জাহান-ই- গুলশান
গত ৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হলো ‘বিশ্ব ক্যানসার দিবস’। ক্যানসার বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। ক্যানসার বাসা বাঁধে শরীরে। ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলে মনে। কারন এর সাথে জড়িয়ে আছে লিঙ্গ-বৈষম্য, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আর্থিক বিষয়গুলোও। বিভিন্ন গবেষণা, প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে, চিকিৎসা নেয়া, না নেয়া বা বিলম্বে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রেও এসব বিষয় মূখ্য ভূমিকা রাখে। অনেকক্ষেত্রে চিকিৎসা সেবা পাবার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হোন অনেকে। শুধু তাই নয়,সারভ্যাইকাল বা ব্রেস্ট ক্যানসারের বেশ কায়েকটি ধরণ সহজ পদ্ধতিকে আগে শনাক্ত করা গেলে সঠিক সময়ে কার্যকর চিকিৎসা দিয়ে জীবন রক্ষা করা সম্ভব হলেও এসব ক্ষেত্রে শনাক্তকরণই সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে নারীর শরীর নিয়ে সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা প্রভাব ফেলে। এই প্রভাব এতোটাই তীব্র যে এর নির্মমতায় বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে হয়। একজন ব্রেস্ট ক্যানসার আক্রান্তের কথা জানি যিনি সার্জারির পর চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সার্জারিটাই মেনে নিতে পারেন নি মনে মনে। সারাক্ষণই নিজেকে অপূর্ণ ভাবতেন অঙ্গ হারানোর কষ্টে। এই কষ্ট থেকে তৈরি হয় মানসিক সমস্যা। । এক পর্যায়ে মারা যান তিনি। এ ঘটনা একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে উনার সামাজিকীকরণটাই হয়েছে এভাবে । বেশিরভাগ ক্যানসারের ক্ষেত্রে শরীরের দৃশ্যমান বা অভ্যন্তরন্থ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে বাদ দিতে হয়। সেসবও মেনে নেয়া এবং নতুন এক নিজের সাথে চলা যে কতোটা কঠিন, তা সেই অবস্থার মধ্য দিয়ে না গেলে কারও পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
গ্লোবক্যান এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ সালে ১৩ হাজার ২৪ জন নতুন ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে। এনআইসিআরএইচ এর আরেক রিপোর্টে জানা যায় যে, এসব আক্রান্তদের গড় বয়স ৪১.৮ বছর। অর্থাৎ তারা রিপ্রোডাক্টিভ বয়সের নারী। আবার এর বেশিরভাগই ( শতকরা ৯০) স্টেজ ৩-৪ এ এসে চিহ্নিত হয়েছে। এর বড় কারণ হিসেবে সমাজে ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে আলোচনা না হওয়া এবং আড়ষ্ঠতার কথা বলা হয়। এক্ষেত্রে নারীদের সচেতন হতে ব্রেস্ট সেল্ফ এক্সামিনেশন(বিএসই) প্রচার করার কথা বলা হয়েছে রিপোর্টে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে নারীরা এবিএসই বিষয়ে সতর্ক হয়ে উঠবেন, চর্চা করবেন। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, অন্যান্য পারিাবরিক অনেক সিন্ধান্তের মতো চিকিৎসার সিন্ধান্তগ্রহণও নারীর ওপর নির্ভর করেনা। এমনকি রোজগেরে নারীরাও নিজের বড় কোন চিকিৎসার সিন্ধান্ত নিজে নিতে পারেন না। