0

সম্পর্কের সৌন্দর্য

Share

ফারহানা মান্নান

আমার শাশুড়ি মায়ের প্রয়াণ হয়েছে আজ প্রায় ১৫ বছর। কানাডা থেকে দেশে ফিরে আমি, জীবনসঙ্গী ও আমার শ্বশুর তিনজন একসাথেই সংসার পাতলাম। আমাদের তিনজনের মধ্যকার সম্পর্কের বয়স হয়েছে প্রায় ২০ বছর। একে অপরকে বোঝার জন্য, জানার জন্য একটা লম্বা ম্যাচিওর সময়! এই ‘বোঝার’ জন্য আমার প্রথম মাইন্ডসেট ছিল মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা, সময় এবং ধৈর্য। আরও ছিল সততা। একটা সম্পর্ক চমৎকারভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। অনেক সময় দিতে হয়। এতোটা সময় দেয়ার জন্য হাতে সময়ের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সময় দেয়ার মানসিকতা। এই মানসিকতা তৈরির ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় বাধা কি “আমার আপন নয়/রক্তের সম্পর্ক নেই”; এগুলো?

বর্তমান সময়ে বিভিন্ন সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব জটিলটা দেখা যায় তার মূল কারণ খুব সম্ভবত মাল্টিটাস্কিং জীবন। সম্ভবত বলার কারণ এটা কোন জরিপের ভিত্তিতে বলছি না, বলছি সাধারণ অবজারভেশন থেকে। আবার এই জীবনটাকে টেকনোলজি সহজ করেছে নাকি জটিল সেটাও একটা প্রশ্ন। আরও প্রশ্ন বড় পরিবারগুলো অণু পরিবারে বিভক্ত হওয়া নিয়ে। এটাও কি কোনভাবে জটিলতা তৈরি করছে না? এটা বেশ স্পষ্ট যে সময়ের সাথে সাথে পরিবারের কাঠামো, জীবন ও জীবিকার ধরন বদলে গেছে স্বাভাবিকভাবেই। এ সময়ের জেনারেশন বড় হচ্ছে কেবল দেশ ছাড়ার স্বপ্ন নিয়ে! এটাও হয়তো আমাদের জটিল জীবনের আরও একটি কারণ। এই জটিল জীবনে সম্পর্কগুলোকে এখন যত্ন দিয়ে বড় করা হয়ে গেছে ভীষণ কঠিন। তবে আমার ক্ষেত্রে আমার নিজের সম্পর্কের চাইতেও দেশের মাটির প্রতি টান ছিল বলেই ফিরে এসেছিলাম। আর ফিরে এসে আমি এখনও পর্যন্ত মুগ্ধ!

আমার ক্ষেত্রে মাল্টিটাস্কিং জীবন সহজ হয়েছে আমার ও আমার শ্বশুরের চমৎকার বন্ধুত্বের কারণে। যেটা হয়েছে সময়ের সাথে, ধীরে ধীরে। আমাদের একসাথে পথচলার অনেক গল্প, অনেক স্মৃতি! আমাদের দুজনের গল্প দিয়েই একটা আস্ত বই লেখা হয়ে যেতে পারে! আমি প্রায়ই তাঁকে প্রশ্ন করি, “৭৯ বছরের জীবন আপনার কাছে কেমন লাগলো?” আমার জানতে ইচ্ছে করে তাঁর বেঁচে থাকার আনন্দের জায়গাগুলো! জানতে ইচ্ছে করে এই বেঁচে থাকা, এই জীবন থেকে তিনি কি পেলেন? তিনি অসম্ভব ধর্মপ্রাণ মানুষ। যে কোন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থেকে, স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা তাঁর আছে। এই ক্ষমতাকে আমি রীতিমতো ঈর্ষা করি। কারণ জীবনের মাঝে থেকে, জীবনের সবটা মেনে নেয়ার ক্ষমতা কম কথা নয়! এটা কজন পারে? একজন বুদ্ধিমান, বন্ধুসুলভ মানুষ না পেলে আমার একাকী সংসারের যাত্রা বেশ কঠিন হয়ে যেতো! অসম্ভব হতো আমার মাল্টিটাস্কিং জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলা! কাজেই দেশে ফিরে আমি পেয়েছিলাম দেশ, দেশের মানুষ, মা-বাবা ও আমার বিবাহিত জীবনে পাওয়া শাশুড়ি বিহীন সংসারে শ্বশুরকে!

আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি হলো একে অপরের প্রতি বিশ্বাস এবং আস্থা। সেটা আমাদের মনোমালিন্য যখন হয় তখনও সত্য। আমার শ্বশুরের দিক থেকেই এই সত্যের সাড়া বেশি। এটা যে শুধু তিনি আমার সাথেই করেন তা নয় বরং সকল সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর একটা চমৎকার মাত্রা চেতনা আছে। এটা ভালো। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে বাহুল্য আবেগ আড়াল করে রাখার এই শক্তি তিনি রপ্ত করেছেন কি করে? জীবন আমাদের সকলকেই অনেক দেয় এবং এর মাঝেই আমাদের শেখায়। আমাকেও জীবন একটা তৃপ্তি হিসেবে দিয়েছে তাঁকে! এটা বলে রাখা জরুরি যে আমাদের মধ্যে সবরকমের আবেগের আদান-প্রদান হয়েছে। সবরকমের পাওয়া আর না পাওয়ার হিসেব হয়েছে। তবুও! তবুও তৃপ্তি! কারণ একটা সম্পর্কের সাথে খাপে খাপে মিলে যাওয়াটা কম কথা নয়, তাই না?

জীবনের কাছ থেকে পাওয়া যে সময় তা এক একজনের কাছে এক এক রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে। এই সময় যত বড়ই হোক না কেনো আসলে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার মতো সময় বেশ ক্ষুদ্র বলেই মনে হয়। এই জীবনে কত কত মানুষ আসে। তবে শৈশবে বাবা-মা এর সাথে জীবন, কর্মস্থলের পরিবেশ ও বিয়ের পর নতুন পরিবারের স্পর্শেই জীবনের স্বভাবের বড় পরিবর্তনগুলো আসে। আমার জীবনেও তাই হয়েছে। সময়ের সাথে পরিণত বয়সে উপনীত হওয়া আমি জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে মূল্যবান বলেই ক্রমাগত লালন করে চলেছি! জীবন বিস্ময়ের, তার চাইতেও বড় বিস্ময় জীবনে আসা মানুষগুলো! জীবনে আসা প্রতিটি মানুষ মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে বলেই আমি বিশ্বাস করি। কেউ বেশি কেউ কম, কেউ তিক্তভাবে কেউ প্রেম ভরে! আর এইসব মিলেই একটা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়।

আমি যখন দেশে ফিরে আসি তখন অনেকেই ভেবেছিলেন আবার ফিরে যাবো কিন্তু আমি যাইনি! কারণ এখানকার মাটি, পানি, বাতাস আমাকে চিনবে। অন্য কোথাও সেই তৃপ্তি পাবো কই? এখানকার মানুষ আমার ভাষা বুঝবে আর জানবে আমি তাঁদের। এখানকার সংস্কৃতি আমার অলংকার, অন্য কোথাও হতাম বেমানান। অনেক অনেক কারণ ফিরে আসার! যা হোক এ জীবনের তৃপ্তি হলো রক্তের সম্পর্কের বাইরেও কিছু কাছের মানুষ পাওয়া। এর জন্য আমাকে শ্রম দিতে হয়েছে। সময় দিতে হয়েছে। একুশ শতকের এই পৃথিবীতে শ্রম ও সময়ের মূল্য কোথায় জানেন? কিছু সুন্দর ‘সম্পর্ক’ এ। সুন্দর সম্পর্কগুলো মানুষকে হতাশা থেকে মুক্তি দেয়! এটা মানসিক প্রশান্তির কারণ! রক্তের সম্পর্ক হোক বা না হোক প্রতিটি সম্পর্কই নিজ নিজ সৌন্দর্যে অমূল্য।

ফারহানা মান্নান, প্রতিষ্ঠাতা, শৈশব

(মতামত কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত। এজন্য সম্পাদক দায়ী নয়।)