশ্রাম দিতে হয়। আমাদের গাড়ি না থামায় এখন বন্ধ হয়ে গেছে। অতঃপর নেমে এসে তাকে বিশ্রাম দেয়া হলো। আমরা হেঁটে হেঁটে উপরে উঠতে শুরু করি। কিন্তু ঢালু পথে সামান্য উঠতেই হাঁপিয়ে যাই। কিছুক্ষণ ছবি টবি তুলে আবার যাত্রা শুরু হয়।

রিসোর্টের সামনে এসেই মনটা ভালো হয়ে গেল। চমৎকার কাঠের একটা দোতলা বাড়ি। ফয়সাল সবার রুম বুঝিয়ে দিলো। আমাদের রুমটা চারজনের জন্য বরাদ্দ। কিন্তু আমরা আছি তিনজন। পেছনে রুমের সাথে লাগোয়া বিশাল খোলা বেলকনি। দূরের নীল পাহাড়ের সাড়ি দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে কথা হারিয়ে ফেলি আমি। এত্ত সুন্দর! এত্ত সুন্দর! শুনলাম ওটা ভারতের মিজোরাম। মাঝখানে দিগন্ত বিস্তৃত খাড়া ঢাল। আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি সে মুগ্ধকর সৌন্দর্যের সামনে।

ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবারের জন্য আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় পাশের রেস্টুরেন্টে। টেবিলে খাবারের সমারোহ দেখে আরেকবার বিস্মিত হই। বাঁশ কোড়ল, শুটকি ভুনা, আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, মাছ ভর্তা, ঘন ডাল এবং ব্যাম্বো চিকেন। আমি সত্যিই মুগ্ধ চমৎকার আতিথিয়েতায়।

বাঁশের মধ্যে চিকেন নিয়ে এলো ওয়েটার, এটাই নাকি ব্যাম্বো চিকেন। আমাদের সামনেই বাটিতে ঢেলে দিলো তরকারিটা। দেখতেই দারুণ লাগছিল। খেতেও বেশ মজা। আমি মাংসের সাথে বেশ খানিকটা ঝোলও নিয়ে ফেললাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বুঝলাম ঝোল নিয়ে কী ভুলটাই না করে ফেলেছি। যত সময় যাচ্ছে আস্তে আস্তে ঝাল বাড়ছে। ভেতরে গিয়ে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সবাই আহ, উহ করে যাচ্ছে। অতঃপর বেশ খানিকটা ডাল খেয়ে কিছুটা কমল ঝাল।

খাবারের পরে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার উঠে পড়লাম চান্দের গাড়িতে। এবারে যাত্রা কংলাক পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে গাড়ি থামিয়ে হেঁটে উপরে উঠতে হবে। কংলাক পাহাড়ে সবাই সাধারণত লাঠি নিয়ে উপরে ওঠে। কিন্তু সামনে গিয়েও আমরা কোনো লাঠি খুঁজে পেলাম না। অনেকেই দ্বিধা করছে উঠবে কী উঠবে না। শেষপর্যন্ত দ্বিধা ঝেড়ে আমি আর মোহসিনা হাঁটা শুরু করলাম। এসেছি যখন উঠেই ফিরব। উঠার পথ একেবারে খাদের কিনার ঘেষে। সামান্য পা পিছলে পড়লেই তেইশ শো ফিট নিচে। তবে আমরা ভালভাবেই উঠে গেলাম উপরে। একটা জায়গায় গিয়ে কিছু ছবিও তুলে ফেললাম। এগুলোই স্মৃতি হিসেবে রয়ে যাবে। 

পাহাড়ে উঠার সময় মানুষের ভিড় তেমন ছিল না। কিন্তু ফিরতে গিয়ে একেবারে মিছিলে পড়ে গেলাম। এখন সবাই উপরে আসছে। আমরা রোদের মধ্যে ফাঁকা সময়টাই বেছে নিয়েছিলাম। নিচে নেমে সবার গলা শুকিয়ে কাঠ। পানির বোতল কিনে একটা দোকানে বসে অপেক্ষা করছি অন্যদের জন্য। কিন্তু কারও দেখা নেই। তবে বসে থাকতে খারাপ লাগছে না। দোকানের ঝাঁপির মধ্যে দিয়ে দূরে তাকিয়ে দেখি দিগন্তে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। তুহিন ভাই তার ক্যামেরা বের করে কিছু ছবি তুলে নিলেন। আমিও মোবাইলে বেশকিছু ছবি নিয়ে নিলাম। সবাই এলো আরও কিছুটা পরে। এবারের গন্তব্য হ্যালিপ্যাড।