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার কাঠামোতে তাই ক্যান্সারের মতো জটিল রোগও চিহ্নিতকরণ ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে পরিবারের বিশেষ করে পুরুষদের অংশগ্রহণ ও মতামতের উপর নির্ভর করে। তাই নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ব জারি রেখে, সাংস্কৃতিকভাবে নারীর সৌন্দর্য সংক্রান্ত ধারনাকে নারীর শরীরের মধ্যে আটকে রেখে দেখতে থাকলে আসলে নারীদের পক্ষেও সমাজের প্রচলিত ধারনার বাইরে গিয়ে সুস্থতার জন্য নিজের প্রতি যত্নবান হওয়া সম্ভব নয়। আবার সামাজিক লোকনিন্দা বা কলঙ্গিত করার যে সংস্কৃতি তা নারীর যে কোন অসুখকে নেতিবাচকভাবে দেখে। আর ক্যানসারের মতো অসুখকে ’পাপের ফল’ হিসেবে দেখার মনোভাবও সমাজে প্রকটভাবে বিদ্যমান।
’ক্যানসার মানে নির্ঘাৎ মৃত্যু। তাই চিকিৎসা করিয়ে লাভ কি’—-এমন কথাও ভুক্তভোগীদের কাছে শুনেছি। নিজের অভিজ্ঞতা অন্যদের বলি বলে অনেকেই আমার কাছে এটা সেটা জানতে যোগাযোগ করতে করেন। কয়েক মাস আগে আমার এক বন্ধুর বড় বোনের ব্রেস্টেও সমস্যা দেখা দেয়ায় যোগাযোগ করলেন। সেই বড় বোনের স্বামীও কথা বলতে চাইলেন আমার সাথে। শুরুতেই উনার প্রথম প্রশ্ন ক্যানসার হলে বাঁচার সম্ভাবনা কতটুকু? উনার মনোভাব হচ্ছে যদি নাই বাঁচে তাহলে চিকিৎসা করাবো কেন? যদিও আর্থিকভাবে উনি দেশের বাইরে চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য রাখেন। নিজে আক্রান্ত হবার পর থেকে হাজারো রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। প্রত্যক্ষ , পরোক্ষ সেসব অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বলতে পারি যে, আমাদের সমাজে এখনও ক্যানসার নিয়ে বিভ্রান্তি ও সঠিক প্রচারণার অভাব রয়েছে। রয়েছে আক্রান্ত এবং তার পরিবারের প্রতি সমাজের মানুষদের সংবেদনশীল আচরণের অভাব। আরেকটা অভিজ্ঞতা বলি। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের হলের সিনিয়র আপার সাথে হঠাৎ দেখা, বছর সাতেক আগে। বাচ্চাদের খবর জানিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, তার মনে মাঝে মাঝে একটা ভাবনা উঁকি দেয়, তা হলো বড় হলে মেয়ের যে বন্ধু বা জীবনসঙ্গী হবে সে কোনদিন ওর ছোট বেলায় হওয়া ক্যানসারের কথা বলে কষ্ট দেবে না তো? একজন প্রতিষ্ঠিত মায়েরও সেই দুশ্চিন্তা কিন্তু অমূলক নয়। এসব কারনে অনেকেই নিজের অসুখের কথা প্রকাশ করতে চান না।
আমি নিজে যখন ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে পাঁচ মাস টানা ভারতের মুম্বাইয়ে ছিলাম তখন এক নব বিবাহিত দম্পতিকে দেখেছিলাম, যাদের বিয়ের ৬ মাসের মাথায় নারীটির ওভারিতে ক্যান্সার হয়। সে খবর জেনে শ্বশুর বাড়ির নিকটজনেরা বলেছিল বিয়ের আগেই এ রোগ হয়েছিল। অসুখ লুকিয়ে বাবা-মা মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এটি যে কতোটা কষ্টের হতে পারে তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। এ রকম হাজারও উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এ রোগের চিকিৎসার কয়েকটি ধাপের একটি পুনর্বাসন। মানে যারা সারভাইভ করেন তাদের জন্য পুনর্বাসন জরুরী। যেমন আমার কথাই যদি বলি, দীর্ঘ পাঁচ মাস ভারতের মুম্বাইয়ে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতাল থেকে ওভারিয়ান ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরে সবকিছুতেই নতুন করে নিজেকে খাপ খাওয়াতে হচ্ছে। নতুন শরীর, আবেগের নিয়ন্ত্রণ, ভেজালমুক্ত খাবার , কর্মস্থলে মানিয়ে নেয়া সহ হাজারও বিষয়। একটা কথা বার বার শুনি, ‘কোয়ালিটি লাইফ’।