জেসমীন আক্তার
আয়নার প্রতিবিম্বে বাঁকা হয়ে যাওয়া টিপটা বার বার চেষ্টার পর অবশেষে ঠিক করতে পারল,অনেক বছর পর পরার কারনেই হয়তো এই দূর্ভোগ পোহাতে হলো।ঠোঁটে হালকা একটু লিপস্টিক লাগিয়ে চিরুনীর স্পর্শে সিল্কি চুলগুলো পিঠ জুড়ে ছেড়ে নিল।অদুরে বসা শীলার মা নীল শাড়ি, নীল টিপে মেয়ের এমন স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে পৃথিবীর কাউকেই কোনো সাক্ষী না রেখেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে দিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন আজকে অফিস থেকে কোথাও যাবি না কি? শীলা উত্তর দেয় না মা,আজকে এক কলিগের জন্মদিন উপলক্ষে অফিসেই সবাই মিলে একটা পার্টির আয়োজন করেছি। সাথে এও বলে রাসা কে স্কুল থেকে আনার সময় ওর ক্লাস টিচারের কাছ থেকে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড আনার জন্য।
রিকশার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা শীলাকে অনেকটা চমকে দিয়ে তার সামনে একটা পাজেরো গাড়ি থামে। অপ্রস্তুত শীলাকে গাড়ির ভেতর থেকে কেয়া জিজ্ঞেস করে কোথায় যাবি? শীলার অফিসে যাওয়ার কথা শুনে বলে আমি শপিংয়ে যাচ্ছি, তুই ওঠে বোস তোকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে যাব। শীলা সাথে সাথেই না বলে। অগত্যা কেয়া গাড়ি থেকে বের হয়ে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিল।তার কয়টা বাড়ি আছে, কয়টা গাড়ি আছে,বছরে কয়বার বিদেশে বেড়াতে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি।
শীলা শুধু হু হা করে উত্তর দেয় আর এদিক সেদিক তাকায় রিকশার জন্যে,অবশেষে রিকশা পেয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে।রিকশায় উঠার আগ মুহূর্তে সৌজন্য মূলক বিদায় নিচ্ছিল এমন সময় কেয়া বলেই ফেললো তুই এখনো আগের মতোই জেদি আছিস, যা-ই হোক এত সেজেগুজে বের হয়েছিস,আরেকটা জুটিয়েছিস না কি? এবার শীলার চোয়াল শক্ত হ’য়ে গেল, কিছু না বলেই রিকশায় উঠে গেল শুধু কঠিন একটা দৃষ্টি কেয়ার চোখের উপর রেখে আর মনে মনে শুধু একটা কথাই বলে গেল, ” প্রতিরাতে ধর্ষিত হোস দাম্পত্য বিছানায়, আর দিনের বেলা বড় বড় কথা আওড়াস”।
হ্যাঁ, কেয়া আর শীলা একই পাড়াতে বড় হয়েছে বন্ধুর মতো না থাকলে জানাশোনা ছিল ভালো। শীলা বরাবরই যেমন সুন্দরী তেমন পড়াশোনায়ও ভালো ছিল। এলাকার ছেলেরা শীলার সৌন্দর্যে হাবুডুবু খেলেও ওর কাছ থেকে কোনো সাড়া পায়নি কারন শীলার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন অতি শক্তিশালী একটি আভরণ দিয়ে নিজেকে আগলে রাখতো সবসময়।
আর কেয়া পড়াশোনায় কখনোই ভালো ছিল না এবং বিয়ের আগ পর্যন্ত সে একাধিক ছেলের সাথে প্রেম করে অবশেষে অনেক টাকা পয়সা আছে এমন একজনের তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে নিজেকে আবদ্ধ করে। এদিকে শীলার স্বপ্ন অন্যকিছু হলেও মা বাবার কথা রাখতে গিয়ে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারেই তথাকথিত একটা ভালো পরিবারে বিয়ে হয়, শর্ত একটা থাকে সেটা হলো পড়াশোনা শেষ করতে দিতে হবে। বর পক্ষ তাই মেনে নেয়। বিয়ের কিছু দিন ভালোই যায় এরপর থেকে শুরু হয় বাচ্চা নেওয়ার জোরাজোরি। প্রথমে শীলা ভয় পেয়ে যায় পাছে তার পড়াশোনার না ক্ষতি হয়।
সংসারের দায়িত্বগুলো মেইনটেইন করে প্রথম সন্তানটির জন্মও দিল পাশাপাশি পড়াশোনাটাও ধরে রাখলো। যদিও ইয়ার লস হয়েছে। কিন্তু মেয়ের বয়স দুই বছর হতে না হতেই ওর হাজবেন্ড এবং পরিবারের সবাই ছেলে সন্তানের আশায় আরেকটা সন্তান নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল তখনই শীলা ভেঙে পড়েছিল অনেক টা মনের কষ্টে এবং হতাশায়। সে কাউকেই বোঝাতে পারছিল না ছেলে সন্তানই বা এতো জরুরি কেন, আর কিছু দিন পরে নিলে কিইবা এমন ক্ষতি হবে?
