শারমিনুর নাহার
এটা কোন টেক্সট বা নোট নয়, এটা একটা সুইসাইড নোট। যে ব্যক্তিটি আর একটু পরেই মারা যাবে তার মৃত্যুর পরোয়ানা এটি। অনেক পরিকল্পনা করে যে মারা যায় তারই সাধারণত এমন সুইসাইড নোট থাকে। কিন্তু এই ব্যক্তিটি খুব বেশি পরিকল্পনা করে যদিও মারা যাচ্ছে না। তবুও সে একটি সুইসাউড নোট লিখেছে। কারণ তাঁর মৃত্যু নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলুক, নানা ভাবনার ডাল-পালা গজিয়ে উঠুক- সেটা তার পছন্দ নয়। ভাবনার ডাল-পালার যে কোন সীমা থাকে না সেটা তো সে আজ হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছে। তাই মারা যাবার আগে সে নিজেই পৃথিবীকে তাঁর চলে যাবার কারণ জানিয়ে যেতে চায়। সেই চিন্তা থেকেই লেখা-এই সুইসাইড নোট।
মারা যাবার প্রাথমিক কারণ হিসেবে সে মনে করে (দুনিয়ার আর সব সুইসাইড নোটের মতোই ) বেঁচে থেকে তার আর কী হবে! কিংবা সে মরে গেলে দুনিয়ার কারোরই বা কি যায় আসে। সুতরাং এটা একটা সচেতন মৃত্যু। সে স্বেচ্ছায় তার জীবনের ইতি টানছে। কালের অমোঘ নিয়মে যেমন সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে, তেমনি তাকেও যেতে হতো। কিন্তু তার ক্ষেত্রে সেই যাওয়াটা প্রাকৃতিক হলো না। প্রকৃতির জীবনটাকে সেই জীবনীকারই ধ্বংস করে দিল। না, এটা ঠিক হলো না, তার জীবনীকার তো সে নিজে নয়-তাকে জীবন দিয়েছে মা-বাবা। সে অন্যের দ্বারা জীবন পেয়েছিল, জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু আজ সে নিজেই নিঃশেষ করতে যাচ্ছে।
ছেলেবেলায় কোথায় যেন পড়েছিল-ঠিক মনে নেই, তেলাপিয়া মাছ নাকি স্রোতের মুখে ডিম ছেড়ে আবার স্রোতের সামনে গিয়ে হা করে থাকে। স্রোতে তোড়ে ভাসতে ভাসতে তখন ডিমগুলো আপনিই তার মুখে চলে আসে। এটাকে এভাবে বলা যেতেই পারে-মা নিজেই তাঁর সন্তানকে খেয়ে ফেলছে। তাই তার নিজেকে নিঃশেষ করাটা কেন প্রকৃতিকে নষ্ট করা হবে? সে কী অধিকার রাখে না? এত চিন্তাই বা সে কেন করছে- মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে, মরে যাবে। এটা তার ইচ্ছের স্বাধীনতা। যদিও তার মৃত্যুর কারণে নিত্য-নৈমত্তিকতার কোথাও ঘাটতি হবে না। প্রতিদিনের মতো কালও ভোর হবে। মহানগরের শুভ্র কুয়াশা ভোরে সিটি করপোরেশনের ঝাড়ু–দাররা বেরিয়ে পড়বে ঝাড়ু হাতে। গায়ে ফিরোজা রঙের এপ্রোন পরে লম্বা ডান্ডার ঝাড়ু– হাতে কালো পিচ ঢালা পথে তারা ধূলোর পাতা এঁকে যাবে।
সময়মত সকলে হুড়োহুড়ি করে নিত্য যেমন যায়, তেমনি কাজে চলে যাবে। কেউবা ভোরের আলো ফোটার আগেই দুঃস্বপ্নে জেগে যাবে। আবার কেউবা সুমধুর কোন স্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে তার শারীরিক আকাঙ্খিত নারীটির এসএমএস দেখবে মুঠোফোনে…. ‘তোমাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে’। পড়ে আনন্দে তার বাঁচবার ইচ্ছে হবে। কখন দেখা হবে-সেই ভাবনায় মন আপ্লুত হবে। দ্রুত