এপি তালুকদার
“ভ্রমণ” শব্দটা বলতে গেলেই আমার ভ্রমরের কথা বলতে ইচ্ছে করে। মনে মনে ভাবি আমার জীবনটা যদি ভ্রমরের মতো হতো। এটা শুনে অনেকেই ভাবতে পারেন এতো কিছু থাকতে ভ্রমর কেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে বলবো, তাদের অবাধ জীবনের জন্য। প্রশ্ন তুলতে পারেন আরও অনেক কিছুই তো অবাধ জীবন যাপন করে তাহলে ভ্রমরই কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে অনেক কিছুই বলতে হবে যেমন – আমি কেন ভ্রমণ করি? কি লাভ এটা করে? আমার উদ্দেশ্য কি? এমন অনেক কিছু।
এখন আসি আমি কেন ভ্রমণ করি….?
আমি ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি ভ্রমণে মানুষের জ্ঞান বাড়ে…আর আমরা সবাই আমাদের জ্ঞানের প্রসার ঘটাতে চাই। সেই জায়গা থেকেই হয়তো ভ্রমণের প্রতি গভীর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল সেই ছোটবেলাতেই। কিন্তু ছোটবেলাতে সেই জ্ঞানের প্রসার ঘটাতে না পারলেও বড়বেলাতে সেই সৌভাগ্য আমার হয়েছে এবং প্রতিটি ভ্রমণ খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি এবং প্রতীয়মান হয়েছি যে ভ্রমণে শুধু মানুষের জ্ঞানই বাড়ে না ভ্রমণ মানুষের মধ্যে বিনয় এবং ভাতৃত্বের জন্ম দেয়, গড়ে তোলে পারস্পরিক মেলবন্ধন। নিজের সংস্কৃতির বাইরেও যে অসংখ্য যে সংস্কৃতি বিদ্যমান তা জানতে সহায়তা করে।
কি লাভ ভ্রমণ করে,,,,?
এটার উত্তর আমার কাছে একটাই “মানসিক প্রশান্তি” যা আমি সবসময় সবাইকে বলি। এই ধরেন কোথাও ভ্রমনে বের হয়েছি সেটা হতে কোন পাহাড়ে, সাগরের কোলে, ঝর্ণায়, ঘন জঙ্গলে বা সৌন্দর্য ভরা কোন সাধারণ গ্রামে। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ কোন জায়গা দেখে চোখ আটকে গেল, মনে হলো আজ এখানেই রাত্রি যাপন করতে পারলে মন্দ হতো না এবং অনুভব হতো ভূখণ্ডেই স্বর্গের সুখ ! সেই সুখ খুঁজতেই তাবু খাটিয়ে ফেললাম। জায়গাটি যদি হয় কোন পাহাড়ের চূড়া বা নদীর পার, জঙ্গল কিংবা ঝর্ণার কূল তাহলে এক কাপ চা অথবা কফি আপনার সুখকে বাড়িয়ে দিবে আরো বহুগুণ। এসব জায়গায় নীরবে বসে থাকতে পারাটাও এক প্রকার মানসিক প্রশান্তি। এই প্রশান্তির জন্যই ভ্রমণের সাথে আমি ভ্রমরের সাদৃশ্য খুঁজে পাই। তারা যেমন তাদের পছন্দসই জায়গায় চাক তৈরি করে সেখানে শান্তির বসবাস শুরু করে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পরে সেই জায়গা ত্যাগ করে নতুন কোন ভালো লাগার জায়গা খুঁজে বের করে প্রশান্তির খোঁজে। ভ্রমণও আমার কাছে ঠিক তেমনই প্রশান্তির জায়গা।
ভ্রমণের উদ্দেশ্য কি…?
