1

বিদেশে নারীর কর্মসংস্থান বাড়ছে

Share

প্রায় ১০ লাখ নারী কাজ করেন বিদেশে। অধিকাংশই সৌদি আরবের গৃহকর্মী, বাড়ছে নিপীড়ন, শঙ্কা ও সমস্যা সমাধানে সরকারের নানা উদ্যোগ। গৃহকর্মীর বদলে পোশাকখাত, কেয়ারগিভার, নার্সরা নিরাপদে

শরিফুল হাসান

মানিকগঞ্জের নারী সুফিয়া খাতুন বছর পাঁচেক আগে জর্ডানের ক্লাসিকস ফ্যাশনে চাকুরি নিয়ে যান। তাঁর দুই সন্তান নিয়মিত মাকে পাচ্ছেন না। তবে বিদেশ থেকে সুফিয়া নিয়মিত দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। তাঁর আয়ে পুরো সংসার চলছে। সন্তানেরাও স্কুলে যাচ্ছে। এর উল্টো চিত্রও আছে। গত বছরের ৮ জুন সৌদি আরব থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফেরেন এক নারী। বিমানবন্দরে কর্মরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওই নারী দাবি করেন, যে বাড়িতে কাজ করতেন সেখানে নিয়োগ কর্তা তাকে নিপীড়ন করতেন।  ধর্ষণের শিকার হয়ে তিনি এখন দেশে ফিরেছেন। 

নারী অভিবাসনের সাফল্য ও ব্যর্থতা এই দুই চিত্রই আছে। তবে এর মধ্যেই  বাংলাদেশ থেকে বিদেশে নারীর কর্মসংস্থান বাড়ছে। আবার একই সঙ্গে বাড়ছে নিপীড়ন, বিদেশে মৃত্যু এবং পাচারের মতো ঘটনাও। বাংলাদেশ থেকে ১৯৯১ সালে নারীদের বিদেশে যাওয়া শুরু হয়। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী,  ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দশ লাখ নারী বিদেশে গেছেন কাজ নিয়ে। এর মধ্যে ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ এই পাঁচ বছরেই সাড়ে পাঁচ লাখ নারী কর্মী বিদেশে গেছেন। 

মূলত ২০১৫ সালে সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানোর সমঝোতা স্বাক্ষর করার পর থেকেই বিপুল সংখ্যক নারী বিদেশে যাওয়া শুরু করেন। এর পরের বছরেই সেই সংখ্যা লাখ ছাড়াতে শুরু করে এবং মাত্র পাঁচ বছরে সাড়ে পাঁচ লাখ নারী বিদেশে গেছেন। বিএমইটি’র তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের দশ লাখ নারী কর্মীর মধ্যে প্রায় চার লাখ সৌদি আরবে, জর্ডানে ১ লাখ ৭৫ হাজার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১ লাখ ৩২ হাজার, লেবাননে ১ লাখ ৭ হাজার, ওমানে ৯৭ হাজার, কাতারে ৩৫ হাজার, মরিশাসে ১৮ হাজার, কুয়েতে ৯ হাজার, মালয়েশিয়াতে সাড়ে ৬ হাজার, বাহরাইনে পাঁচ হাজার, হংকংয়ে দুই হাজার এবং সিঙ্গাপুরে দেড় হাজার নারী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ গমন করেছেন।

সবচেয়ে বেশি নারী সৌদি আরবে, সংকট সেখানেই সবচেয়ে বেশি

বিএমইটি’র তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৯১ সাল থেকে দুই হাজার নারী কর্মী বিদেশে কাজ করতে যান। এরপর ২০০৩ পর্যন্ত বছরে গড়ে এক থেকে দেড় হাজার নারী বিদেশে গেছেন। এরপর আরও এক দশক সেই সংখ্যাটা বছরে গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার ছিলো। বাংলাদেশ থেকে যতো নারী বিদেশে গেছেন তার ৪০ শতাংশই গেছেন সৌদি আরবে। আর ‍সবচেয়ে বেশি সংকট সেখানেই। ২০১৫ সালের আগ পর্যন্ত মাত্র ১৫ টি রিক্রুটিং এজেন্সি বিদেশে নারীকর্মী পাঠাতো। কিন্তু গত চার বছরে রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা সাড়ে ছয়শ ছাড়িয়েছে। মূলত সৌদি আরব ২০১৫ থেকে বিপুল পরিমান নারী কর্মী নেওয়ার পর থেকেই তারা নারী কর্মী পাঠাতে শুরু করে। বিশেষ করে নারী না পাঠালে পুরুষকর্মী নেওয়া হবে না এমন অলিখিত শর্তের কারনে রাতারাতি প্রায় সব রিক্রুটিং এজেন্সি নারী কর্মী পাঠাতে বাধ্য হয়।