বিছানা ছেড়ে শরীর পরিষ্কার করে, পরিষ্কার দেহ নিয়ে সে বেরিয়ে পড়বে দিনের আলোয় শারীরিক ক্ষুধা নিবারণ করতে। কেউ আবার ভোরের আলোয় নিজের দেহকে কিভাবে আরো ফিট আরো দীর্ঘজীবি করা যায় সেই চেষ্টায় রমনাতে যাবে। উপভোগ করবে ঘাম, নিজের শারীরিক শক্তি। আরো দীর্ঘদিন সুস্বাস্থ্য নিয়ে, যৌন সক্ষমতা নিয়ে টিকে থাকবে সেই ভাবনায়/ আশায় খাবারের মেনু ঠিক করবার পাশাপাশি হয়ত কার সঙ্গে কখন ডেটিং করবে সেটা নির্ধারণ করে নেবে।
রাজনীতিবিদরা যারা এখন বিরোধী দলে তারাও কে কোথায় মিছিল, পিকেটিং, অগ্নিসংযোগ করবে সেই পরিকল্পনা রাতে-করেই ঘুমোতে গেছে। ভোরে হতে শুরু হবে তার মহরত। সরকারি দল আজ বিরোধী দলকে নতুন কোন শব্দ বা ভাষা ব্যবহার করে আক্রমণ করবে, সেটা নাস্তার টেবিলে ফোনে আলাপ করে ঠিক করে নেবে। ছাপোষা কেরানিরা স্ত্রীর সঙ্গে আজকের রাতের চারবারের শেষ সংঙ্গম করে স্নান করতে যাবে। শারীরিক বেদনা নিয়ে সেই কেরানীর স্ত্রীর স্বামীর স্নানের জন্য পানি গরম করে দেবেন, বাজারের ফর্দ ঠিক করে দেবে আর দুপুরের খাবারটা সঙ্গে দিয়ে দেবে। এমনই সব চলবে ভোরের আলোয় সারা দিনের রুটিন ওয়ার্ক।
সংবাদকর্মীরা ভোরে মুঠোফোনে মেসেজ পাবে, এক গণমাধ্যমকর্মীর গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার খবর। তাড়াতাড়ি ছুটে যাবে, কেউ কেউ লাইভ করতে ব্যাকপ্যাক নিয়ে আসবে আবার কেউ অনুসন্ধান করতে থাকবে চাঞ্চল্যকর খুনের নানা তথ্য। বিডি (পুলিশ) এসে পুরো বাড়িটা সুতলি দিয়ে ঘেরাও করে দেবে। কাউকে এমনি বাড়িওয়ালাকেও ঢুকতে দেবে না। আত্মহত্যাকে ঘিরে যখন এমনই মহোৎসব চলবে, তখন স্বংয় আত্মহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিটি পালিয়ে যাবে। যেহেতু আলামত সংগ্রহকারী, সংবাদকর্মী সবাই নিজেদের শ্রেণী সর্ম্পকে সচেতন তাই তারাই প্রাথমিকভাবে দায়ী ব্যক্তিটিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবে। ‘ও হেরে গেছে আমি জয়ী’ এই আত্মপ্রত্যয় নিয়ে ব্যাংকের ক্রেডিড, ডেভিট কার্ড নিয়ে সে পালিয়ে যাবে। গণমাধ্যমকর্মী সেই আত্মহত্যাকারীর লাশ পড়ে রবে।
আচ্ছা, সে কিভাবে পড়ে রবে- যখন তার স্বামী বন্ধুটি ঘুম থেকে জেগে একবারে দরজার সামনে, তার স্ত্রীর লাশ দেখবে? সে কী তাকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামাবে-নাকি অমনি রেখে পালিয়ে যাবে? পরে মা-বাবার কাছে খবর যাবে। হয়ত কোন সুহৃদ বা বন্ধু মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে লাশটি নিয়ে যেতে বলবে। লাশ চলে যাবে গ্রামের বাড়ি। বাড়িওয়ালা- আত্মীয় পরিজনকে বলে, জিনিসপত্র নিয়ে যেতে বলবে। বাড়িওয়ালার কাজের লোক বাড়িটি ধুয়ে পরিষ্কার করবে। দুদিন পরে মিস্ত্রি এসে চুনকাম করবে। সামনের মাসে নতুন ভাড়াটিয়া উঠে যাবে। সব আগের মতো ঠিকঠাক চলবে। ভোরে সূর্য উঠবে, কোন ট্র্যাকিং গ্রুপ শীতের আমেজ উপভোগ করতে পাহাড়ের পথে হাঁটা দেবে। আবার কোন মা ঘুম ভেঙ্গে সন্তানের জন্য জায়নামাজে বসবেন। একঝাঁক চিল, কাক রাতের আড়মড়া ভেঙ্গে ডানা ঝাপটাতে থাকবে। কা-কা ডেকে উঠবে। তাদের ডাকে বড় শিরিষ গাছটা দুলে উঠবে। শহরে ভোর হবে। শুধু প্রতিদিনের মতো সেই সুইসাইডকারীর চোখ খুলবে না।