প্রকৃতির সাথে নিবিড় সংযোগ রাখা। আমার বাসার চৌহদ্দিতে কোন পার্ক নাই। মাছ , মাংস, শাক সবজি ,ডিম, দুধ যা খাচ্ছি তা কতটা নিরাপদ জানি না। ঢাকার সীসা ভরা বাতাসের কথা নতুন করে আর কী বলবো! সুতরাং ক্যানসারের চিকিৎসাকে ক্রসকাটিং ইস্যুর ভিত্তিতে দেখতে হবে। কেবল চিকিৎসা নয়, এ রোগ ও আক্রান্তের প্রতি সামাজিক মনোভাব, স্টিগমা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, আর্থিক বিষয় ,পুনর্বাসন –এ সবগুলো বিষয়কে নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে। এজন্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সমন্বিত হোলিস্টিক এপ্রোচের কথা বলে থাকে।
এ রকম একটি বাস্তবতায় ২০২২-২৪ এর বিশ্ব ক্যানসার দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ”ক্লোজ কেয়ার গ্যাপ”। এর মধ্য দিয়ে আসলে ক্যানসার চিকিৎসার নির্মম বাস্তবতাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এ গ্যাপ বৈশ্বিক। সম্পদের বৈষম্য এ রোগের চিকিৎসাতেও প্রকট বৈষম্য তৈরি করেছে। গ্লোবাল ক্যানসার স্ট্যটিস্টিকস-২০২০ এর এক প্রতিবেদনে জানা যায় , ২০২০ সালে ১০ মিলিয়ন মানুষ ক্যানসারে মারা গেছেন। আর বাংলাদেশে ২০২০ সালে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৭৭৫ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৮৮ হাজার ৭৫ জন পুরুষ আর ৬৮ হাজার ৭০০ জন নারী। মারা যাওয়াদের ৬৩৫৪১ জন পুরুষ আর ৪৫,৪৪৯ জন নারী। অথচ দুর্ভাগ্যজনক যে, বাংলাদেশে ৩৬ টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৪টি তে অনকোলজি বিভাগ রয়েছে। যেগুলোতে আবার পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি,লোকবলের অভাব রয়েছে। দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, সাারাদেশে ২৫ জন মেডিকেল অনকোলজিস্ট রয়েছেন। এছাড়া মাত্র ৩০ জন সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট রয়েছেন। প্রতিবেদনে প্রফেসর এম আনওয়ার হোসেন কে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ”ক্যান্সার সার্জারি খুবই জটিল। সার্জিক্যাল অনকোলজিস্টকে অবশ্যই রেডিয়েশন, মেডিকেল অনকোলজিস্টেরর সাথে মিলে টিউমারের ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে আলাদা করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনভাবে আমরা কো-অর্ডিনেশন এপ্রোচ প্রয়োগ করতে পারি না। ফলে আমাদের জেনারেল সার্জনরাই সার্জারি করে থাকেন। ” আর সার্জারির সঠিকতার ওপর চিকিৎসার সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে। এ বিষয়টি মুম্বাইয়ে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ডাক্তাররা আমাকেও বলেছেন। আমার সার্জারিটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। ফলে চিকিৎসা কার্যকর হবার ক্ষেত্রে এটি একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।
চিকিৎসা বৈষম্য উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, নিম্ন ও মধ্যআয়ের দেশে দেরীতে ক্যান্সার শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার অপ্রতুলতা, শনাক্তকরণের সুবিধার অভাব দায়ী। ক্যানসারের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোতে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে সমন্বিতভাবে চিকিৎসা হয়। কিন্তু এ চিকিৎসা নিম্ন আয়ের দেশে ১৫ শতাংশের কম। বাংলাদেশের জাতীয় ক্যানসার