এক যুগ আগে সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে নিয়মিতভাবে বিপুল সংখ্যক নারী গৃহকর্মী পাঠানোর অনুরোধ জানায় বাংলাদেশে। ততোদিনে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমি জেনেছি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া নারীরা নির্যাতনের শিকার। কাজেই আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরব যখন বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী চাইলো তখন এ নিয়ে ২০১১ সালের ৭ মে প্রথম আলোতে ‘সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো নিয়ে উদ্বেগ, কয়েকটি দেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা, সরকারের নিরাপত্তার আশ্বাস’  শিরোনামে একটি রিপোর্ট করলাম।

ওই রিপোর্টে উঠে এসেছিল, সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া ইন্দোনেশীয়, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের কারনে এই দেশগুলো যখন তাদের নারীদের সৌদি আরবে পাঠানো বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নেওয়ার প্রস্তাবটিতে সায় না দেওয়ার অনুরোধ জানায় সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশিসহ আরও অনেকে।

সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশি সায়েদুল হাসান, কুমিল্লার ফরহাদ আহমেদ, চট্টগ্রামের বাবুল আহমেদসহ আরও অনেকেই আমাকে সেদিন বলেছিলেন, সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের খাদ্দামা বলে। খাদ্দামাদের কী পরিমাণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তা এখানকার সবাই জানে। কাজেই বাংলাদেশ সরকারের কোনোভাবেই এখানে নারীদের পাঠানো ঠিক হবে না। সৌদি আরবে গৃহকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে কি করা হবে জানতে চাইলে তখনকার বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘নারীদের নিরাপত্তা বিধান করেই সৌদি আরবে পাঠানো হবে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’

ওই নিউজের পর নারীদের বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি বন্ধ না হলেও কিছুটা গতি হারায়। এভাবে কাটলো আরও চার বছর। সৌদি আরবে তখনও পুরুষ কর্মী পাঠানো বন্ধ। তারা বারবার চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী দিতে হবে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। সৌদি আরবের শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আহমেদ আল ফাহাইদের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসে। এবার তারা নারীদের নেবেই। চুক্তি স্বাক্ষর করলো বাংলাদেশ।

সেদিনও এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা তুলে ধরে খবর প্রকাশ করেছিলাম। যা ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ‘৮০০ রিয়ালে নারী গৃহকর্মী, সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানির চুক্তি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ওই সংবাদে উঠে আসে- ১২০০ রিয়াল থেকে ১৫০০ রিয়াল বেতনের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত ৮০০ রিয়ালেই (১৬ হাজার ৮০০ টাকা) গৃহকর্মী পাঠাতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ।

 এতো কম বেতনে গৃহকর্মী পাঠানোর চুক্তি করায় এবং নারী গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সৌদি আরব প্রবাসী বাংলাদেশি এবং অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলো। তবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সেদিন বলেছিলেন, সৌদি আরব দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাজি হয়েছে। কাজেই চাইলেও তাদের প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ ছিল না। আর গৃহকর্মী নেওয়ার পর অন্যান্য খাতেও কর্মী নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে দেশটি। বাংলাদেশি মেয়েরা যেন কোন বিপদে না পড়ে, সে জন্য সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবে বাংলাদেশ।

অধিকার কর্মীরা সে সময় বারবার সতর্ক করলেও কেউ কথা শোনেনি। ব্যবসায়ীরা উঠে পড়ে লাগলেন। সারাদেশে দালালরা সক্রিয় হলো। ২০১৫ সালে সৌদি আরবে গেলেন ২১ হাজার নারী শ্রমিক। ২০১৬ সালে গেলেন ৬৮ হাজার। ২০১৭ সালে ৮৩ হাজার, ২০১৮ সালে ৭৩ হাজার, ২০১৯ সালে ৬৩ হাজার। এই সংখ্যা বাড়তেই থাকলো। বাড়তে থাকলো ভুক্তভোগীদের সংখ্যাও। 

