(এপি তালুকদার ‘একলা ভ্রমণের গল্পকথা’ শিরোনামে তাঁর ১৪ দিনের ভ্রমণ কাহিনি শেয়ার করেছেন রোকেয়ানামার সাথে। আজ রয়েছে তৃতীয় পর্ব। যারা প্রথম পড়ছেন তারা এক ঝলক চোখ বুলিয়ে আসতে পারেন আগের দুটো পর্বে ।)
এপি তালুকদার
ভোর ৪ টায় ঘুম ভেঙে গেলো, ভোরের আলো ফোটেনি তখনো। আমার সিট ওপরে হওয়ার কারণে নামতেও ইচ্ছা করছিল না তাই শুয়েই থাকলাম। এপাশ- ওপাশ করছি কিন্তু শুয়েও থাকতে ইচ্ছা করছে না আর। তাই আলো ফোটা মাত্রই নিচে নেমে জানালার পাশে বসে গেলাম, কেননা নিচের সিটের দাদাও বসে আছেন। তিনি ঘুম থেকে না উঠলে হয়তো আমারো বসা হতো না। ট্রেন চলছে, একে একে সবাই ঘুম থেকে উঠে গেলো, সুমন দিদি গুড মর্নিং জানালেন। সবাই একসাথে সকাল উপভোগ করছি। এরই মধ্যে জানালা দিয়ে বাইরে চোখ পড়তেই দেখি ময়ূর পেখম মেলে আছে, কি যে দারুন লাগছিলো! মাঝে মাঝেই বানরদের দেখা মিলছিল। দারুণ কাটছিল সকালটা।

শুরু হলো সিন্টু চিত্রকর দাদার সাথে গল্প। এই গল্প, সেই গল্প হতে হতেই জানলাম উনি একজন মুসলিম এবং তাদের পুরো পরিবার আর্টিস্ট। তারা পুরো পরিবার লালকেল্লার একটা প্রোগ্রামে আর্ট করবেন বলে মোট ৮ জন যাচ্ছেন সেখানে। ঠিক ১১ টায় নামলাম দিল্লি স্টেশনে। আমি এবং দাদাদের পরিবার এক সাথে দাঁড়িয়ে আছি যে, ভিড় একটু কমলে বের হবো। এর মধ্যে দেখি একটা মেয়ে আমাকে দিদি দিদি বলে ডাকছে। সেই মেয়েটি সুমন দিদির। দিদি আমার কথা বলাতে ও আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। দারুণ একটা অনুভূতি! এগোতে শুরু করলাম পাহাড়গঞ্জের দিকে। ১ নাম্বার প্ল্যাটফর্ম ধরে এগোচ্ছি, এক্সিট সাইন দেখে বেরিয়েও গেলাম। এবার শুরু হলো আসল নাটক! আমাকে প্রায় চারদিক থেকে ঘিরে ফেললো, ‘দিদি হোটেল চাই আচ্ছা হোটেল হে!’ কেউ বলছে ‘দিদি কাহা যানা হে অটো হে ছোড় দেংগে।’ পুরো পাগল পাগল লাগছিলো!!’

যাই হোক সব কিছু কাটিয়ে নিজের মতো খোঁজে একটি হোটেলে উঠলাম, নাম ‘হোটেল ক্যাপিটাল’। রেসিডেন্সি স্টেশন থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে। এতো কাছে হোটেল নেওয়ার একটাই কারণ সেটা হলো কাল সকালেই দিল্লি স্টেশন থেকে আমার দেরাদুন যাওয়ার ট্রেন। যাক, হোটেলে গিয়ে সামান্য ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়লাম কুতুব মিনারের উদ্দেশ্যে। বাসে করে যাবো বলে আমাকে প্রায় ৩ কিলোমিটার হেঁটে সুপার বাজার গিয়ে বাসে উঠতে হবে। বাসে করে যাওয়ার আরেকটা কারণ হলো, গতকাল রাতে ট্রেনে গল্পের আড্ডার সময় এক দিদির কাছ থেকে জেনেছি দিল্লিতে মেয়েদের জন্য বাস ফ্রি! গুগোল ম্যাপ অন করে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম সুপার বাজারের দিকে। এমন সময় মেসেঞ্জারে বান্ধবি পিংকির মেসেজ ‘ফ্রি আছো?’ কল করলাম আর অনেকক্ষণ কথা হলো। কথা বলতে বলতেই কখন যেন পৌঁছে গেলাম সুপার বাজার বাসস্টেশনে।