গাড়িতে উঠতে গিয়ে ফয়সাল জিজ্ঞেস করল কেউ ছাদে উঠবে কিনা। সাথে সাথেই বললাম, আমি উঠব। কিন্তু রাস্তা সাংঘাতিক খারাপ। সবাই কিছুটা ভয় পেলো। আমি বলি, আরে কিচ্ছু হবে না। গ্রামে বড়ো হয়েছি না! কিন্তু উঠার পরে বুঝলাম এখানে গাড়ির ছাদে উঠে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কতটা ভয়ংকর। ভাঙাচোরা রাস্তায় গাড়ি যখন সাঁই করে উপর থেকে নিচে নেমে যায় বা নিচ থেকে উপরে প্রচণ্ড ভয়ে কেঁপে উঠতে হয়। ফয়সাল পরে জানিয়েছিল এই যাত্রায় এটাই সবচেয়ে খারাপ রাস্তা। আমার পাশে আলআমিন, পেছনে হাসিব ভাই আর ফয়সাল। তিনজন মিলে যেন আমাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে। তারপরও ভেতরের ধুকপুকানি ঠিকই টের পাই। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বোধহয় ছিটকে পড়ে গেলাম। গাড়ি সামান্য পিছলে পড়লে একেবারে তেইশ শো ফিট নিচে। কিন্তু কিছু অর্জন করতে গেলে তো ভয়কে জয় করতেই হয়। আমিও আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। প্রচণ্ড থ্রিল নিয়েই উপভোগ করি ভিন্ন এই যাত্রা।

হ্যালিপ্যাড পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য। এখানে সবাই আসে সূর্যাস্ত দেখতে। কিন্তু আমরা আসতে আসতেই অন্ধকার হয়ে গেছে, তাই কিছুই দেখার নাই আমাদের। ওখানে কিছুটা সময় থেকে আমরা রুইলুই, মানে রিসোর্ট এলাকায় ফিরে আসি। বাইরে চা খেয়ে, কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রিসোর্টে গিয়ে বেলকনিতে বসে যাই। পাশাপাশি বিস্তৃত পরিসরের দুটো বারান্দায় আমাদের দলের কেউ বসে কেউ শুয়ে আছে। পরমা সাউন্ড বক্সে রবীন্দ্র সঙ্গীত ছেড়ে দিয়েছে। শুরু থেকে ওদের পরিবার কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল সবার সাথে। হয়তো সংকোচ ছিল খানিকটা, পরে জেনেছি এটাই নাকি দূরে কোথাও ওদের প্রথম ঘুরতে আসা।  কংলাক পাহাড় এবং হ্যালিপ্যাডে ঘোরাঘুরি আর চায়ের টেবিলে ওরা সহজ হয়ে গেছে।

অন্ধকার আকাশে একটি দুটি তারা দেখা যাচ্ছে। ওপাশে একটার পরে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত বেজে যাচ্ছে। দূরে ছেলেদের একটা দল বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সমস্বরে গান গাইছে। অদ্ভুত মোহময় এক পরিবেশ চারপাশে। ঢাকা থেকে শুনে এসেছিলাম আমাদের গান আর কবিতার আসর বসবে। আমাকেও সেখানে আবৃত্তি করতে হবে। কিন্তু এখন কারও সেদিকে আগ্রহ নেই। চুপচাপ বসে বসে অন্ধকার পাহাড় আর আকাশের তারা দেখতেই ভালো লাগছে। 

দূরের পাহাড়ের পেছনে উজ্জ্বল আলোর আভা। আমি মোহসিনাকে বলি, সম্ভবত পাহাড়ের ওপাশে কোনো শহর আছে। কিন্তু আস্তে আস্তে দেখি আলোটা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। অবাক বিস্ময়ে সেদিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম বিষয়টা কী। কিছুক্ষণ পরেই দেখি সেই আলোর ঝর্ণাধারা থেকে উঠে এসেছে প্রায় পূর্ণ চাঁদ! একেবারে সকালের সূর্যের মতো মুহূর্তের মধ্যেই সেটা উঠে এসে চারপাশে আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। চাঁদের এমন আকস্মিক আগমনে বিস্ময়ে আমি কথা হারিয়ে ফেলি। ভাবতেও পারিনি আলোর উৎসটা চাঁদ ছিল আর সূর্যাস্তের পরে পূর্ণ চাঁদের দেখা পাবো। 

চাঁদটা আস্তে আস্তে উপরে উঠে আসছে আর একটু একটু করে বড়ো হচ্ছে। কখনো মেঘের ভেতর ঢুকে গিয়ে আলোটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আবার মুহূর্তের মধ্যেই মেঘ সরে গিয়ে পূর্ণ আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে দিগন্তজুড়ে। পাহাড়ের উপর থেকে যারা পূর্ণিমা দেখেননি তারা উপলদ্ধিও করতে পারবেন না এই সৌন্দর্যের মাহাত্ম্য। নিজেকে কেমন চন্দ্রগ্রস্ত লাগছে। এমন গৃহত্যাগী জোছনায়ই বোধহয় ঘর ছেড়েছিলেন সিদ্ধার্থ। মনে হচ্ছে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে আমিও বেরিয়ে পড়ি অনির্দিষ্টের উদ্দেশ্যে। কী অর্থ এ ব্যস্ত জীবনের! শূন্য, শূন্য, শেষপর্যন্ত সবই শূন্য!! 