ভ্রমণের উদ্দেশ্যই হলো অজানাকে জানা এবং ইতিহাসের খোঁজে ছুটে চলা। অজানা অনেক ইতিহাস বিদ্যমান যার কিছুই আমরা জানি না, সেই ইতিহাসকে জানতেই আমার এই ছুটে চলা। এই ছুটে চলার মাধ্যমেই আমি চাই স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ভ্রমণ সম্পর্কে উৎসাহ এবং ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি করতে।
এবারে চলে যাই নিজের গল্পে,,,,
‘অভিযাত্রী’ নামে আমাদের একটা গ্রুপ আছে এবং আমরা প্রায়ই বিভিন্নরকম এক্টিভিটি করে থাকি। সাইকেলের হাতেখড়ি আমার ছোটবেলায় হলেও ঢাকার রাস্তায় প্রথম সাইকেল চালিয়ে বাংলামোটর থেকে গোলাপবাগে যাই ২০১৭ সালে । কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে চার বন্ধু মিলে ১১০ কিলোমিটার পথ সাইকেলে পাড়ি দিয়ে ঢাকা থেকে চলে যাই ফরিদপুরে। এ যাত্রার পর ঢাকায় ফিরে সাইকেলের প্রতি আমার আগ্রহ আরও প্রবল হয় এবং সে মাসেই নিজে সাইকেল কিনে ফেলি। বাসা থেকে আমার কর্মস্থল ১৩ কিলোমিটার পথ রোজ সাইকেলেই পাড়ি দিই। এতে জ্যাম এড়ানোর পাশাপাশি অভিজ্ঞতাও জমা হতে থাকে।
কিন্তু ওই যে বললাম ভ্রমরের কথা? আমি সাইকেল নিয়ে উড়তে চাচ্ছিলাম ভ্রমরের মতো। এজন্য অভিজ্ঞতার খাতায় একটু এডভেঞ্চার যোগ করতে চাই। ভাবনার সাথে খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে চলে গেলাম দার্জিলিংয়ে। পাহাড়ের উঁচুনীচু রাস্তা, নিরিবিলি পরিবেশ একদিকে যেমন খুব রোমাঞ্চকর অন্যদিকে খানেকটা ভয় ও আশংকাও কাজ করছিল। ভাবছিলাম হয়তো আরও খানেকটা প্রস্তুতির দরকার ছিল। তবে সে চিন্তা মুহূর্তেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে চলি। কারন ভয়কে জয় করাই আমার কাজ। ফুলবাড়ি থেকে শুরু করে গজল ডোবার ক্যানেল ধরে, গরুমাথা, বিন্দু, গরুবাথান, লাভা, রিসপ, ইচ্ছে গাঁ, জেলো পার্ক, কালিম্পং, তিস্তাবাজার, দার্জিলিং, মিরিক ভ্রমণ শেষে একটানা ১২ দিন সাইকেল চালিয়ে দেশে ফিরি। দেশে ফেরার পর মনে হচ্ছিল সত্যিই আমি ভয়কে জয় করতে পেরেছি এবং আমার সাইক্লিংয়ের প্রতি ঝোঁক আরও বেড়ে যায়। এখন পর্যন্ত ২৬টি জেলা ঘুরে বেড়িয়েছি। সাইকেল হচ্ছে একটি পরিবেশ বান্ধব বাহন তাই ভ্রমণের সময় আমি এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করি, যেন সবাই সাইক্লিং এর প্রতি মনোনিবেশ করে।
গতবছর রোজার ঈদে লকডাউনের সময় ঢাকা থেকে ২৫৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বগুড়ার সান্তাহারে আমার গ্রামের বাড়ি গিয়েছি সাইকেল চালিয়ে। তখন সবাই আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছে। তবে আমার সাইকেলের এই পথ চলা সবসময় খুব সহজ হয় তা নয়। শুরুতে অনেকের কাছ থেকে মন খারাপ করার মতো কথা শুনতে হয়েছে। আমি রেগে না গিয়ে তাদের বুঝিয়েছি এবং দেখা যায় যুক্তি দিয়ে বোঝানোর পর বেশিরভাগ মানুষই মেনে নেয়। পরিবর্তন একদিনেই চলে আসবে সেটা আমি মনে করিনা। তাই কেউ খারাপ ব্যবহার করলেও তার জবাবে আমি খারাপ ব্যবহার না করে বুঝিয়ে বলি। রাস্তাঘাটে দূর্ঘটনা,রক্তাক্ত লাশ দেখে থমকে যাই কখনও। আবারও মনোবল শক্ত করে এগিয়ে চলি। কারন, আমার যে এই পথ চলাতেই আনন্দ…..।
এপি তালুকদার, স্পোর্টস টিচার, চিটাগাং গ্রামার স্কুল ঢাকা, ফুটবল রেফারি- বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন, সাইক্লিস্ট, অ্যাথলেট ও ম্যারাথনিস্ট