0

পরাধীনতা নাকি সংবেদনশীলতা

Share

নুসরাত সুলতানা

প্রারম্ভিক কথা

জীববিজ্ঞানের ভাষায়, জ্ঞাত মহাবিশ্বের যে সমস্ত সত্তা জীবনের বৈশিষ্ট্যাবলি ধারণ ও প্রদর্শন করে, তাদের জীব বলে। বিভিন্ন প্রাক্কলন অনুযায়ী পৃথিবীতে বর্তমানে জীব প্রজাতির সংখ্যা ২০ লক্ষ থেকে ১ লক্ষ কোটি পর্যন্ত হতে পারে। এদের মধ্যে প্রায় ১৭ লক্ষ প্রজাতির জীব সম্পর্কে তথ্য নথিভুক্ত করা হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ পর্যন্ত ৫০০ কোটির বেশি প্রজাতির জীবের আবির্ভাব হয়েছে এবং এদের শতকরা ৯৯ ভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। এইসকল প্রাণীর ভেতরে আধিপত্য বিস্তারকারী প্রাণীটি হচ্ছে মানুষ। 

তাই এই সভ্যতাকে আমরা মানব সভ্যতা বলেই অভিহিত করি। কোটি বছরের হাজার হাজার সভ্যতার উত্থান পতনের ভেতর দিয়ে আজকের একবিংশ শতাব্দীর মানব সভ্যতায় আমরা পৌঁছেছি। প্রযুক্তি, পুঁজিবাদ, বিশ্বায়ন, অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি রোবট একুশ শতকের সভ্যতাকে দিয়েছে বেশ চাকচিক্যময় রূপ। কিন্তু মানুষের জন্ম,  বেড়ে ওঠা সবকিছু রয়ে গেছে সেই আদিম, অকৃত্রিম এবং শাশ্বত। পরিবর্তন সাধিত  হয়েছে খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, ভাষা আর কিছু উপকরণে। মানুষের কান্না, হাসি, কষ্ট আর যন্ত্রণার বর্ণমালার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি আজ অব্দি।

 জন্ম প্রক্রিয়া: আসুন এক ঝলক দেখে নেই মানুষ সহ যে কোনো প্রাণীর জন্মের প্রক্রিয়া সম্পর্কে। 

প্রজনন বা জনন হল একটি জৈব প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জনিতৃ জীব থেকে নতুন স্বতন্ত্র জীব – “অপত্য” – তৈরি হয়।

জনন প্রধানত দুই প্রকারের হয় : – ১) অযৌন জনন ২) যৌন জনন।

অযৌন জনন: অযৌন জনন প্রক্রিয়ায় একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির কোন জীব একই প্রজাতির অপর একটি জীবের সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই প্রজনন করতে সক্ষম হয়। একটি এককোষী ব্যাকটেরিয়া বিভাজিত হয়ে দুটি নতুন ব্যাকটেরিয়া কোষ উৎপন্ন হওয়া অযৌন প্রজননের একটি উদাহরণ। তবে অযৌন প্রজনন শুধু এককোষী জীবেই সীমাবদ্ধ নয়। অধিকাংশ উদ্ভিদই অযৌন প্রক্রিয়ায় বংশবৃদ্ধি করতে পারে এবং মাইকোসেপাস স্মিথি নামক প্রজাতির পিঁপড়া অযৌন প্রক্রিয়ায় পূর্ণাঙ্গ প্রজনন ঘটাতে পারে বলে ধারণা করা হয়। অ্যামিবার দ্বিবিভাজন প্রক্রিয়া অযৌন প্রজননের একটি উদাহরণ, এছাড়া জেলীফিশ এবং কিছু পতঙ্গ নিষেক ব্যতিরেকেই অসংখ্য ডিম পাড়তে পারে যা অযৌন প্রজনন প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত।

