কাজী আলিম-উজ-জামান
মাইশা মমতাজ মিম নামে একটি মেয়ে ঢাকার উত্তরার বাসা থেকে বেরিয়েছিল খুব ভোরে। সে যাচ্ছিল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে সে লেখাপড়া করে। সেদিন তাঁর কোনো ক্লাস ছিল না। একটা অনুষ্ঠান ছিল ক্যাম্পাসে, তাতে যোগ দিতে যাচ্ছিল মেয়েটি। অনুষ্ঠানটি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজ ধরনের, আজকাল শিক্ষার্থীরা যা করতে চায় না বা করার সুযোগ পায় না।
ঘটনা হলো, মিম নামের এই মেয়েটির একটা স্কুটি ছিল। ওইদিন সকালে এই স্কুটি চালিয়েই ক্যাম্পাসে যাচ্ছিল। কুড়িল ফ্লাইওভারে একটি কাভার্ড ভ্যানের চাপায় মিম নিহত হয়। এ ঘটনায় পরে কাভার্ড ভ্যান চালক বলেন, তিনি জোরে হর্ন দিয়েছিলেন। এতে স্কুটিচালক বিচলিত হয়ে পড়েন। ভারসাম্য রাখতে না পেরে তাঁর গাড়ির চাকার নিচে চলে আসেন। কাভার্ড ভ্যান চালকের ভাষায়, এতে তাঁর কিছু করার ছিল না।
মিম স্কুটি চালানো শিখেছিল মৃত্যুর কয়েক মাস আগে। বাবার কাছে স্কুটি কিনে দেওয়ার জন্য বায়না ধরেছিল। বাবা মেয়ের সাধ পূর্ণ করেছিলেন। মেয়ের মৃত্যুতে বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, স্কুটি কিনে না দিলে হয়তো আজ মেয়েকে হারাতে হতো না। কেন যে এটা করতে গেলাম।
একজন সন্তানহারা বাবা তাঁর আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করবেন, এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম বিষয়টিকে উপস্থাপন করলো এভাবে যে, বাবা মেয়েকে স্কুটি কিনে দিলেন। আর এই স্কুটি কিনে দেওয়াই মেয়েটির মৃত্যুর কারণ। ঢাকা শহরে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনার সংখ্যা এমনিতেই বেশি, যা বিভিন্ন গবেষণায় এসেছে।
এ ক্ষেত্রে চালক নারী না পুরুষ সেটা মূল বিষয় কি হতে পারে? অথচ আমাদের কিছু কিছু গণমাধ্যম তাই করল। চূড়ান্তভাবে বিষয়টা এ রকম দাঁড়াল যে, একটি মেয়ে স্কুটি চালিয়ে বেরিয়েছে পুরুষদের মতো, এ কারণেই সে নিহত হয়েছে। স্কুটি না চালালে মেয়েটি বেঁচে যেত। অর্থাৎ স্কুটি বা বাইক চালানো মেয়েদের কাজ নয়, এটা পুরুষের কাজ।
গণমাধ্যমের যে কোনো উপস্থাপনা সমাজে বিশেষ বার্তা দেয়। তাই গণমাধ্যমকর্মীদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। এখানে দুটি বিষয় আছে। যেসব গণমাধ্যম মিমকে ‘পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী’ থেকে দেখেছে, তাদের একটি অংশ বিষয়টিকে উপস্থাপন করেছে সচেতনভাবেই, বিশ্বাস থেকে। আরেকটি অংশ করেছে অসচেতনভাবে, অপেশাদারি সাংবাদিকতার জায়গা থেকে।
কোনো পক্ষের প্রতিই আমার কোনো উপদেশ নেই। কথা একটি তা হলো, একটি মোটরসাইকেল বা গাড়ি চালানোর কলাকৌশল নারী বা পুরুষ, উভয়ের জন্যই অভিন্ন। এখানে ভিন্ন কোনো নিয়ম নেই। যার দক্ষতা আছে, তিনি নারী হোন বা পুরুষ, কাজটি ভালো পারবেন। আর যার দক্ষতা কম, তিনি মন্দ পারবেন।
এমনিতেই স্কুটি বাহনটা আকারে ছোট, কম শক্তির। এটা বানানোর মধ্য দিয়ে এমন ধারণা দেওয়া হয়েছে যে, নারীরা ভারী বাহন চালাতে সক্ষম নন। তাদের জন্য ছোট যানবাহনই ঠিক আছে। তাহলে যে নারী উড়োজাহাজ চালান, তার ক্ষেত্রে তো ছোট আকারের উড়োজাহাজ বানানো হয়নি। যে নারী হাজার যাত্রী নিয়ে ট্রেন চালান, তার ক্ষেত্রে তো ছোট আকারের ট্রেন বানানো হয়নি। তাহলে মোটরবাইক ছোট হতে হবে কেন?
লেখাটি এখানেই শেষ হোক। আমাদের দেশে কর্মজীবী নারীর জন্য স্কুটি বা মোটরসাইকেল চালানো জরুরি। কারণ গণপরিবহনে নারীদের উঠার ও বসার পরিবেশ নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে উৎসাহ দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করছি। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আরও প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের কাছ থেকে পেশাদারি ও দায়িত্বশীল আচরণ সঙ্গত।
কাজী আলিম-উজ-জামান: কবি ও সাংবাদিক
ইমেইল: alimkzaman@abanti-antara
(রোকেয়ানামার মতামত কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের ব্যক্তিগত মতামত। এজন্য সম্পাদক দায়ী নয়।)