বারবিকিউ আর পরোটায় রাতের খাবার সারা হয়। সাজেক ভ্যালির প্রতিটি রেস্টুরেন্টে আজ বারবিকিউ’র আয়োজন করা হয়েছে। ওখান থেকে ফিরে আমরা আবার বারান্দায় বসি।

কিছুক্ষণ পরে দেখি রূপা কাঁদছে। হয়তো মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, হয়তো এতটা সৌন্দর্য নিতে পারছে না। অথবা হয়তো অন্যকোনো কারণ। মোহসিনা এগিয়ে যায় তাকে সামলে নিতে। আমি উঠি না, বসে থাকি খোলা আকাশের নিচে। কাঁদুক, কখনো কখনো কান্নাটা ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু আমার কান্না পায় না, দুঃখগুলোকে আমি নির্বাসনে পাঠিয়েছি অনেক আগেই। শুধু কেমন একটা শূন্যতা গ্রাস করে নেয় সমগ্র সত্তাকে। পরিবারের সবার কথা মনে পড়ে। সবাইকে নিয়ে আসতে পারলে কী দারুণ হতো! সাজেকের কথা শুনেই আম্মা বলেছিল আমিও যাই। কিনকিন্তু পাহাড়ের কথা ভেবে আমি সাথে আনিনি তাকে। নিজেকে এখন ভীষণ স্বার্থপর মনে হচ্ছে। কী অদ্ভুত আমাদের মন! পিছুটান ছাড়া নিরবিচ্ছিন্নভাবে কিছুই আমরা উপভোগ করতে পারি না। 

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছি বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা 

যা কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্ত্বনা….. 

প্রচণ্ড ব্যথায় মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি পা নাড়াতে পারছি না ব্যথায়। এ ব্যথার ধরণ আমার খুব পরিচিত, মাঝেমাঝেই সে আমার সাথে দেখা করে যায়। এমনটা হলে ঘুমাতে পারি না সারারাত, জেগে বসেই কাটিয়ে দেই। সন্ধ্যার পর থেকেই টের পাচ্ছিলাম চিনচিনে ব্যথাটা। ফয়সালকে বলেছিলাম গরম পানির ব্যবস্থা করা যাবে কিনা। সে চেষ্টা করেছে, কিন্তু মাঝরাত পর্যন্ত রেস্টুরেন্টগুলো এত ব্যস্ত ছিল যে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আর এখানে সবকিছু সোলার শক্তিতে চলে। চাইলেই অনেককিছু করা যায় না। কিছুতেই ঘুমাতে পারছি না ব্যথায়। অগত্যা উঠে বসে থাকি মধ্যরাত থেকে। আর মনেমনে নিজেকেই ধিক্কার দেই, কে বলেছে তোমাকে লাফিয়ে লাফিয়ে পাহাড়ে উঠতে! এখন নিজেই ভুগতে থাকো!

ভোর হয়ে এসেছে প্রায়। আস্তে আস্তে উঠে পড়লাম। মোহসিনা বলেছিল শাড়ি নিয়ে আসতে। মনে হলো ঘুমাতে যখন পারছি না শাড়িটা পরে ফেলি। কিন্তু শাড়ির সাথে উঁচু স্যান্ডেল বা জুতা আনি নাই। অতঃপর কেডসটাই পায়ে গলিয়ে নিলাম। অতঃপর দরজা খুলে বাইরে চলে এলাম সূর্যোদয় দেখব বলে। 

বাইরে তাকিয়ে আমি বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে যাই। সামনে দিগন্তজোড়া শুভ্র সমুদ্র! ওগুলো নাকি মেঘ! গতকাল সবাই বলছিল এই সময়ে মেঘ দেখা যায় না। শুনে কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল। মেঘ দেখার জন্যেই তো সাজেক আসা। সেই মেঘই যদি না দেখা যায় তাহলে তো বেড়ানোটা পূর্ণ হবে না। আজ চোখের সামনে মেঘের মহাসমুদ্র দেখে বিস্ময়ের ঘোরে স্তব্ধ হয়ে যাই। এরচাইতে সুন্দর, এরচাইতে স্বর্গীয় দৃশ্য আর কি আছে! প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ অবলোকন করে যাই সেই অপার্থিব দৃশ্য। 

