0

ইরা এবং কয়েকটি স্ক্রিনশট

Share

তওহিদ মাহমুদ হোসেন

এক

সকাল সাড়ে এগারটা। আর দশটা দিনের মতোই ইরা ছেলেকে অনলাইন ক্লাসে বসিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। কয়েকটা গাছ অল্প একটু যত্ন পেয়েই কি অদ্ভুত সুন্দর ভাবেই না সাজিয়ে রেখেছে ছোট্ট বারান্দাটাকে। এই সময়টা ইরার খুব প্রিয়; একদম নিজের একটা সময়। সবুজ রঙের একটা চেয়ার আছে ওর। গুটিসুঁটি মেরে বসে এই সময়টা এক কাপ চা খায় ও। আকাশে তখন একেক রঙের খেলা। আজ ঝকঝকে নীল আকাশে গোল বলের মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। সবুজের মাঝে সাদা লোমওয়ালা ভেড়া চড়ে বেড়ালে দেখতে কতকটা এইরকমই লাগে।

ঝিরিঝিরে একটা মৃদু টুং-টাং শব্দে ইরার ঘোর ভাঙ্গে। অপরিচিত নম্বর।

– হ্যালো। কে বলছেন?

– আপনে কি ইফতির মা?

খুব বিস্মিত হলো ইরা। কন্ঠস্বরে বোঝাই যাচ্ছে, বক্তা একটি ছেলে এবং তার বয়স বেশি নয়। কিন্তু এতো অমার্জিত ভঙ্গি! ইফতি ওর বড় ছেলে। বিস্ময় চাপতে চাপতেই ইরা উত্তর দিল,

– হ্যাঁ, আমি ইফতির মা। তুমি কে বলছ?

– আমি কে, সেইটা আপনার জানার দরকার নাই। আপনার ছেলেকে সাবধান কইরা দিয়েন। সে বহুৎ ফাউল করসে।

– ফাউল করেছে মানে? কী বলো এইসব?

হতভম্ব ইরার কানে এরপরের দুই মিনিট ছেলেটা যা ঢেলে গেল তার সারমর্ম হলো, ইফতি ক্লাস চলাকালীন তার ক্লাসের একটি মেয়েকে ‘অশ্লীল’ মেসেজ পাঠিয়েছে। মেয়েটি ব্যাপারটা স্যারকে জানানোর পর কোন ‘প্রতিকার’ না পেয়ে ‘বড়ভাইদের’ জানায়। কলার সেই ‘দরদী বড়ভাইদের’ একজন। চাঁছাছোলা ভাষায় ছেলেটি জানিয়ে দেয় যে, এরপর তার দলবল ইফতিকে আচ্ছামত সাইজ করবে। 

ব্যাপারটা অনেকটা এই রকম যে, ইরাকে এসে বলা হলো, তোমার ডানহাতটা নেই যদিও ইরা নিজ চোখে দেখছে ডান হাত আছে। ততক্ষণে হতভম্বভাব থেকে নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে ইরা। দৃঢ় কন্ঠে জানতে চাইল, এই অভিযোগটার প্রমাণ কী৷ কিছুক্ষণ পরই হোয়্যাটঅ্যাপে কয়েকটি স্ক্রিনশট এসে হাজির। জুম ক্লাসের মেসেজিং অপশনের স্ক্রিনশট। ওপরে জ্বলজ্বল করছে ইফতির পোষাকী নামটা আর নিচে ‘জনৈক ফারিয়ার’ সাথে কথোপকথন।

ফোনদাতা কিন্তু একবিন্দুও মিথ্যা বলেনি। মাথায় বজ্রপাত হলে মানুষ যেমন প্রস্তরিভূত হয়ে পড়ে, ইরার অবস্থা ঠিক তেমন। তবে সৌভাগ্যবশতঃ ইরা আর দশটা মা এর মতো নয়। ছেলেকে সে ভালই চেনে। এই কাজ ইফতিকে দিয়ে সম্ভব নয়। কোথায় একটা বড় ধরণের ঘাপলা আছেই।

– ইফতি। ইফতিইই…।

গলা চড়িয়ে ডাকলো ইরা ছেলেকে। হেলতে দুলতে ছেলে এসে দাঁড়াতে ইরা পুরো ব্যাপারটা খুলে বললো। জানে, ইফতি মিথ্য বলে না। ছেলেটার শান্ত স্বভাব। নিরীহ টাইপের। ‘অভিযোগ’ শুনে তো চক্ষু চড়কগাছ। এরপরের কাহিনীটা সংক্ষেপে এই।