২০১৫ সালের পর সৌদি আরব যাওয়া এই মেয়েদের দুরাবস্থা নিয়ে ফলোআপ স্টোরি আমিই করলাম ২০১৬ সালের ৯ এপ্রিল। শিরোনাম- ‘মধ্যপ্রাচ্যে নির্মম নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশি মেয়েরা’। সেই নিউজে উঠে এল, সংসারে সচ্ছলতার আশায় কুড়িগ্রাম থেকে যাওয়া এক নারী গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে গিয়ে গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। পরে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আশ্রয় নেন রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসে। দুই মাস পর তিনি দেশে ফিরেন।

ঢাকার উত্তর বাড্ডার এক নারী বলেছিলেন, যে বাসায় তিনি কাজ করতেন, ওই বাসার পুরুষেরা তাঁকে শারীরিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করতো। প্রতিবাদ করলে তাঁর চুল টেনে টেনে তুলে ফেলা হতো। মানিকগঞ্জের এক মেয়ে বলেছেন, সৌদি আরবের বনি ইয়াসার এলাকায় কাজ করতেন তিনি। নির্যাতনের কারনে চারতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েন। পরে তার স্থান হয় হাসপাতালের আইসিইউতে। কুমিল্লার এক নারীকে নির্যাতন করে মাথা ফাটিয়ে দিলে ১৪টি সেলাই লাগে।

এখন তো মাঝে মধ্যেই মেয়েরা ফিরছেন। নির্যাতনের যে বর্ণনা দেন তারা সেগুলো শুনলে গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে যায়। কান্নায় ভিজে যায় চোখ। গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে দেশে ফিরেছেন কেউ কেউ। কাউকে পিটিয়ে হাত পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আয়রন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শরীর। আরও কতো ধরনের নির্যাতন নিয়ে যে রোজ বাংলাদেশের মেয়েরা মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে ফিরছেন সেগুলো বলে শেষ করা যাবে না।

ফেরত আসাদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নেই, নিপীড়নের শিকার অনেকেই

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসে কাজের হাতছানিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও দলে দলে বিদেশ যাচ্ছেন। নারীদের প্রেরিত অর্থ জাতীয় অর্থনীতিতে উজ্জ্বল অবদান রাখছে। কিন্তু এ পর্যন্ত চাকরি শেষ করে বা প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে কতজন নারী শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছেন তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। সৌদি আরব থেকে নারীদের ফেরা নিয়ে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য বলছে, যাঁরা কর্মস্থল থেকে পালিয়ে যান বা অবৈধ হয়ে পড়েন, তাঁদের উদ্ধার করে বিভিন্ন বহির্গমন শিবিরে রাখে সৌদি পুলিশ। 

তাঁদের পাসপোর্ট না থাকায় বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আউট পাস (ভ্রমণের বৈধ অনুমতি পত্র) দিয়ে দেশে পাঠানো হয়। বিভিন্ন দূতাবাস ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত গত চার বছরে সৌদি আরব থেকে ১৩ হাজারেরও বেশি নারী দেশে ফিরে এসেছেন। আর বিমানবন্দর প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে করোনার শুরুর পর পাঁচ লাখ প্রবাসী ফেরত এসেছেন যার মধ্যে অন্তত ৫০ হাজার নারী। ২০২১ সালেও প্রায় পাঁচ হাজার নারী কর্মী ফিরেছেন। 

দেশে ফেরা নারী গৃহকর্মীদের ভেতর অধিকাংশই অভিযোগ করেছেন যে, সেখানে তারা নিয়োগ কর্তা এবং মকতব (সৌদিয়স্থ রিক্রুটিং এজেন্সি) এর প্রতিনিধি দ্বারা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ফেরত আসা নারীরা শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতন সহ ঠিকমতো খাবার না পাওয়া, চুক্তি অনুযায়ী নিয়মিত বেতন না পাওয়া এবং নির্ধারিত সময়ের অধিক কাজে নিয়োজিত থাকা ইত্যাদি। সেখানে প্রতিনিয়তই তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।

বিদেশে নারী নিপীড়নের বিষয়টি উঠে এসেছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনেও। সৌদি আরব ফেরত ১১০ নারী গৃহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে কমিটি  ২০১৯ সালের ২৬ আগষ্ট একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। তাতে বলা হয়, ৩৫ শতাংশ নারী শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন এবং ৪৪ শতাংশ নারীকে নিয়মিত বেতন দেওয়া হতো না।