যৌন জনন: যৌন জননের জন্য একই প্রজাতির পরস্পর বিপরীত লিঙ্গের দু’টি জীবের সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজন হয়| এছাড়া, ক্লোনিং পদ্ধতিতেও জীবের বংশবিস্তার ঘটানো যায়। অধিকাংশ উদ্ভিদ ও প্রাণিই এ প্রক্রিয়ায় প্রজননকর্ম সম্পাদন করে। এ ক্ষেত্রে পৃথক দুটি লিঙ্গের প্রাণিদেহে প্রজননের জন্য মিয়োসিস প্রক্রিয়ায় দুটি পৃথক ধরনের কোষ উৎপাদন প্রক্রিয়া ঘটে, পুংদেহে উৎপাদিত কোষকে শুক্রাণু এবং স্ত্রীদেহে উৎপাদিত কোষকে ডিম্বাণু বা ডিম্ব বলে। এই দুটি কোষ পরস্পর সম্মিলিত হয়ে নিষিক্ত হয় এবং তা থেকে জাইগোট বা গ্যামেট সৃষ্টি হয়। এই জাইগোটই পরবর্তীকালে নতুন সন্তান হিসেবে আবির্ভূত হয়। যে সকল প্রাণী একই দেহে পুং ও স্ত্রী উভয় প্রকারের জনন কোষ উৎপন্ন করে তাদের হারমাফ্রোডাইট বলে। উদ্ভিদ জগতে এটি ব্যাপকভাবে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, অধিকাংশ প্রজাতির শামুক এবং প্রায় সকল প্রজাতির উদ্ভিদ প্রজাতি হল হারমাফ্রোডা।

মানব প্রজনন

মানব প্রজনন হল যৌন প্রজননের একটি রূপ যাতে কোন পুরুষের সঙ্গে কোন নারীর যৌনসঙ্গমের ফলে মানব ভ্রুনের নিষেক ঘটে। যৌনসঙ্গমের সময়, পুরুষ ও নারী প্রজনন তন্ত্রের মাঝে পারস্পারিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলে নারীর ডিম্বাণু পুরুষের শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়। এগুলো হল গ্যামেট নামক বিশেষ প্রজনন কোষ, যেগুলো মিয়োসিস নামক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়। যেখানে সাধারণ কোষে ২৩ জোড়া অর্থাৎ ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে, সেখানে গ্যামেট কোষে শুধুমাত্র ২৩টি ক্রোমোজোম থাকে, এবং যখন দুটি গ্যামেট একত্রিত হয়ে জাইগোট বা ভ্রূণ গঠন করে তখন দুটি গ্যামেটের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ ঘটে যাকে জেনেটিক রিকম্বিনেশন বলে, এবং নতুন ভ্রূণে মাতা-পিতা উভয়ের কাছ থেকে আসা ২৩টি ক্রোমোজোম একত্রিত হয়ে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম গঠন করে। একটি নির্দিষ্টকালীন গর্ভধারণ পর্যায়ের পর (সাধারণত নয় মাস), প্রসবের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম হয়।  তবে বিভিন্ন কৃত্রিম শুক্রাণুপ্রদান প্রক্রিয়াতেও ডিম্বাণু নিষিক্ত করা যায়, যেখানে যৌনসঙ্গমের কোন প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় মানুষের জন্ম আজও খুব সহজাত হয়ে ওঠেনি।

উপরের আলোচনায় এটি স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়- দুজন নরনারীর চরম আনন্দ বা বিহবলতায় আরেকটি নতুন প্রাণের অস্তিত্বের সঞ্চার হয় নারীর দেহে। তারপর তাকে নয় মাস তিলে তিলে বয়ে বেড়াতে হয় নিজের শরীরে। পুরুষটিকেও তখন নিশ্চিত করতে হয় নারীর প্রয়োজনীয় খাবার, চিকিৎসা, নির্ভার মানসিক শান্তি। আজকাল কর্মজীবি অনেক নারী আছেন তাকেও নির্ভর করতে হয় স্বামী বা অনাগত সন্তানের পিতার ওপর। এই নির্ভরশীলতাই সম্পর্কের সুস্থ আত্মা বা প্রাণ। সে কথায় এই নিবন্ধের আরও পরেই আসব।

গর্ভধারণের একেবারে প্রাথমিক দিকে গর্ভবতীকে বিভিন্ন শারীরিক কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়। এর ভেতর প্রথম তিনমাসে বেশি হয় হজম সংক্রান্ত জটিলতা। প্রচুর গ্যাস হয়, খাবারে অরুচি, ঘুম না আসা। চার-পাঁচ মাসে প্রচুর ঘেমে যাওয়া, কারো কারো পায়ে পানি আসা। সাত মাস শুরু হলেই শরীর অসম্ভব ভারী হয়ে ওঠে।  নিজের ভেতরে আরেকজন মানুষসহ নিজেকে বিয়ে বেড়ানোই মুশকিল হয়ে ওঠে। এছাড়াও আরও অনেক শারীরিক কষ্টের মুখোমুখি হতে হয় মা’কে। এরপর স্বাভাবিক প্রসব বা অপারেশন যাই হোক প্রসবের যন্ত্রণা প্রসূতি মা ছাড়া আর কেই বা বুঝবেন!  এই গেল শুধু জন্ম। এরপর বেড়ে ওঠা। 