এর মধ্যেই সবাই উঠে গেছে। মেয়েরা কেউ কেউ শাড়ি পরেছে। সবার হাতেই ক্যামেরা। তুহিন ভাই মেঘের ছবি নিচ্ছে, হাসিব ভাই নিশীতাকে মডেল করে ছবি তুলছে। আমিও প্রকৃতির সাথে সাথে সবার ছবি তোলা শুরু করলাম। আমাদের বেলকনি থেকে ভালো ভিউ আসছে। সবাইকে বললাম এপাশে চলে আসতে। কিছুক্ষণ পরে সূর্যটা আলো ছড়িয়ে হেসে উঠল দিগন্তজুড়ে। অতঃপর সকালের সূর্য, মেঘ আর প্রকৃতির সাথে চললো নিজেদের ফটোসেশন। 

ফটোসেশন শেষে সবাই লুসাই গ্রামে গেল। ওখানে ভাড়ায় লুসাই জাতির ড্রেস পাওয়া যায়। লুসাই মেয়েরা অতিথিদের পরিয়েও দেয় ড্রেসগুলো। সবাই ওগুলো পরে ছবি তুলবে। পায়ের ব্যথার জন্য আমি গেলাম না। বসে বসে মেঘ দেখতে লাগলাম। এরমধ্যে অন্যান্য রিসোর্ট থেকে কিছু ছেলেমেয়ে এলো আমাদের রিসোর্টে। এখান থেকেই নাকি সবচেয়ে ভালো ছবি আসে। ওরা নিজেরা ছবি তুললো, আমিও বেশকিছু তুলে দিলাম ওদের। আর তারপর একা একা বসে আস্তে আস্তে মেঘের বাস্প হয়ে উড়ে যাওয়া দেখতে লাগলাম। 

সাড়ে নয়টার মধ্যে রেডি হয়ে চান্দের গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা। চলে যাচ্ছি সাজেক ভ্যালি থেকে। রাতের বাসে ঢাকায় ফিরবো। এখন বের হতে না পারলে যেতে হবে বিকেলে। রিসোর্ট ছেড়ে না দিলে আরেকদিনের ভাড়া গুণতে হবে। আর ছেড়ে দিলে এ সময়টা বাইরে ঘোরাঘুরি করতে হবে। সেটা আরও কষ্টদায়ক। পায়ের ব্যথার জন্য আমার সকালের নাস্তা রুমেই দিয়ে গিয়েছিল ওরা। কিন্তু চান্দের গাড়িতে উঠতেও বেশ কষ্ট হলো। 

আবার সেই উঁচুনিচু রাস্তা, আবার সেই রোলার কোস্টারে যাত্রা। গতকাল আসার সময় সবার কী প্রচণ্ড উচ্ছ্বাসই না ছিল । কিন্তু আজ সবাই বেশ চুপচাপ। মন খারাপ আমাদের। এই স্বর্গীয়ভূমি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু যেতে তো হবেই। গাড়ি এগিয়ে চলে। আবারও পাহাড়ি ছোট বাচ্চাদের হাত নেড়ে জানানো উষ্ণতা দেখি। বিকেলে খাগড়াছড়িতে আলুটিলা গুহা এবং ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে যাই সবাই। আমি রিসাং ঝর্ণায় যাওয়ার প্ল্যান করে এসেছিলাম। কিন্তু এই পা নিয়ে যাওয়াটা উচিত হবে বলে মনে হলো না। অন্যকেউও খুব একটা আগ্রহ দেখাল না। তাই আশেপাশে ঘোরাঘুরি আর কিছু কেনাকাটা করেই সময় পার হলো। 

খাগড়াছড়ি শহরে সবকিছু কেমন কৃত্রিম, কেমন সাজানো মনে হচ্ছে আমার কাছে। সাজেকের সৌন্দর্যের কাছে এগুলো ভীষণ ম্লান মনে হচ্ছে। দলের সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়াটাও কেমন ইমোশনাল করে দেয়। কী আশ্চর্য, একদিন আগেও কেউ কাউকে চিনতাম না। অথচ আজ আবার কোনো এক ভ্রমণে একসাথে হওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলি আমরা। হয়তো দেখা হবে, অথবা শুধুই প্রতিশ্রুতি হয়ে রয়ে যাবে। কিন্তু স্বর্গের দ্বার সাজেক ছুঁয়ে আসার স্মৃতি আমাদের সাথে রয়ে যাবে অনেকদিন।