দেশে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে মন্ত্রণালয়  তাদের ফিরে আসার ১১ টি কারণ চিহ্নিত করেছে। মন্ত্রনালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেরত আসা নারীকর্মীদের মধ্যে ৩৮ জন শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, ৪৮ জন নিয়মিত বেতনভাতা পেতেন না। এছাড়া অন্তত ২৩ জনকে পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হতো না।

সৌদি আরব থেকে ফেরাদের একজন তানিয়া আক্তার। স্বামীর একার আয়ে সংসার না চলায় সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ২০১৮ সনের ১৭ এপ্রিল যান সৌদি আরবে । সৌদি আরব রিয়াদ বিমান বন্দর থেকে সে দেশে থাকা রিক্রুটিং এজেন্সি প্রতিনিধি রিসিভ করে তাদের অফিসে নিয়ে যায়। এরপর একটি বাসা বাড়িতে কাজের জন্য নিয়ে যায়। সে বাসাতে থাকা অবস্থায় তানিয়া তার স্বামী মোঃ রাসেলকে ফোনে জানান সেখানে তাকে নির্যাতন করছে।

 খবর পাওয়ার পর রাসেল রিক্রুটিং এজেন্সিতে যোগাযোগ করলে এজেন্সি তার অভিযোগ না শুনে রাসেলকে ফোন করতে বলেন। তখন তানিয়ে ফোনে বলেন, “বাপে পুতে একলগে শুইতে চায়, আমি না গেলে আমাকে মারে” এই ফোন রেকর্ডটি রাসেল রেখে দেন। তানিয়া সেখানে কাজ করতে না চাইলে রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতিনিধি তানিয়ার উপর নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ করে রাসেল। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তারা তানিয়াার পা ভেঙ্গে ফেলে। এরপর তানিয়া পুলিশের সহযোগিতায় সৌদি আরবের হায়েল জেলার কিং খালিদ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহন করেন।

বিদেশে নারীর মৃত্যু বাড়ছে

বিদেশে  নারী শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত পাঁচ বছরে অন্তত পাঁচশ নারীর মরদেহ দেশে ফিরেছে। এদের মধ্যে ২০১৬ সালে ৫৭ জন, ২০১৭ সালে ১০২ জন, ২০১৮ সালে ১১২  জন, ২০১৯ সালে ১৩৯ জন এবং করোনাকালীন নিয়মিত বিমান চলাচল না থাকলেও ২০২০ সালে ৭৭ নারীর মরদেহ দেশে ফিরেছেন।

দেশে ফেরা ৪৮৭ নারীর মরদেহের উপর অনুসন্ধান করে দেখা গেছে আত্মহত্যায় মৃত্যু হয়েছে ৮৬ জনের, ষ্ট্রোকে মারা গেছেন ১৬৭ জন, দূর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭১ জন, স্বাভাবিক মৃত্যু ১১৫, খুন হয়েছেন ২জন এবং অন্যান্য কারনে মারা গেছেন ৪৬ জন।

 ১১টি দেশে মৃত্যুবরণকারী ৪৮৭ নারীদের মরদেহের মধ্যে সৌদি আরব থেকে ১৯৮ জন, জর্ডান থেকে ৮৮ জন, লেবানন থেকে ৭১ জন, ওমান থেকে ৫৩ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৩৯ জন ও বিভিন্ন দেশ থেকে ৩৮ জন নারীর মরদেহ দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে সম্প্রতি প্রথমবারের মতো সৌদি আরবে এক বাংলাদেশি নারী আবিরন বেগমকে হত্যার ঘটনায় এক সৌদি নাগরিকের ফাঁসির রায় হয়েছে।

সৌদিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি গৃহকর্মী হত্যার দায়

২০১৭ সালের জুলাই মাসে সৌদি আরবে যান আবিরন বেগম। সেখানে ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই নিজ গৃহকর্তার বাসায় হত্যা করা হয় আবিরনকে। মৃত্যুর ৫১ দিন পর তার পরিবার এ খবর জানতে পারে। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগিতায় দূতাবাস ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে তার মরদেহ দেশে আনা হয়। সৌদি আরব থেকে ফিরিয়ে আনা আবিরনের লাশের সনদে মৃত্যুর কারন উল্লেখ করা হয় হত্যা। আবিরনের পরিবারের সদস্যরা জানান, তার নিয়োগকর্তা আবিরনের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে তাকে মেরে ফেলেছে। এমনকি দুই বছরের কোন বেতনও তাকে দেওয়া হয়নি। এরপর আবিরন হত্যা মামলার বিচার শুরু করেন সে দেশের আদালত।