ইফতির ক্লাসে নিয়মিতভাবেই কিছু ছেলে উল্টোপাল্টা আইডি দিয়ে লগ ইন করে। এরা ক্লাসে গোলমালও করে সবচেয়ে বেশি। অদ্ভুতভাবে স্যার এদের কখনই শাস্তি দেন না। সর্বোচ্চ যেটা করেন, সেটা হলো ক্লাস থেকে কদাচিৎ বের করে দেন। ক্লাস পরিচালনার জন্য ইফতিসহ আরো কয়েককনকে উনি কো-হোস্ট বানিয়ে দেন যারা স্যার যখন পড়াতে থাকেন, তখন এই রকম মিথ্যা আইডিধারী অথবা গোলমালকারীদের মিউট করা বা ওয়েটিং রুমে পাঠিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে।

এদের মধ্যেই একজন লগ ইন করে নিজের নামটা বদলে ইফতির নাম এবং ছবি বসিয়ে দিয়ে কাজটা করেছে। ফরচ্যুনেটলি সেদিন ইফতি ক্লাসে অনুপস্থিত ছিল যেটা স্যার আগেই জানতেন। তো, কালপ্রিট ছেলেটা সেই নাম ব্যবহার করেই মেসেজগুলো পাঠায় ওই মেয়েকে যার নিজের আবার প্রেম ওই ‘দরদী বড়ভাই’ এর সাথে। 

ব্যাপারটা জানবার পর ইরা স্যারের সাথে যোগাযোগ করলে ব্যাপারটা সত্যতা বের হয়। দুই দিনের মধ্যে মূল কালপ্রিটও চিহ্নিত হলো। হাতে পায়ে ধরার কারণে ইরা ব্যাপারটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করেনি বা ছেলেটের বাবা-মা’কে জানায়নি। তবে ওই মুহূর্তটায় যে মানসিক ধাক্কাটার মধ্যে দিয়ে ইরা এবং ইফতি গিয়েছে, সেটার মেরামত করবে কে? 

দুই

নিউ-নরমাল সময়ে ঘরবন্দি হওয়ার অনেক আগে থেকেই আমাদের স্ক্রিনটাইম বেড়ে গিয়েছিল এবং এর বিরাট একটা অংশ কেটেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আগে তা-ও বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতো। কিন্তু ঘরবন্দি জীবনে পড়াশোনা এবং সামাজিকতা – দুটোর জন্যই ওদেরও অনলাইন অ্যাক্টিভিটি বেড়ে গিয়েছিল বাধ্য হয়েই।

ওপরের গল্পটার নামগুলো কাল্পনিক হলেও ঘটনাটা কিন্তু কাল্পনিক নয়। এভাবেই অহরহ ঘটে যাচ্ছে সাইবার বুলিং, যার শিকার হচ্ছি আমরা এবং আমাদের শিশুরা। সবচেয়ে ইন্টরেস্টিং হলো, এই আমরাই কিন্তু আবার উল্টো সাইবার বুলিং করে ফেলছি – কখনও না বুঝেই আবার কখনও আটঘাট বেঁধেই।

সমস্যা হলো, দুটো ক্ষেত্রেই আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’ এবং ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬’ এর মধ্যে। ‘আমি বুঝতে পারিনি’ অথবা ‘আমার জানা ছিলো না’ – এই ধরণের যুক্তি দিয়ে পার পাওয়ার কোন সুযোগ নেই কারণ সব ধরণের জানার পথ অলরেডি উন্মুক্ত।

অন্তর্জালে বলা বা লেখা কোনকিছুই কিন্তু হারিয়ে যায় না। সবকিছুর ট্রেস রয়েই যায়। সামনাসামনি যে কথা উচ্চারণ করাও সম্ভব নয়, সেটা অবলীলায় লিখে ফেলা হয় ফেসবুকের ওয়ালে, কমেন্ট হিসেবে, ইউটিউবে আপলোড করে অথবা কোন রিপোর্ট বা খবরের নিচে।

‘সাইবার টিমস’ এর সি.ই.ও. এবং আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সাদাত রহমান এজন্যই দারুণ একটা কথা বলেছেন, “ইন্টারনেট পেনসিল নয় যে লিখে তা আবার মুছে ফেলা যাবে।”