বেড়ে ওঠা :

গরুর বাচ্চা জন্মের কিছু পরেই তিড়িংবিড়িং করে লাফায়। ছাগল, ভেড়া, মুরগী, হাঁস অন্য কোনো প্রাণীর বাচ্চাই এত ন্যুলো না। মানুষের বাচ্চা তিনমাসে কেবল উপুড় হতে শেখে, চৌদ্দ মাস থেকে আড়াই বছর লেগে যায় হাঁটা শিখতে। এরপর স্বাভাবিক খাওয়া দাওয়া শিখতে লেগে যায় প্রায় পাঁচ বছর। ততদিনে শুরু হয় স্কুল। জন্মের সাথে সাথে যেমন একটি মানব শিশু যেমন একটা পরিবারের হয়ে জন্মায় তেমনি স্কুলে যাবার সাথে সাথেই হয়ে ওঠে একটা প্রতিষ্ঠানের সদস্য। পরিবারের যেমন আছে কিছু নিয়ম-নীতি, আদর্শ -নৈতিকতা তেমনি প্রতিষ্ঠানেরও আছে নিজস্ব নিয়ম-নীতি, মোটো, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য। এসবকিছুই একজন মানবশিশুকে মেনে নেয়ার চেষ্টা করে বেড়ে উঠতে হয়। কোথাও সে শুধু নিজের ইচ্ছার দাসত্ব করতে পারে না। বয়স আঠারো হলেই একটি কিশোর হয়ে ওঠে রাস্ট্রের নাগরিক। তাছাড়া সে যে ধর্ম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত সেই ধর্মীয় সমাজের একজন অধিবাসী। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার সাথে সাথেই সভ্য মানুষকে মানতে হয় রাষ্ট্রের আইন-কানুন, সংবিধান এবং সমাজের সাধারণ আচার্য বিষয়। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে কী? মানুষের জন্ম থেকে শুরু করে বেড়ে ওঠা এবং সফল মানুষ হওয়া অব্দি সবকিছুতে সে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। সভ্য মানুষ মাত্রই সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, পারিবারিক এবং দেশের নাগরিক। তাহলে মানুষ কী স্বাধীন কোনোভাবে?  এখন প্রশ্ন আসতে পারে স্বাধীনতা আসলে কী?

স্বাধীনতা: প্রত্যেক জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক তার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা একটি শর্ত, যেখানে একটি জাতি, দেশ, বা রাষ্ট্র বা জায়গা। যেখানে জনগণ থাকবে, নিজস্ব শাসনব্যবস্থা, এবং সাধারণত কোন অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব থাকবে। স্বাধীনতার বিপরীত হচ্ছে পরাধীনতা। স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা করা নয়।

সাধারণ অর্থে স্বাধীনতা বলতে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোনাে কাজ করাকে বােঝায় । কিন্তু প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা বলতে এ ধরনের অবাধ স্বাধীনতাকে বােঝায় না। কারণ, সীমাহীন স্বাধীনতা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, কাউকে ইচ্ছামত সবকিছু করার স্বাধীনতা দিলে সমাজে অন্যদের ক্ষতি হতে পারে, যা এক অশান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করবে। তাই, স্বাধীনতার সংজ্ঞায় বলা যায়,  অন্যের কোন কাজে হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টি না করে নিজের ইচ্ছানুযায়ী নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে কাজ করাকে স্বাধীনতা বলে। অর্থাৎ স্বাধীনতা হলো এমন সুযোগ-সুবিধা যেখানে কেউ কারো কোন ক্ষতি না করে সকলেই নিজের অধিকার ভোগ করবে এবং স্বাধীনতা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করবে এবং অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে বাধা অপসারণ করবে। স্বাধীনতার সাথে রাষ্ট্রীয় ধ্যান-ধারণা যেমন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে তেমনি রয়েছে আরও অনেক রকম স্বাধীনতার ধারণা। যেমন : রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা।  বিশ্বের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগন স্বাধীনতাকে দেখেছেন বৈচিত্র্যময় দৃষ্টি ভঙ্গিতে। 

