(এপি তালুকদারের ‘একলা ভ্রমণের গল্পকথা’ শিরোনামে ১৪ দিনের ভ্রমণ কাহিনির আজ রয়েছে চতুর্থ পর্ব। যারা আজই প্রথম পড়ছেন তারা এক ঝলক চোখ বুলিয়ে আসতে পারেন আগের তিনটি পর্বে। রোকেয়ানামা ‘তেপান্তর পেরিয়ে’ বিভাগে নারীদের ভ্রমণের নানা গল্প তুলে ধরার চেষ্টা করে আসছে।)
এপি তালুকদার
একা একা ঘুরতে আসায় মনে হয় ঘুম আমার সাথে আড়ি নিয়েছে। এতোদিন আমি এটাই বিশ্বাস করতাম যে, আমি যে কোন জায়গায় যে কোন পরিবেশে ঘুমিয়ে পড়তে পারি। কিন্তু না। এই ভ্রমণে এসে আমার সেই ধারণার এবার পরিবর্তন হয়েছে। ঘুমের সাথে আমার প্রেমটা এবার হয়ে উঠছে না! ঘুমের সাথে প্রেম তৈরি করার জন্য হলেও আরো বেশি বেশি একা বের হতে হবে। ঘুমের ক্ষেত্রে কোন সমঝোতা করা একেবারেই চলবে না!
‘অনেকখানি ঘুমিয়েছি’ ঘুম ভাঙতেই যখন এমনটি মনে হচ্ছিল তখন ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি ভোর ৪ টা। মেজাজটা বিগড়ে গিয়েছিল খানেক। কেননা ঘুমিয়েছি রাত ১ টায়। যাক কি আর করা! আরো খানিকটা এপাশ-ওপাশ করে উঠে গেলাম। ফ্রেশ হয়েই রেডি হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম তখন সময় ভোর ৫:৫০ মিনিট। দিল্লি থেকে দেরাদুন এর ট্রেন ৬:৪৫ মিনিটে ছাড়বে। অনেকটা সময় আছে কিন্তু কি আর করার? ভাবলাম স্টেশনে গিয়েই বসে থাকি। হোটেল রিসিপশনের দাদা ঘুমাচ্ছিলেন। ডাকতে মায়া লাগলেও স্বল্প স্বরে ডাকলাম। দাদা লাফ দিয়ে উঠেই বললেন, “আপকো জানা হ্যাঁয়?” বললাম- হা জানা হ্যাঁয়! “ইহাপে সাইন কারদিযে দিদি।” সাইন করে ৬:০০টার মধ্যে আমি বেরিয়ে পড়লাম। হোটেল থেকে স্টেশনের দূরত্ব মোটামুটি ৩ মিনিট। স্টেশনে পৌঁছে সেখানে দায়িত্বরত একজনকে জিজ্ঞেস করলাম ১২০১৭ নাম্বার ট্রেন কোন প্ল্যাটফর্ম এ আসবে? উত্তর আসলো “১৬ নাম্বার।” চলে গেলাম ১৬ নাম্বার প্ল্যাটফর্মে।
ট্রেন তখনো আসেনি। গুরুর সাথে ফোনে আলাপচারিতা চলছে, এর মধ্যেই ট্রেনের আওয়াজ শুনতে পেলাম। সাথে এনাউন্সমেন্ট ‘দেরাদুন যানেকে লিয়ে শতাব্দী এক্সপ্রেস ১৬ নাম্বার প্ল্যাটফর্ম মে আর্যাহি হ্যাঁয়।” ফোন রেখে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আছি C8 বগির জন্য। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে বেশ অনেকটা দূরে চলে গেলো বগি। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম বগির দিকে এবং লাইন ধরে ট্রেনে উঠলাম। উঠে দেখি আমার সিটে একজন বসে আছেন। আমি বললাম, দাদা এটা আমার সিট সে বলে ‘না মেরা হ্যাঁয়!’ আমি বললাম দেখেন আমার টিকেটে উইন্ডোজ লেখা। এটা দেখার পর তিনি সরে গেলেন!