ইন্টিটিউট ও হাসপাতালে কার্ডিয়োলজিস্ট,নেফ্রোলজিস্ট,হেপাটোলজিস্ট এমন কি পেলিয়টিভ কেয়ার ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত নাই। ফলে কেমোর পর জটিলতা দেখা দিলে রোগীদেরকে অন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হয়। এতে করে রোগীর চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হয় এবং খরচও অনেক বেড়ে যায় । এক প্রতিবেদন বলছে বিশ্বে ২০১০ এ ক্যানসার চিকিৎসার জন্য আর্থিক খরচ হিসেব করা হয়েছিল ১.১৬ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া বাংলাদেশে কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানে সঠিকভাবে কেমো থেরাপি দেবার জন্য হাই এফিশিয়েন্সি পার্টিকুলার এয়ার ফিল্টার সিস্টেম নাই । এ রকম পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত অনেকেই নানাভাবে অর্থের সংস্থান করে দেশের বাইরে বিশেষ করে ভারতে চিকিৎসার জন্য যেতে বাধ্য হন। বিদেশের মাটিতে পরিাবর পরিজন ছাড়া ক্যানসারের মতো একটি জটিল ও দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রায় সবাই প্রকট মানসিক স্বাস্থ্য ঝুুঁকিতে পড়েন। কেবল আক্রান্তই নন কেয়ার গিভাররের জন্যও এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বিদেশের মাটিতে একা একটানা একজনকেয়ার গিভারকে হাসপাতাল, রোগীর যত্ন এবং সবকিছু করা অত্যন্ত কষ্টকর । এছাড়া করোনাকালে বিদেশে সময়মতো ফলোআপে যেতে না পারায় অনেকের রোগ ছড়িয়ে যাবার কথাও জানা যায়।
২০১৭ সালের ৩১ মে ৭ম আর্ন্তজাতিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্মেলনে ’ক্যানসার প্রিভেনশন এন্ড কন্ট্রোল ইন দ্য কনটেস্ট অব এন ইনটিগ্রেটেড এ্যপ্রোচ’ গৃহীত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আই এ আর সি যৌথভাবে জাতিসংঘের কাছে কিছু প্রস্তাব রেখেছে । তারা বলেছে জাতিসংঘের সকল দেশ যেন সেগুলো মেনে চলে। যেমন- ক্যান্সার প্রতিরোধে ’বেস্ট বাই এবং অন্যান্য কস্ট ইফেক্টিভ প্রায়োরিটি’ স্ট্র্যটিজির কথা বলেছে। এছাড়া জাতীয় ও স্থানীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উন্নতর করা, গবেষণা ও সমন্বয় এবং ক্যানসার বার্ডেন মনিটরিং করার বিষয়ে নজর দিতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে,৩০-৫০% ক্যানসার রিস্ক ফ্যাক্টর প্রতিরোধ করার মাধ্যমে এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত গাইড লাইন( এভিডেন্স বেইজড প্রিভেশন স্ট্রাট্রেজিস) এর মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ক্যানসার কন্ট্রোল স্ট্র্যাটিজি এন্ড ন্যাশনাল ক্যানসার প্রটোকল নাই। বাংলাদেশে পপুলেশন বেইজ ক্যানসার রেজিস্ট্রি ( পিবিসিআর) হয়। ফলে আমরা জানিনা বয়স, লিঙ্গ, পেশা ভেদে জনগোষ্ঠী কোন ক্যানসারে আক্রান্ত হয় বেশি। আর এটি জানা না গেলে পলিসি নির্ধারন করা সম্ভব নয়। এক মাপের জামা সবার জন্য প্রযোজ্য হয় না, তা সবাই জানে। সেজন্য প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন, নজর দিতে হবে জেন্পার গ্যাপ ও স্টিগমা বদলানোর প্রতিও।