স্বাধীনতা মানুষের মনের একটি খোলা জানালা, যেদিক দিয়ে মানুষের আত্মা ও মানবমর্জাদার আলো প্রবেশ।

— হার্বার্ট হুভার

স্বাধীনতা সাহসী হওয়ার মধ্যেই নিহিত।

— রবার্ট ফ্রস্ট

স্বাধীনতা উপভোগ করতে আমাদের নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

— ভার্জিনিয়া উলফ

আমাদের মনে রাখতে হবে যে স্বাধীনতা বিনা মাসুলে প্রাপ্ত নয়।

— সংগৃহীত

১৬. মানুষ জন্ম নেয় মুক্তভাবে, কিন্তু সবখানেই সে শৃঙ্খলাবদ্ধ।

— রুশো

উপরে উল্লেখিত আলোচনা  থেকে সহজেই স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়- স্বাধীনতা মানেই যা খুশি চর্চা করা নয়।

আবার স্বাধীনতার সাথে আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সাহসের ব্যাপারও জড়িত। একুশ শতকের সবচেয়ে বড় মনযোগ বা আলোচিত বিষয় বোধ করি ব্যক্তিস্বাধীনতা। 

ব্যক্তিস্বাধীনতা: যে স্বাধীনতা ভোগ করলে অন্যের কোনো ক্ষতি হয়না এমন স্বাধীনতাকে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে। যেমন- ধর্মচর্চা করা, পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষা করা ইত্যাদি।

আবার অন্য অর্থে ব্যক্তিস্বাধীনতা হল ব্যক্তিগত অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এটি সরকার সাধারণত নির্ধারিত প্রক্রিয়া ব্যতীত আইন বা বিচারিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে খর্ব করতে পারে না। যদিও ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপ্তি রাষ্ট্রভেদে ভিন্ন হতে পারে, তবু মোটামুটি যে জিনিসগুলো ব্যক্তিস্বাধীনতার মধ্যে পড়ে সেগুলো হল, নির্যাতন থেকে বাঁচার অধিকার, বাস্তুচ্যুত হওয়া থেকে বাঁচার অধিকার, আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার, সংবাদ মাধ্যমের সহায়তা পাওয়ার অধিকার, ধর্ম পালনের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, নিরাপত্তার ও স্বাধীনতার অধিকার, নিজস্ব গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারার অধিকার, আইনের অধিকার, নিরপেক্ষ আদালতে বিচার পাবার অধিকার, এবং জীবন বাঁচানোর অধিকার। ব্যক্তিস্বাধীনতার মধ্যে আরও আছে সম্পত্তির মালিকানার অধিকার ও আত্মরক্ষার অধিকার এবং শরীরের ব্যক্তিগত শুদ্ধতার অধিকার। ইতিবাচক ও নেতিবাচক স্বাধীনতা ও অধিকারের উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের স্বাধীনতার মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। মোট কথা রাষ্ট্র এবং সমাজের নিয়মনীতি উপেক্ষা না করে, কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে নিজের পছন্দ -অপছন্দ চর্চা করাই ব্যক্তি স্বাধীনতা। 

একুশ শতকে ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বরূপ : কারো মতে পনেরোশো শতকের শিল্প বিপ্লবের সাথে সাথে আবার কারো মতে আঠারো শতকে শুরু হয়েছিল আধুনিকতা। অধুনা থেকেই আধুনিকতার উৎপত্তি। অন্ধ বিশ্বাস ও ধর্মীয় গোড়ামি থেকে অবমুক্তি  যুক্তিপূর্ণ আচার-আচরণ,  ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ  এসব নিয়েই আধুনিকতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। বিশ শতকের এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ একুশ শতকে এসে আত্মকেন্দ্রিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। সংস্কৃতি থেকে পারষ্পরিকতা এবং যুথবদ্ধতা প্রায় উধাও হয়ে গেছে। বিশ শতক ছিল যেমন বিজ্ঞানের জয়যাত্রার তেমনি একুশ শতকে এসে প্রযুক্তিই রাজা। ঘরে ঘরে স্মার্ট ফোন, ট্যাব, স্মার্ট টিভি,  এসি, রেফ্রিজারেটরের সাথে সাথে মানুষ ব্যবহার করছে হোয়াটস এপ, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম। এই প্রযুক্তিগুলো মানুষের সামাজিক এবং ব্যক্তিগত সংবেদনশীলতা উভয়ই কমিয়ে দিয়েছে। একেকজন মানুষ হয়ে উঠেছে একেকটা মনোহর দ্বীপ।

