অর্পিতা চৌধুরী
বলা হয়ে থাকে যে কোন ধরনের মাদক গ্রহণের প্রাথমিক অভ্যাস তৈরি হয় সিগারেট সেবন বা তামাক থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশে ১৬০৫ সালে পর্তুগীজরা প্রথম তামাক চাষের সূচনা করে। কয়েক শতকে এ ব্যবসার প্রসার ঘটে। এ ব্যবসাকে সুরক্ষিত করতে নানা পর্যায়ে ব্যবসা বান্ধব নানা প্রচারণা ও আইনের প্রবর্তন ঘটে। কিন্তু এর ক্ষতিকর দিক থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য তেমন কঠিন আইন যেমন তৈরি হয়নি তেমনি আইন তৈরি হলেও এর প্রয়োগে ব্যাপক আগ্রহও পরিলক্ষিত হয়নি।
বাংলাদেশের সংবিধানে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের বিষয়টি রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চিহ্নিত করা হলেও স্বাস্থ্যখাত অনেকটাই অবহেলিত। ২০১৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী কোন দেশ তামাকমুক্ত হিসেবে স্বীকৃতি পাবে তখনই যদি তামাক ব্যবহার ৫% এ নেমে আসে। আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার এখনো ৩৫% অর্থাৎ প্রায় ৪কোটি মানুষ তামাক ব্যবহার করে। ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত ঘোষণা করতে চাইলে তামাকের ব্যবহার ৩০ ভাগ হ্রাস করতে হবে।
উপমহাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রথম পদক্ষেপ ১৮৯০ সালের রেলওয়ে আইনের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়।এরপর ১৯১৫,১৯১৯ এ কিছু বিধি সংযোজন হয়। ১৯৫২ এর পরে সিনেমা হলে ধূমপান নিষিদ্ধ্ব করা হয়। ১৯৬৮ সালে টোব্যাকো প্রমোশন বোর্ড স্থাপিত করা হলেও পরবর্তীতে তা বাতিল করা হয়। ১৯৭৫ সালে টেনডু বিড়ি উৎপাদন, বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়। মূলতঃ ১৯৭৬ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশে ধূমপান নিষেধ সম্বলিত নোটিশ প্রদর্শিত জায়গায় সিগারেট খেলে জরিমানার বিধান করা হয়,পরে অন্য মেট্রোপলিটনে এ আইন যুক্ত করা হয়।
২০০৫ এর আগে যতগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ছিল তা ছিল ছড়ানো ছিটানো। ২০০৫ সালে সরকার পূর্ণাঙ্গ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে। এ আইনেও নানা ফাঁক ফোকর দেখা যাওয়াতে ২০১৩ সালে এ আইন সংশোধন করা হয়। বিদ্যমান আইনে ধারা আছে ১৮টি,যা ভঙ্গ করলে বিভিন্ন মাত্রার জেল জরিমানার ব্যবস্থা আছে। যেমন ধারা ৬ক, অপ্রাপ্ত বয়স্কদের কাছে বা তাদের দ্বারা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ; এ আইন ভঙ্গ যদি কোন তামাক কোম্পানি বা ব্যবসায়ী করে তবে জরিমানা হবে ৫০০০ টাকা।
বিদ্যমান তামাক আইনে যেসব জায়গায় সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে তা হলো-
১. পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিষিদ্ধ
২. তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ
৩. ই-সিগারেট/HTP/END-আইন সংশোধনের মাধ্যমে ই-সিগারেট,ভেপিং আমদানী,উৎপাদন,ব্যবহার,বিতরণ নিষিদ্ধ করা
৪. তামাক বিক্রয়ের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগানো। তাহলে মুদির দোকান পর্যন্ত এ লাইসেন্সের আওতায় আসবে।
৫. তামাকজাত পণ্যের মোড়কের ৯০%এলাকা ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদান
৬. তামাকের স্ট্যান্ডার্ড মোড়ক প্রবর্তন ও খুচরা বিক্রি বন্ধ করা
৭. তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিকে সুরক্ষায় নীতি প্রণয়ন
৮. তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রয়োগ।
দেশকে তামাকমুক্ত করতে হলে আমাদের কিছু বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে-
ক) জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে
খ) খসড়া জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি চূড়ান্ত করতে হবে
গ) খসড়া জাতীয় তামাক চাষ নীতি চূড়ান্ত করতে হবে
ঘ) তামাক কোম্পানি থেকে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহার করতে হবে
ঙ) তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধিতে যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে
চ) সিএসআর (কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি ) এর আওতায় তামাক কোম্পানিগুলো যে কাজ করে তার এখতিয়ার কমাতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে দেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। যে দেশে ২০২৯ সাল পর্যন্ত শিশুদের ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা গেছে সেখানে ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করা খুবই সম্ভবপর একটি বিষয়। আমাদের ২০১৭-১৮ সালে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নাম লিখিয়েছি। উন্নয়নের এ যাত্রাকে অব্যাহত রাখতে দরকার স্বাস্থ্যবান জনগণ। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়াকে যদি চূড়ান্ত করা হয় এবং এর সফল প্রয়োগ করা যায় তাহলে দেশের প্রায় ৪ কোটি তামাক ব্যবহারকারী এ বদভ্যাস থেকে যেমন বের হয়ে আসবে তেমনি তামাকজনিত দ্রব্য ব্যবহারে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি তাও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব।
২০৪০ সালের তামাকমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে আপনার আমার সদিচ্ছা ও সরকারের চেষ্টা সমন্বিতভাবে কাজ করবে এই হলো প্রতিটি সচেতন নাগরিকের প্রত্যাশা।
অর্পিতা চৌধুরী, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
( মতামত কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত। এজন্য সম্পাদক দায়ী নয়।)