যেমনটা আগেই বলছিলাম ২০২২ থেকে ২৪ পর্যন্ত নির্ধারন করা হয়েছে ‘ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ’। তিন বছর জুড়ে ধাপে ধাপে এ থিমকে নিয়ে কাজ করা হবে। এর আওতায় ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান সম্পদ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বৈষম্যকে স্বীকৃতি দেয়ার মধ্য দিয়ে সমস্যাকে উপলব্ধিতে নেবার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রে অসমতাকে স্বীকার না করলে অসমতা দূর করার উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হবে না। অসমতার কারণে ক্যানসার আক্রান্ত সকলে একই মানের প্রাতিষ্ঠানিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আক্রান্তদের সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা, লিঙ্গ ,বয়স, নৃতাত্বিক পরিচয় চিকিৎসা পাবার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে । এছাড়া যে কোন পদক্ষেপ নেবার, আক্রান্তদের কথা শোনার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আক্রান্তদের সমস্যা চোখ দিয়ে উপলব্ধি করতে না পারলে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্যাপ থেকে যেতে পারে। অন্যদিকে ২০২৩ এ- মূল ফোকাস ”একতাই বল’ এর ওপর প্রতিষ্ঠিত । এতে সমমনা বন্ধু, পরিবার, সহকর্মী ও কমিউনিটিকে ঐক্যবদ্ধ করার দিকে নজর দেবার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আর শেষ বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের লক্ষ্য হচ্ছে সমমনারা এক হয়ে বিশ্ব নেতাদের কাঙ্খিত পরিবর্তন আনার জন্য উদ্যোগ নিতে দাবী তুলে ধরে চাপ প্রয়োগ করা। তারা যেন বৈশ্বিক অসমতা দূর করতে উদ্যোগ নেন, ক্যান্সার মুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলতে সম্পদের এবং স্বাস্থ্যখাত থেকে অসমতা দূর করার প্রচেষ্টা করেন।
এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, সমতার ফারাক কেবল উন্নত বিশ্বের সাথে নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশেরই নয় বরং উন্নত দেশের ভেতরেও রয়ে গেছে। তথ্যে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শেতাঙ্গ নারীদের সারভাইভ করার হার ৮৫ শতাংশ। যেখানে কৃষাঙ্গ নারীদের বেলার হার ৫৮ শতাংশ। আবার নিউজিল্যান্ডের মুরি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্যানসারে মৃত্যুর হার অন্য জনগোষ্ঠীর( অ-মুরি) দ্বিগুণ। এছাড়া সার্ভিক্যাল ক্যানসারে আক্রান্তদের মধ্যে ৯০ শতাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের নারীরা মারা যান। এ রকম এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বে ক্যানসার দিবস উপযাপিত হয়েছে। একজন ক্যানসার জয়ী হিসেবে আমি চাই এদেশেও ক্যানসার কেয়ার গ্যাপ কমে আসুন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এ দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ বিপুল জনগোষ্ঠী। প্রশ্ন জাগে, এদেশে বিশাল বিশাল শপিং মলে ইনভেস্ট না করে জীবন রক্ষাকারী মানসম্মত প্রতিষ্ঠান, সেবার দিকে কি দেশের শিল্পপতিরা নজর দিতে পারেন না? পাশের দেশের টাটা গ্রুপ পারলে এদেশের শিল্প গ্রুপগুলো কি বিশ্বমানের একটি ক্যানসার হাসপাতালের উদ্যোগ নিতে পারেন না? পারেন না কি ক্যানসারের প্রয়োজনীয় ঔষধ সুলভে সবার লাগালের মধ্যে নেবার ব্যবস্থা করতে? আমার দেশে নিজ পরিবারের কাছে থেকেই কম খরচে মান সম্মত চিকিৎসা যেন আমার জীবদ্দশাতেই নিতে পারি , সে দিনের অপেক্ষায়।
জাহান-ই- গুলশান, ক্যানসার জয়ী
(রোকেয়ানামার মতামত কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের ব্যক্তিগত মতামত। এজন্য সম্পাদক দায়ী নয়।)