রিয়াদের ক্রিমিনাল কোর্ট গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে হত্যা মামলায় প্রধান আসামী সৌদি নাগরিক গৃহকর্ত্রী আয়েশা আল জিজানীকে কেসাস (জানের বদলে জান) এর রায় প্রদান করেছেন আদালত। তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে ইচ্ছাকৃত হত্যাকান্ড সংঘটিত করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। আদালত গৃহকর্তা বাসেম সালেমের বিরুদ্ধে আলামত ধ্বংসের অভিযোগ, আবিরন বেগমকে নিজ বাসার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় কাজে পাঠানো ও চিকিৎসার ব্যবস্থা না করায় পৃথক পৃথক অভিযোগে মোট ৩ বছর ২ মাস কারাদন্ডের আদেশ প্রদান করেন ও ৫০ হাজার সৌদি রিয়াল জরিমানা করেন। আদালত অপর আসামী সৌদি দম্পতির কিশোর পুত্র ওয়ালিদ বাসেম সালেমকে সুনির্দিষ্টভাবে হত্যাকান্ডে সহযোগিতা করার প্রমাণ পায়নি বলে জানান, তবে আবিরন বেগমকে বিভিন্নভাবে অসহযোগিতা করায় তাঁকে সাত মাসের কিশোর সংশোধনাগারে থাকার আদেশ প্রদান করেন।

বয়স কম দেখিয়ে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে

বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর জন্য বয়স ২৫ নির্ধারণ হলেও ১৩-১৪ বছরের অনেক কিশোরীকেও বয়স বেশি দেখিয়ে সৌদি আরবে পাঠানো হচ্ছে। এর মধ্যে সম্প্রতি ১৩ বছরের এক কিশোরী নদীর লাশ পাওয়া যায় সৌদি আরব। ডেথ সার্টিফিকেটে আত্মহত্যা বলা হলেও পরিবারের দাবি হত্যা। জন্ম সনদ অনুযায়ী, নদী আক্তারের বয়স ১৩। কুমিল্লায় বাড়ি হলেও রিক্রুটিং এজেন্সি ২৫ দেখিয়ে ময়মনসিংহ থেকে পাসপোর্ট করেন। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে গত ১৪ই আগষ্ট মদিনায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন নদী। কিন্তু পরিবারের দাবি হত্যা করা হয়েছে নদীকে। ২০১৯ সনের মার্চ মাসে সৌদি যাওয়ার পর থেকেই নিয়োগ কর্তা কর্তৃক নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয় নদীকে। এমনকি বেতনও দেওয়া হতো না নদীকে। এসব বিষয় নিয়ে একাধিকবার নদীর বাবা দুলাল মিয়া রিক্রুটিং এজেন্সি ঢাকা এক্সপোর্ট (আর এল-২৬৫) এর মালিক এ রহমান লালন এর সাথে যোগাযোগ করেও কোন প্রতিকার পাননি।

বাড়ছে নারী পাচারের সংখ্যা

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০১২থেকে ২০২০ পর্যন্ত মানব পাচারের যতো মামলা হয়ছে তাতে এক হাজার ৭৯১ নারী মানব পাচারের শিকার। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০২০ সালে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকালে উদ্ধারকৃত নারীর সংখ্যা ৩০৩ জন। বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এমনকি সিরিয়া বা দুবাইতে বিভিন্ন ড্যান্স ক্লাবে কাজের কথা বলে নারী পাচারেরর ঘটনাও ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, দুবাইতে এখন অন্তত ১৫০০ বাংলাদেশি তরুণীকে বিভিন্ন বারে বাধ্যতামূলক কাজ করতে হচ্ছে। অধিকাংশ মেয়ের বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। তাদের অন্য পুরুষের সঙ্গে রাত কাটাতে বাধ্য করা হয়। রাজি না হলে মেয়েদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। মারধরের পাশাপাশি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অথবা জোর করে মদ পান করিয়ে অন্যের সঙ্গে রাত কাটাতে বাধ্য করা হয়।

