0

প্রাচীন নিদর্শন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ‘হাম্পি’

Share

কাজী আসমা আজমেরী

তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ২০০৯ সালে। এটা আমার  প্রথম ইন্ডিয়া ভ্রমণ সময়ের কথা। বেঙ্গালুরু ট্রেন স্টেশনে মহীশূর যাব বলে ফরেন কোটায় টিকেট কেনার জন্য ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলাম। এখানেই পরিচয় হয় এক স্প্যানিশ দম্পতির সাথে। তাদের কাছেই  ‘হাম্পি’ সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। হাম্পি হচ্ছে এমনই একটি চমৎকার জায়গা যে কারণে এই দম্পতি স্পেন থেকে এখানে ছুটে এসেছেন। হ্যাঁ আমি এই হাম্পির সাথে প্রথম পরিচয়ের কথাটিই বলছিলাম লেখার শুরুতে।

সব শোনে আমিও মহীশূর যাওয়ার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলি এবং তাদের সাথে হাম্পি যাওয়ার  টিকেট কিনে নিই। যে শহরটি বেঙ্গালুরু স্টেশন থেকে সাড়ে চারশো কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। তারপর হঠাৎই চলে গেলাম বিশ্বের অন্যতম শান্তিময় স্থান হাম্পিতে। বিশেষ করে বিদেশি ট্রাভেলাররাই  এখানে সুন্দর সময় কাটাতে আসেন বেশি। তখনও পর্যন্ত ইন্ডিয়ানদের আনাগোনা এখানে খুবই কম ছিল। তবে এখানকার বিরুপাক্ষ মন্দির  ইন্ডিয়ানদের কাছে বিখ্যাত। 

যদিও এখানকার ঐতিহ্য আমাকে আরো বেশি মুগ্ধ করেছে। এছাড়াও মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ, বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা আমার সেই তরুণ ছোট্ট হৃদয়কে তখন ছুঁয়ে গিয়েছিল। সেই সময় আমার বয়স আরো কম ছিল। এখানে এসে নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচয়ের এক বিশাল সুযোগ পেয়েছি। বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের সাথে পরিচিত হতে পেরেছি। 

এবারে একটু হাম্পি  সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক। দক্ষিণ ভারতের উত্তর কর্ণাটকের বেল্লারি জেলায়  অবস্থিত হাম্পি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও সেরা ঐতিহাসিক স্থান। এটি হোসিপেট সিটি থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী শহর ছিল। হাম্পি একটি ছোট জায়গা, পঁচিশ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে যার অবস্থান।

 হাম্পি পুরোপুরি পর্বতমালা দ্বারা বেষ্টিত। হেমকূট, মাল্যবন্ত এবং মাতঙ্গ এই তিনটি পাহাড় বলতে গেলে প্রহরীর মতো এই শহরটিকে রক্ষা করছে। তৃতীয় শতকে (যীশুখ্রীষ্টের জন্ম আগে) হাম্পি অশোক রাজার শাসনামল ছিল বলে প্ৰমাণ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে ভারতীয় জীবন ও সংস্কৃতি যে কত উন্নত ছিল তা এই শহরের ধ্বংসাবশেষ দেখলেই অনুমান করতে পারি। 

এর ঐহিত্যবাহী সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যের মনোরম সৌন্দর্য আপনার মনকে বার বার টেনে আনতে চাইবে। হাম্পি দু’শ বছরেরও বেশি সময় ধরে (১৩৩৬- ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে) বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। পুরো হাম্পি শহরটিই যেন যত্ন করে গড়া এক অনবদ্য স্থাপনা। শহরের চারদিকেই ছড়িয়ে আছে মন্দির, স্থাপত্য, সৌধ, প্রাসাদ সহ একাধিক স্মারক। এছাড়াও রয়েছে অনেক অভিজাত বাসগৃহ, হাতিশালা, রাণীর ঘর, রাণীর বিলাসবহুল স্নানঘর, লোটাস মহল। এসব যেন আমাদের এক স্বপ্নময় জগতে নিয়ে যায়। এই স্মারকগুলো ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। হাম্পি বিশ্বের বিখ্যাত প্রাচীন মহানগরীগুলোর মধ্যে অন্যতম। 

আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা বাংলাদেশ থেকে খুব কম খরচেই  এই চমৎকার জায়গায়টিতে  ভ্রমণ করা সম্ভব। আমি বলে দিচ্ছি ‘রোকেয়ানামা’র পাঠকদের জন্য সহজে ভ্রমণের সেই উপায়টি। কলকাতা থেকে ট্রেনে কিংবা প্লেনে বেঙ্গালুরু নামতে হবে প্রথমে। বেঙ্গালুরু থেকে ট্রেনে করে হসপেট নামে একটি শহরে নামতে হবে। সেখান থেকে মাত্র দেড়শ রুপি ট্যাক্সি ভাড়া দিয়েই চলে যাওয়া যাবে ঐতিহ্যবাহী  হাম্পিতে।

 আর হাম্পিতে হোটেল ভাড়াও খুব কম। মাত্র পাঁচশ থেকে বার’শো রুপির মধ্যেই পাওয়া যাবে    চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সব হোটেল । আর খাওয়ার জন্য অনেক কিছুই রয়েছে। যদিও নিরামিষভোজীদের জন্য এখানকার খাবার-দাবার অনন্য। 

আগেই বলেছি, জায়গাটির সৌন্দর্য বারবার আপনাকে টেনে নিতে চাইবে। আমারো তেমনটিই হয়েছিল। গতবছর ২০২১ সালের ২২মার্চ আবারও গিয়েছিলাম সেই হাম্পি শহরে তার সৌন্দর্যের টানে। যদিও সেখানকার হিপ্পি আইল্যান্ডটি  ধর্মীয় কারণে এখন আর নেই। তারপরেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনায় মুগ্ধ হয়েছি আবারো। যে কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে পর্যটক ছুটে আসে। আর খরচটাও বলতে গেলে এখনো সেই আগের মতোই রয়েছে।

আমি সবসময়ই বলি সব মেয়েদেরই একবার হলেও একা ট্রাভেল করা প্রয়োজন। একা না হলেও অন্তত ভ্রমণ করুন। ভ্রমণের মাধ্যমে আপনি ফিরে পাবেন আত্মবিশ্বাস। দেখুন না বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষগুলো কিভাবে আনন্দ করছে, বেঁচে থাকতে সংগ্রাম করছে। ভ্রমণের মাধ্যমে মন প্রফুল্ল থাকবে, মন থেকে সকল ডিপ্রেশন দূর ঠেলে দিয়ে আপনাকে প্রতিদিন নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা যোগাবে। 

কাজী আসমা আজমেরী, ১২৮ দেশ ভ্রমণ করা বিশ্ব পরিব্রাজক