যেকোনো সুস্থ সুন্দর সম্পর্ক অনেকটুকু পরনির্ভরশীলতা এবং পরাধীনতা চায়। যেমন সন্তান গর্ভধারণ থেকে বড় করা অব্দি একজন মা’কে বিসর্জন দিতে হয় প্রায় নিজের যাবতীয় ইচ্ছা। এমনকি একজন পুরুষ যিনি পরিবারের কর্তা তাকেও সবাইকে সুখী করতে গিয়ে বাদ দিতে হয় অনেক সময়ে আড্ডা শখের চা-সিগারেট। মূলত মানুষের সমাজ, সভ্যতা এমনকি একটা সভ্য রাষ্ট্র ও এই নান্দনিক পরনির্ভরশীলতার চর্চা করেই সফল এবং সুস্থ স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। সমস্ত বিশ্বই তো একটা মানব সমাজের অধীন। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র বা ব্যক্তির হিসাবে কিছু আলাদাই বটে। একুশ শতকে এসে আত্মমর্যাদার নামে নারী-পুরুষ হয়ে উঠছে আত্মম্ভরি আর আত্মনির্ভরশীলতার নামে হয়ে উঠছে আত্মকেন্দ্রিক। স্বনির্ভরতার নামে যেন কেবলই স্বার্থপরতা চর্চা করছি আমরা। বিশ শতকে ভেঙে যাচ্ছিল যৌথ পরিবার আর একুশ শতকে এসে তৈরি হচ্ছে নান্দনিক বৃদ্ধাশ্রম। নারী-পুরুষের পারষ্পরিক নির্ভরশীলতাও প্রায় শূন্যের কোটায়। উভয়ই আজ স্বনির্ভরতার নামে হয়ে উঠছে একেকটা একলা দেবদারু গাছ। নারী দেখাচ্ছে আমিও বাজার করতে পারি, রাত-বিরেতে  একা বাসায় ফিরতে পারি। আর পুরুষ দেখাচ্ছে আমিও রান্না করে খেতে পারি। আর বিনোদনের জন্য স্মার্ট ফোন, ইউটিউব, ফেসবুক আরও কত কী! বাকি থাকে যৌন নির্ভরশীলতা। তার জন্যও আছে ডিডো শপ, বিকল্প হিউম্যান অরিয়েন্টেড সিস্টেম আর বহুগামিতা তো অনেককিছুই সহজ করে দেয়।

শেষ কথা: মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি বিভিন্ন সম্পর্কে সম্পর্কিত। বাবা-মা, ভাই-বোন,  স্বামী -স্ত্রী, প্রেমিক -প্রেমিকা, বন্ধু-বান্ধব ইত্যাকার বহুবিধ সম্পর্কে জড়িত প্রত্যেকটি মানুষ। নিজের কিছু ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে অন্যকে সুখী করেই নিজেকে সুখী করতে হয়। তাই মানুষ প্রকৃত অর্থে পরাধীন জীব। বরং অন্য প্রাণী মানুষের চাইতে অনেক বেশি স্বাধীন কারণ ওদের সভ্যতা নেই, ধর্মগ্রন্থ নেই, সমাজবদ্ধতা বা যুথবদ্ধতা নেই। বহুবিধ পরাধীনতার শিকার মানুষ। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক,আবহাওয়া আরও অনেককিছুতেই। তবে একথাও সত্য পরাধীনতার নামে বা সম্পর্কের নামে মানুষ রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক কোনো ধরনের দাসত্বকে মেনে নেবে না। তাহলে পারষ্পরিক বোঝাপড়া, পারষ্পরিক নির্ভরশীলতা, এবং সর্বোপরি প্রত্যেকের সংবেদনশীল আচরণই বাঁচিয়ে রাখতে পারে যাবতীয় সম্পর্ক এবং সুস্থ বিকশিত মানব সমাজ।

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া এবং বাংলাপিডিয়া।)

নুসরাত সুলতানা, কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

(মতামত কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত। এজন্য সম্পাদক দায়ী নয়।)