সাইবার বুলিং এর অনৈতিক দিকটা আপাতত উহ্য রাখলাম। আমাদের গণ-নৈতিকতার যে হাল, তাতে ওই আলোচনা নিরর্থক। আর নীতিবোধের চশমা পরবার দায়িত্বও যার যার নিজের। তবে এই লেখাটা পড়লে অনেকেই অনেকেরই আঁতকে উঠার সম্ভাবনা আছে। কারণ? আর কিছুই না। নিজের করা অথবা নিজের সাথে ঘটে যাওয়া এমন অসংখ্য ঘটনা মনে পড়ে যাবে, যেগুলো উপরে উল্লেখিত দুটো আইনের আলোকে দন্ডণীয় অপরাধ। তবে এতে লাভও আছে দুটো – আপনি সতর্ক হবেন এবং আপনি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে পারবেন। ইতোমধ্যেই আমরা জেনে গিয়েছি, এই দুটো আইনের ব্যাপকতা এবং প্রয়োগ যোগ্যতা কতটুকু। 

ব্যক্তিগত এবং খুব কাছের কিছু মানুষের দুর্বিষহ অনলাইন অভিজ্ঞতা থেকেই মনে হলো, ‘সাইবার বুলিং’ ব্যাপারটা একটু তলিয়ে জানি। পড়তে পড়তেই ভাবছিলাম- আদা তো দূরের কথা, আমি কাঁচামরিচের ব্যাপারীও না। এরপর আবার লিখতে বসেছি টাইটানিক নিয়ে। কেন জানেন? ‘বাঁচতে হলে জানতে এবং জানাতে হবে’ – আমি এই নীতিতে বিশ্বাসী। জানাটা ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকে আর জানানোটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে। 

তিন

শুরুটা গুছিয়ে করবার জন্যই দ্বারস্থ হলাম অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজের কাছে। দুটোই কাছাকাছি সংজ্ঞা দিয়েছে এইভাবে: কোন ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে কাউকে উত্ত্যক্ত করা, হুমকি দেয়া বা ভয় দেখানো বা এরকম বার্তা প্রেরণ, কারো বিরুদ্ধে গুজব রটানো, যৌন মন্তব্য করা, একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করা,  ঘৃণামূলক মন্তব্য করা, ইত্যাদি কাজকে সাইবার বুলিং বলা হয়।

লেখাটা যেহেতু সাইবার বুলিং (এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সাইবার ক্রাইম) নিয়ে তাই বাংলাদেশ পেনাল কোডের চারটা আইনের নাম মনে রাখা ভাল।

> ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮

> তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬

> পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২

> বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১

‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’ তে মোট ৬২টি ধারা আছে। তবে আমাদের আপাতত দরকার ২, ৩, ২১, ২৫, ২৬, ২৮, এবং ২৯ নম্বর ধারা। অন্যদিকে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬’ পড়ে আমার মনে হয়েছে, এটা মূলত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’ কে আরও ব্যাপকতা দিয়েছে। টেলিযোগাযোগ আইনের ধারা ৬৯, ৭০, ৭১ আমাদের আপাতত দরকার। পর্নোগ্রাফি আইনটি ছোট। তবে এর ২, ৪, ৮, এবং ৯ নম্বর ধারা কাজে আসবে। 

বিশাল এই আইনগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে অসংখ্য ‘টার্ম’। যেমন, ডিজিটাল মানে কী? ডিজিটাল ডিভাইস বলতে কোনগুলোকে বোঝায়? ব্যক্তি এবং সেবা প্রদানকারী দ্বারা কাকে চিহ্নিত করা হয়? মানহানি কখন এবং কিভাবে হয়, ইত্যাদি। এগুলোর ব্যাখ্যা এতোই ব্যাপক যে চুল পরিমানও গ্যাপ নেই। সুতরাং চাইলে আপনিও চেপে ধরতে পারবেন আবার আপনাকেও আটকানো যাবে। তবে বিশেষভাবে দেখা দরকার দুটো ধারা – ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের ধারা-২৫ (আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ, ইত্যাদি) এবং ধারা-২৯ (মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার, ইত্যাদি)।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনুসারে কেউ যদি কোনো ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলে জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, তা হলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হবে একটি অপরাধ। এর শাস্তি  অনধিক ৩ হতে ৫ বছর কারাদণ্ড, বা অনধিক ৩ থেকে ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ড।