এখন প্রশ্ন কোন বাসে মানে কত নাম্বার বাসে কুতুব মিনার যাবো? এটা জানার জন্য কাউকে কাউকে জিজ্ঞেস করলাম। এক দিদি জানালেন ম্যাপে চেক করা যাবে। সাথে সাথেই চেক করে নিলাম ৫০৫ নম্বর বাস কুতুব মিনার যায়। প্রায় ১৫ মিনিট অপেক্ষার পর বাস এলো, দেরি না করে বাসে উঠে পড়লাম। পাশের এক দাদার সাথে কথা বলে জেনে নিচ্ছি বাসের টিকেট কোথা থেকে নিব, কুতুব মিনারে যেতে সময় কেমন লাগতে পারে এবং টুকিটাকি অনেক কিছু। তিনি বললেন ‘পিছে দেখো এক আদমি বায়ঠা হে উসিছে টিকিট লেলো।’ এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল যে, বাসে উঠলে আপনাকে অবশ্যই টিকেট নিতে হবে আর এজন্য কোন টাকা লাগবে না। কিন্তু আপনি যদি টিকেট না নেন এবং পরে টিকেট চেকিংয়ে আসে তাহলে আপনাকে ২০০ রুপি জরিমানা দিতে হবে। এখানকার এই ব্যাপারটা আমার দারুণ লেগেছে!

প্রায় ৩০ মিনিট পরেই নেমে গেলাম কুতুব মিনারের সামনে। টিকিট কাউন্টারে গিয়ে ফরেন লাইনে পাসপোর্ট দেখিয়ে ৪০ রুপি দিয়ে টিকেট করলাম এবং ভেতরে গেলাম। দারুণ মনোমুগ্ধকর লাল বেলেপাথরে নিৰ্মিত এই মিনারটি! ইসলামিক স্থাপত্য এবং শিল্পকৌশলের এক অনবদ্য প্রতিফলন হিসেবে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকার চার বিভাগে এই প্রাঙ্গন বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার মর্যাদা লাভ করেছে। হঠাৎ পরিচয় হলো চেন্নাই থেকে আসা সারভ্যাস এর সাথে। সারভ্যাস তার অফিসের কাজে দিল্লি এসেছিলো সেই ফাঁকে এখানে ঘুরতে এসেছে। পুরোটা মিনার একসাথেই ঘুরলাম এরপরে সারভ্যাস আমার প্ল্যান জানতে চাইলো যে, আমি আর কোথায় যাবো? বললাম জামে মসজিদের কাছেই করিমস হোটেলে কাচ্চি বিরিয়ানি খাবো, তারপর মসজিদ ঘুরে দেখবো এবং সেখান থেকে লালকেল্লা (Red Fort) ঘুরে দেখবো।

‘করিমস’ এ কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য রফিক ভাই মেসেজ করেছিলেন। অসংখ্য ধন্যবাদ উনাকে কারণ কাচ্চির টেস্ট দারুণ ছিলো। সারভ্যাস বললো সেও খেতে চায় তাই এবার আর বাসে না গিয়ে অটো নিয়ে নিলাম ২৫০ রুপি দিয়ে। করিমস এ খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চলে গেলাম জামে মসজিদে। এখানকার দেখা শেষ করে চলে গেলাম লালকেল্লাতে। সেখানে গিয়ে ১০০ রুপি দিয়ে দুটো টিকেট করলাম এবং ভেতরে গেলাম।

জামে মসজিদ এবং লালকেল্লা যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় বন্যার পানি এখনো অনেকটা আছে। বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই কেল্লা অসাধারণ একটি স্থাপনা! প্রায় ২ ঘন্টা সময় নিয়ে পুরোটা ঘুরে দেখলাম। এরপর স্টেশনে চলে গেলাম পাহাড়গঞ্জ যাবো বলে, বাস নাম্বার ৭৫৩। সারভ্যাসও দাঁড়িয়ে আছে আমার সাথে। প্রায় ৩০ মিনিট পরে বাস এলে আমি বিদায় নিয়ে উঠে পরলাম বাসে। পাশের সিটে ববিতা দিদির সাথে চললো বকবক, দারুণ একজন মানুষ! ২০ মিনিটে চলে এলাম পাহাড়গঞ্জ।

বাস থেকে নেমে গুগোল ম্যাপ অন করে দেখলাম আমার হোটেল এখান থেকে ৩ কিলোমিটার। শুরু করলাম হাঁটা। গুগোলে হাঁটা রুট সিলেক্ট করায় চিপা-চাপা অলি গলি দিয়ে আমাকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে হোটেল অবদি পৌঁছে দিলো। লাভ ইউ গুগল মামা। আপনি না থাকলে যে কি হতো কে জানে…!!!! জীবন সুন্দর! (১৮ জুলাই ২০২৩)
লেখা: এপি তালুকদার, স্পোর্টস টিচার, চিটাগাং গ্রামার স্কুল ঢাকা, ফুটবল রেফারি- বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন, সাইক্লিস্ট, অ্যাথলেট ও ম্যারাথনিস্ট