আর কিছু দিন সময় পেলে ওর পড়াশোনা শেষ করতে পারবে একথা তো কাউকে বোঝাতে পারলোই না বরং তাকে বোঝানো হলো ওর পড়াশোনার জন্য শ্বশুর বাড়িতে সাংসারিক কাজকর্মে অনেক সমস্যা হচ্ছে। ছোট বাচ্চাটারও অনেক কষ্ট হচ্ছে, মেয়েদের এত পড়ার দরকার ই বা কি? এ-ই প্রশ্নও উঠেছে। একটা ছেলে বাচ্চার জন্ম দিয়ে বংশের প্রদীপ রক্ষা করাই যেন মেয়েদের আসল ধর্ম,এভাবেই তাকে বোঝানো হচ্ছিল। কিন্তু না, শীলা জীবনের অনেক কিছুর সাথে আপোষ করেনি এবারও করলোনা। চলে এসেছিল মেয়েকে নিয়ে, ফিরেও তাকায়নি আর ওই পথ। পড়াশোনা শেষ করে এখন জব করছে,মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। পি এইচ ডি করার জন্য এপ্লাই করেছে এখন শুধু স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার অপেক্ষা…
হ্যাঁ, যখন সে বাড়িতে ফিরে এসেছিল শীলার বাবা একটু দ্বিমত করলে মেয়ের পাশে ওর মা দাঁড়িয়েছিল শক্ত হাতিয়ার হয়ে। তিনি শুধু বলেছিলেন যারা কথা দিয়ে কথা রাখেনা আর যাই হোক তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা যায় না।তিনি দেখেছিলেন তার মেয়েটি কতটা সংযমী হয়ে স্বামী, সন্তান, সংসার করার পরও কতটা তীব্র আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। সংসার ছেড়ে আসা ভেঙেচুড়ে যাওয়া মেয়েকে নতুনভাবে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার আশা জাগিয়েছেন। অফিস শেষে বাড়ি ফিরে শীলা হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিজেকে এলিয়ে দিল বিছানায়। চোখ বুজে রেখেছে তারপরও ভিজে ভিজে উঠছে। শীলার মা হালকা নাশতা ও চা নিয়ে এসে মেয়ের পাশে বসলেন এবং মেয়ের যে মন খারাপ অনুমান করেই মেয়ের কপালে হাত দিলেন। মায়ের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খোলাতেই শ্রাবণ ধারা ঝরঝর করে বেরিয়ে এল। মা অনেক টা হকচকিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে তোর? শীলা এবার মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল এবং বলতে লাগলো আমি তোমাকে আর আমার মেয়েকে রেখে কিভাবে থাকবো? এমন কথা শুনে শীলার মা জানতে চায় কোথায় যাবি তুই? শীলা অনেক টা শান্ত হয়ে বলল আমি যে পিএইচডির জন্য এপ্লাই করেছিলাম সেটা কনফার্ম হয়েছে।
এবার শীলার মা’র চোখ ভিজে গেল খুশিতে।তোর এত দিনের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে আর তুই কাঁদছিস? মাত্র তো কিছু দিনের ব্যাপার , আমরা ঠিক থাকতে পারবো তোকে একটুও চিন্তা করতে হবে না, তুই যে আমাকে আজ জিতিয়ে দিলি রে মা।তোর একটা ভাই নেই বলে আমাকেও কি কম লাঞ্চিত হতে হয়েছে?
শীলা মায়ের গলা ধরে বলল,হ্যাঁ মা তুমিই তো আমাকে শিখিয়েছিলে “।পূরণ করতে হয় নিজের দেখা স্বপ্ন কে,অন্যের পাশাপাশি নিজের চাওয়া গুলোকে প্রাধান্য দিতে”। মা মেয়ের এমন কথোপকথন পেছন থেকে শীলার মেয়ে রাসা সবই শুনছিল,সে ও সামনে এসে বলল আমি নানুর কাছে ঠিক থাকতে পারবো তুমি আমাকে নিয়ে একটু ও চিন্তা করো না।আমিও তোমার মতো বড় হয়ে বিদেশে পড়াশোনা করতে যাবো,তুমি ঠিক দেখে নিও। শীলা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে গভীর মমতায় কিছুক্ষণ বুকের মধ্যে আগলে রাখল,মেয়ে যেন মায়ের বুকের গহীনের অব্যক্ত কথাগুলো নিজের মধ্যে শুষে নিল।