একইভাবে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে যা (১) মিথ্যা ও অশ্লীল (২) কেউ তা পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে পারে (৩) যার দ্বারা মানহানি ঘটে (৪) আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে (৫) রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় ও (৬) কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে, তাহলে এমন ধরনের তথ্যের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হলে তিনি সর্বোচ্চ ১৪ বছর এবং কমপক্ষে ৭ বছর কারাদন্ডে দন্ডিত  হবেন। সেই সঙ্গে এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানাও হতে পারে। 

চার

 আলোচনার ক্ষেত্রটাকে এবার একটা স্পেসিফিক পয়েন্টে আনি। আগের প্যারাতে একটা লাইন ছিল – “কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করা”। এটার সাথেই ‘মানহানি’ ব্যাপারটা চলে আসে। এই ‘মানহানি’ বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে “পেনাল কোড (১৮৬০ এর অ্যাক্ট XLV) এর সেকশন ৪৯৯” এ। এর ২১ নম্বর অধ্যায়টা হলো ‘ডিফেমেশন’, অর্থাৎ ওই ‘মানহানি’ নিয়ে। মানহানির ওই অধ্যায়ে ১০টা ব্যতিক্রম বলা আছে। মানে কোন কোন কাজ মানহানি হিসেবে বিবেচ্য হবে না। ওই ব্যতিক্রমগুলো যথেষ্ঠ ব্যাপক হলেও এর বাইরের অংশটুকু এর বহু, বহু গুণ বেশি বড়। 

একটা উদাহরণ দেয়া যাক। চারজন ব্যক্তি – জয়গোবিন্দ সেন, জুলেখা খানম, জিতু বড়ুয়া এবং জুলিয়া রবার্টস। বলাই বাহুল্য, নামগুলো কাল্পনিক না হলেও কারও সাথে ইচ্ছাকৃতভাবে মিলিয়ে লেখা হয় নি। মিল থাকলে সেটা একান্তই কাকতালীয় এবং দয়া করে ধর্মীয় কোন সেগ্রিগেশন করবেন না। জয়গোবিন্দ ফেসবুকে একটি বিষয় নিয়ে পোস্ট দিলেন। লেখাটা পড়ে জুলেখা মন্তব্য করলেন, “আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খবর নিতে গিয়ে বেকুবের মতো ভুলভাল লিখেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে আপনি একটি আকাট মুর্খ।” 

এটি মানহানিকর বক্তব্য হিসেবে বিবেচিত হবেনা কারণ, জয়গোবিন্দ লেখাটা সবার জাজমেন্টের জন্য পোস্ট দিয়েছেন এবং সেটা পড়ে সেই লেখাটার আলোকেই সুনির্দিষ্টভাবে জুলেখা জয়গোবিন্দকে ‘বেকুব’ এবং ‘আকাট মূর্খ’ বলেছেন। এখন, উপরের মন্তব্যের পর স্বাভাবিকভাবেই বিতর্ক শুরু হলো এবং সচরাচর যা দেখি, দুই পক্ষ দাঁড়িয়ে গেল যুদ্ধংদেহি অবস্থান নিয়ে। ফলে আলোচনা খুব দ্রুতই পোস্টের বিষয় থেকে সরে গিয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপরে (এ ক্ষেত্রে জয়গোবিন্দ অথবা জুলেখা) সংকুচিত হয়ে গেল। তখন কী ঘটে?

উত্তপ্ত বিতর্কের এক পর্যায়ে জয়গোবিন্দকে লক্ষ্য করে জিতু মন্তব্য করলেন লম্বা থ্রেডে – ‘আপনে একটা ক্যাচাল লাগানো মানুষ। কাম-কাজ নাই। নিজের ফ্রাস্ট্রেশন ঝাড়তে আসছেন এইখানে।’ এইবারে জিতু কিন্তু ফেঁসে গেলেন মানহানিকর বক্তব্য দিয়ে। কারণ এই মন্তব্যে জয়গোবিন্দকে যেভাবে চিত্রায়িত করেছেন জিতু, সেটার সাথে লেখার বিষয়ের কোন সম্পর্ক নেই। 

আবার আরেকটা অবস্থা কল্পনা করা যাক। জুলিয়া একটা সেল্ফি দিয়েছেন। সেখানে জয়গোবিন্দ লিখলেন – “তোমার এই যৌবন দেখে ঘুম হয় না। ইশ! আগে কেন চিনলাম না? তাহলে তো প্রেম হয়ে যেতেও পারতো।’ আপাত নিরীহ এই মন্তব্য কিন্তু জুলিয়ার কাছে যৌন হয়রানিমূলক মনে হতেও পারে। সে ক্ষেত্রে জুলিয়া মানহানির অভিযোগ আনতে পারেন জয়গোবিন্দের বিরুদ্ধে।