ট্রেন চলছে! ট্রেনের জানালা দিয়ে সকালের প্রকৃতি দেখতে দারুণ লাগছে। কিছুক্ষণ পরেই চা দিয়ে গেলো। মনটা আরো ভালো হয়ে গেলো আর হ্যাঁ দুধ চা ছিলো। চা খেতে খেতে চলছি আর সকাল উপভোগ করছি। মেঘলা সকালে ঘুম না হওয়া ক্লান্ত শরীরের জন্য এমন এক কাপ দুধ চা-ই যথেষ্ট। এর কিছুক্ষণ পরেই নাস্তা দিয়ে গেলো। ব্রেড,বাটার, ডিম অমলেট সাথে সবজি আর সস। সকালের নাস্তা হিসেবে দারুণ! নাস্তা শেষে আবারো জানালা দিয়ে প্রকৃতির সোন্দর্যে বিমোহিত হচ্ছি আর মাঝে মাঝে পাশের সিটে বসা গভিন্দ দার সাথে আলাপ করছি। তিনি দিল্লিতেই থাকেন, দেরাদুন যাচ্ছেন তাদের ফ্যাক্টরির কাজে। একসময় তিনি যখন জানলেন, আমি বাংলাদেশি তখন তিনি বেশ অবাক হলেন আমার হিন্দি শুনে এবং বললেন, আমাকে দেখে বা কথা বলে নাকি কেউ বলবেনা আমি বাংলাদেশি। জানালা দিয়ে প্রকৃতি উপভোগ করা এবং অল্প-স্বল্প আলাপের মাঝেই বেলা ১:২০মিনেটে চলে এলাম দেরাদুন স্টেশনে।
ট্রেন থেকে নেমেই শুরু করলাম হাঁটা। এদিক সেদিক হেঁটে পাঁচটা হোটেল দেখে একটাতে উঠে গেলাম। স্টেশনের পাশেই গান্দি রোডের ‘হোটেল নিউ মতি মাহল।’ রুমে ব্যাগ রেখেই বেরিয়ে পড়লাম। সহস্ত্রধারা ঝরনা দেখতে যাবো বলে যেই না নিচে নামলাম, দেখি একটি দোকানে লাইন ধরে মানুষ কি যেনো খাচ্ছে। আমারও আগ্রহ হলো আর দেরি না করে এগিয়ে গেলাম দেখার জন্য। চাওল রাজমা হাফ ৩০ টাকা দিয়ে খেয়ে নিলাম। তারপর রোড ক্রস করে অটোতে উঠে গেলাম প্যারেড গ্রাউন্ড যাওয়ার জন্য, সেখান থেকে বাসে করে যেতে হবে সহস্ত্রধারা। প্রিয়াঙ্কা নামের এক দিদির সাথে কথা বলে জানতে পারলাম সিটি বাস যায় এখান থেকে এবং তিনিই আমাকে বাসে উঠিয়ে দিলেন। এক ঘন্টা ১৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম সহস্ত্রধারা, এটাই এই বাসের শেষ স্টপেজ। তবে ম্যাপ বলছে স্টপেজ থেকে ঝরনা ১ কিলোমিটার।
হাঁটতে শুরু করলাম এবং কিছুদূর যাওয়ার পরই চোখে পড়লো প্রচন্ড স্রোতে ঝরনা বয়ে আসছে! যতোই সামনের দিকে এগুচ্ছি ঝরনার অবিরাম স্রোতধারা আর মনোরম দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করছে, ঘুম না হওয়া ক্লান্ত শরীর ও মনের ক্লান্তি জুড়িয়ে দিচ্ছে। ঝরনার পানি পাহাড় থেকে স্রোতধারার সাথে বয়ে আসতে দেখে আনন্দে মন নেচে উঠছে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় জানতে পারলাম প্রচণ্ড স্রোতের কারণে পাথর পড়ে সামনের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। কি আর করা? শেষ পর্যন্ত মানে যেখান থেকে রাস্তা বন্ধ হয়েছে সেই পর্যন্ত গিয়ে অনেকটা সময় বসে থেকে ফিরে এলাম। যতটুক সম্ভব দূর থেকেই উপভোগ করলাম এর অপার সৌন্দর্য। ফেরার পথে রোপিংয়ের খবর নিলাম। জন প্রতি ২০০ রুপি লাগবে করতে। তবে এতে নিজের কোন এক্টিভিটি নেই, তাই আর ইচ্ছে করলোনা। ফেরার পথে বাসে প্যারেড গ্রাউন্ড তারপর সেখান থেকে অটোতে গান্দি রোডের হোটেলে। দিন শেষ…. আজকের মতো এতোটুকুই। জীবন সুন্দর..!
লেখা: এপি তালুকদার,স্পোর্টস টিচার, চিটাগাং গ্রামার স্কুল ঢাকা, ফুটবল রেফারি- বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন, সাইক্লিস্ট, অ্যাথলেট ও ম্যারাথনিস্ট