পাচারের শিকার নারীদের একজন শাহিন আক্তার (ছদ্মনাম)। তিনি জানান, দালাল চক্র লেবাননে বাসাবাড়িতে চাকরির কথা বলে শাহিনকে পাঠায় সিরিয়া। সেখানে ৭ মাস যৌন কাজে শাহীনকে লিপ্ত থাকতে বাধ্য করা হয়। পালাক্রমে ও দলগত ভাবে সঙ্গ দিতে হতো খদ্দরকে, সঙ্গ না দিতে চাইলে চালানো হত অমানবিক নির্যাতন যেমন: সিগারেটের ছ্যাঁকা, ইলেকট্রিক শক, চাবুকের বাড়িসহ নানা ভাবে। নির্যাতনের কারনে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে জ্ঞান ফেরার পর দেখেন তাকে ব্যবহার করে রেখে গেছে। নির্যাতনের চিহ্ন এখনো রয়ে আছে। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। চাকরির প্রলোভনে ৮০ তরুণীকে মধ্যপ্রাচ্যে পাচারের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটি পাচারকারী চক্রকে আটক করেছে। তারা বলছে, কম শিক্ষিত মেয়েদের টার্গেট করে বলা হতো, বিদেশে চাকরি দেওয়া হবে। এরপর ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন ড্যান্স ক্লাবে ও অসামাজিক কাজে বাধ্য করতো এই চক্রের সদস্যরা।

র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমানে দেশে মানব পাচারের মত অপরাধ থেমে নেই। মানব পাচারকারী চক্রের টার্গেট দরিদ্র মানুষ। পাচারকারীরা বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সহজ-সরল মানুষগুদেরকে ফাঁদে ফেলে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে। পাচারকারীদের পাতা জালে জড়িয়ে অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন এসব মানুষ। যার অধিকাংশই নারী। এসব নারীদের বিদেশে লোভনীয় ও আকর্ষণীয় বিভিন্ন পেশায় চাকরির কথা বলা হলেও তাদেরকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। পরে জোরপূর্বক সম্পৃক্ত করা হয় ডিজে পার্টি, দেহ ব্যবসা সহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে।

সংকট সমাধানে সুপারিশ

অনেক সময় কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, লাখ লাখ মেয়ে গেল তার মধ্যে মাত্র অল্প কিছু ফেরে। বাকিরা নিশ্চয়ইভালো আছে। ভালো আছে কি নেই, সেটা আমরা জানতে পারিনা। কারন মধ্যপ্রাচ্যের বাড়িগুলোতে যাওয়ার অধিকার কারও নেই। আমাদের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাও দুর্বল। কিন্তু অনেক মেয়েই যে ভালো আছে সেটা অবশ্যই সত্য। আবার অনেক মেয়ে যে নির্যাতিত সেটা কি করে অস্বীকার করা যায়? আর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা তো সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যায় না। সৌদি আরবে যদি একটা মেয়েও নির্যাতিত হয়ে কাঁদে সেই কান্না কী পুরো বাংলাদেশের নয়? 

নারী অভিবাসনের ক্ষেত্রে ‘নারী অভিবাসন নীতিমালা’ যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০১৯ সলে সরকার যে ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছে এজেন্সি সহ সবাইকে সেগুলো নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেকের হাতে মোবাইল ফোন নিশ্চিত করতে হবে। নারী কর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে যথাযথ মনিটরিং করাসহ অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা প্রয়োজন। কর্মী নির্যাতনকারী প্রতিটি অভিযুক্ত নিয়োগকর্তাকে সে দেশের আইন অনুযায়ী বিচার করতে হবে। এছাড়া দেশে ফেরত নারী অভিবাসী কর্মীদের পুনরেকত্রীকরণে সরকারের কার্যকারী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। মানব পাচার আইনের অধীনে দায়েরকৃত মামলাগুলো দ্রুত নিস্পত্তি করে পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনা যাতে এমন অপরাধ আর কেউ না করে।

আরেকটা কথা, মেয়েদের বিদেশে পাঠানোর বিপক্ষে কেউ নয়। মেয়েরা বিদেশে কাজ করতে যাক, তবে সেটা গৃহকর্মী না হয়ে অন্য কিছু হলে ভালো হয়। বিশেষ করে পোশাক খাত বা অন্য কোন কাজে। তারপরেও যদি সরকার গৃহকর্মী হিসেবে পাঠাতে চায় তাদের পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যারা নির্যাতন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিদেশে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের একটা মেয়েও যেন নির্যাতনের শিকার না হয়। কারন একটা মেয়েও যদি কাঁদে সেটা পুরো বাংলাদেশের কান্না। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করে সেই কান্না বন্ধ করতে হবে।

শরিফুল হাসান, কলামিস্ট।