এরকম নানারকম পরিস্থিতির সিমুলেশন করা যায়। বিশেষ করে মেয়েদের ছবিতে মন্তব্য করতে গিয়ে অনেকসময়ই কিছু ব্যক্তি এমন শব্দচয়ন করে বসেন, যেটিকে হয়তো ওই ছবির ধারিণীর দৃষ্টিতে ‘যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য’ মনে হতে পারে। আর হ্যাঁ, এই ব্যাপারটা ছেলে বা মেয়ে – উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

পাঁচ

এবার ২ মিনিটের পজ নেই আমরা।  চোখ বন্ধ করে ভাবুন, এইরকম অভিজ্ঞতা আপনার হয়েছে কি না। যদি হয়ে থাকে, তাহলে হয় আপনি সাইবার বুলিং এর ভিক্টিম, নয় বুলিংকারী। প্রথমটা আতংকজনক এবং কষ্টদায়ক আর দ্বিতীয়টা? সে অতি বিপজ্জনক কাজ হে ভায়া।

লেখাটা ফেসবুকের লিংক ক্লিক করেই পড়ছেন তো? সময় তো বেশিরভাগ এইখানেই কাটে। তো আসেন, ফেসবুকেই ঢুকি। ‘তথ্য যোগযোগ ও প্রযুক্তি আইন’ অনুযায়ী ফেসবুকে কৃত যেসব কাজ দণ্ডনীয়, সেগুলোর কয়েকটা উদাহরণ দেই। 

– ফেসবুকে মিথ্যা ও অশ্লীল এমন কোনো কিছু ব্যবহার করা যাবে না, যা কোনো ব্যক্তি পড়ে, দেখে ও শুনে নীতিভ্রষ্ট হতে পারে।

– কোনো স্ট্যাট্যাস বা ট্যাগের কারণে কারো মানহানি ঘটে এমন কোনো কিছু করা যাবে না।

– এমন কোনো কিছু লেখা যাবে না যার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে।

– এমন কিছু লেখা ও ট্যাগ করা যাবে না যার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়।

– এমন কোনো কিছু লেখা যাবে না যার মাধ্যমে কারো জাত, বর্ণ ও ধর্মীয় অনূভূতিতে আঘাত লাগতে পারে।

– ফেইক আইডি বানানো এবং ব্যবহার করা যাবে না।

এবং ২০১২ সালের পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন। এই আইন অনুসারে ‘‘পর্নোগ্রাফি’’ অর্থ: (১) যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোন অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য যাহা চলচ্চিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থির চিত্র, গ্রাফিকস বা অন্য কোন উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যাহার কোন শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই; (২) যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অশ্লীল বই, সাময়িকী, ভাস্কর্য, কল্পমূর্তি, মূর্তি, কাটুর্ন বা লিফলেট; (৩) আগে বর্ণিত বিষয়াদির নেগেটিভ ও সফট ভার্সন।

অন্যদিকে ‘‘পর্নোগ্রাফি সরঞ্জাম’’ অর্থ পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ, ধারণ বা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত ক্যামেরা, কম্পিউটার বা কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, সিডি, ভিসিডি, ডিভিডি, অপটিক্যাল ডিভাইস, ম্যাগনেটিক ডিভাইস, মোবাইল ফোন বা উহার যন্ত্রাংশ এবং যে কোনো ইলেক্ট্রনিক, ডিজিটাল বা অন্য কোন প্রযুক্তিভিত্তিক ডিভাইস। এই আইন বলছে, কোনো ব্যক্তি ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইট বা মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি সরবরাহ করলে তিনি এ ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত সশ্রম  কারাদন্ড এবং দুই লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।

কাজেই এরপর থেকে ‘বিশেষ’ লিংক/ভিডিও/ছবি/স্ক্রিনশট, ইত্যাদি মজা করার জন্য হলেও চালাচালি করার আগে এই কথাটা মনে রাখলে ভালো। সাধারণত বন্ধুবান্ধবের ক্ষুদেবার্তার গ্রুপে এ ধরণের ঘটনা আকছারই ঘটে। পোস্টদাতা, গ্রহীতা, অন্যকে শেয়ারদাতা এবং সর্বোপরি ওই গ্রুপের পরিচালক – সবাই-ই কিন্তু দায়ভারে পড়ে যাবে।

ছয়

এতদূর পড়ে থাকলে ধরে নেওয়াই যায় যে, আগামীতে আপনার সতর্কতা যেমন বাড়বে এ ধরণের কাজ না করবার ক্ষেত্রে তেমনি মানসিক জোরও বাড়বে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহনের। মানসিক জোর বাড়ার কারণ, সাইবার বুলিং এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে বিদ্যমান নিচের সাপোর্ট মেক্যানিজম। 

> অনলাইনে সহিংসতা ও সাইবার হয়রানির শিকার হলে আইনি সহায়তা নেওয়ার জন্য কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, সাইবার পুলিশ সেন্টার

> অ্যাপ: হ্যালো সিটি অ্যাপ, রিপোর্ট টু র‍্যাব অ্যাপ, সাইবার টিনস

> হটলাইন: ৯৯৯ (সবার জন্য), ১০৯৮ (শিশুদের সহায়তায়) ১০৯ (নারী ও শিশুদের সহায়তায়), 01320000888 (নারীদের সহায়তায়), 01766678888 (সাইবার ক্রাইম হেল্পলাইন), 

> মেয়েদের জন্য বিশেষ করে Police Cyber Support for Women PCSW নামে ফেসবুক পেইজে মেসেজ দিয়ে অভিযোগ জানাতে হবে। এটি মূলত একটি তথ্য জানানোর সেবা, যেখানে অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত এবং পরামর্শ প্রদানসহ সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা থাকবেন পুলিশের নারী সদস্যরা। 

> বিটিআরসি’র +880-29611111 নম্বরে ফোন করে অথবা ইমেইল করে জানানো হলে বিটিআরসি সাধারণত ২৪ ঘন্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেবে। 

সাত

রি-অ্যাকটিভ হওয়ার থেকে প্রো-অ্যাকিটিভ হওয়াটা আগে দরকার। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ বেশি কার্যকরি। কাজেই অনলাইনে নেতিবাচক, অনৈতিক এবং অন্যায় কাজগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টাটা শুরু করে দেওয়াটাই সবচেয়ে ভালো। খুব সাধারণ কয়েকটা ডু’জ অ্যান্ড ডৌন্টজ মনে রাখলেই কিন্তু চলে। একটা সামারি করে ফেলি তাহলে।

– পোস্টের কনটেন্ট সম্পর্কে সতর্ক থাকা

– পরিচয় গোপন করে কোন কর্মকান্ড না চালানো

– যে কোন ধরণের ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণাত্মক মন্তব্য পরিহার করা

– উল্টোপাল্টা পোস্ট/কমেন্টে ট্যাগ করা বা লাইক/লাভ দেওয়া থেকে বিরত থাকা

– কোন খবর বা ভিডিওর নিচে কমেন্ট হিসেবে এমন কিছু না লেখা যেটা নিজের ক্ষেত্রে হলে কষ্ট পেতাম

– নেতিবাচক কোনকিছু ছড়িয়ে দেওয়া। ‘স্ক্রিনশট’ চালাচালি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য।

– বুলিং/ক্রাইমের প্রমাণ রাখা এবং রিপোর্ট করা

– নেতিবাচকতা এড়িয়ে যাওয়া (যদ্দুর সম্ভব আর কি)। বদলে সৃষ্টিশীল কাজ করা এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানো। 

শেষ করছি নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে: কোনো মানুষ মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (সত্যাসত্য যাচাই না করে) তাই বলতে বা প্রচার করতে থাকে’। এ ধরনের নীতিবাচক কথা সকল ধর্মেই আছে।

যাচাই না করে, দু পক্ষের গল্পটা না জেনে, কেবল নিজের প্রি-সেট মানসিকতার ওপরে দাঁড়িয়ে জাজমেন্টাল হয়ে চিন্তা করার অভ্যাস ছাড়তে পারলেই মোক্ষলাভ। তখন আর কোন আইন নিয়ে দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। আপনার ‘ভেতরের আমি’ই সব ফিল্টার করে দেবে। 

তওহিদ মাহমুদ হোসেন, লেখক ও ব্যাংকার

( রোকেয়ানামার মতামত কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের ব্যক্তিগত মতামত। এজন্য সম্পাদক দায়ী নয়।)