কিম্বা গলায় দড়ি দেয়া আত্মহত্যাকারীর চোখটা খুলেই থাকে। ঠিক মরা মাছের মতো সেই অনিন্দিতা নামের সুইসাইডকারীর আর পলক পড়বে না। কিম্বা তার জিবটাও বের হয়ে যেতে পারে। যদিও এমন কোন সুইসাইডকারীর লাশ সে কখনো দেখেনি, কিন্তু শুনেছে গলায় দড়ি দিয়ে মরলে নাকি বিশাল একটা জিভ বেরিয়ে আসে- অনেকটা মা কালীর মতো। তারও হয়ত তেমনটা হবে-যদিও সেটা দেখবার মতো সে
আর তখন থাকবে না। ওহ না কী ওলট-পালট ভাবছে, মরে গেলে কী কেউ আর নিজেকে দেখতে পারে? আর তার নিজেকে দেখবারই বা কী আছে। সে তো মৃত্যু দেহ দেখতে পছন্দ করে না। অনেক প্রিয় মানুষের মৃত্যু দেহ সে এই জীবনে দেখেনি। তাদের জীবিত থাকবার স্মৃতিটা হারিয়ে যাবে বলে।
অনিন্দিতা তো মরে যেতে চায়নি- অন্য সবার মতোই এই আলো-বাতাস আর মানুষকে ভালোবেসেছিল। শুধু তাকেই কেউ ভালোবাসেনি। কেউ তার আনন্দ ফিরে পেতে সাহায্য করেনি। সে সবার সহায় হবে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। আর কেউ তো তার সহায় হতে চায়নি। অনিন্দিতাই শুধু মিথ্যে আশা করেছিল। বোকার মতো আশাটাকে যখন সে আবিষ্কার করলো তখনই আর তার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হলো না। কেন হবে? জীবন তো কারও একার হতে পারেনা? আসলে জীবন যে একার এই অমোঘ সত্যটাকেই সে বুঝতে পারেনি। আর যখন বুঝতে পেরেছে তখন মানতে পারেনি। সবাই সেটাই মানে, জানে বরং তারই এটা জানা ছিল না। নির্মম এই পৃথিবীতে শুধুই সে মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছে। অন্যের মতো জীবনের অর্থবহতাকে অনুভব করতে চেয়েছে। কিন্তু মিথ্যে সব। জীবনের পেছনে ছুটে চলাকে সে অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চেয়েছে। যার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চেয়েছে সে তার সঙ্গে চায়নি। এই চাওয়া না চাওয়ার দ্বন্ধে সে আর টিকে থাকতে পারলো না, হেরে গেল। নিজে নিজেই ধ্বংসকে বেছে নিলো।
এবার আমাদের সঙ্গে আরো কিছু পরিকল্পনা নিয়ে তিনি এগিয়ে আসবেন। আসলে তিনি মারা যাবেন কিনা সেটা এখন আর তার উপরে নির্ভর করছে না। যদিও সে ভেবেছিল তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অনেক কিছুর সমাধান হয়ে যাবে, যদিও সে ভেবেছিল তার মৃত্যু কোন একজনকে হারিয়ে দেবে। আচ্ছা হার-জিত কী এমনই বিষয়? মানুষ একটা আকাঙ্খা না পেলেই কী হেরে যায়? হোক সেটা তাঁর জীবনের অঙ্গ। মানুষ কী এমনই ইচ্ছা নিয়ে এসেছিল? না, একজনের মৃত্যুতে যেমন কোন সমাধান হয় না তেমনি একজন বেঁচে থাকলেও কোথাও কোন সমস্যা হয় না। অনেক ভালো কথার মতো এটাও একটা ভালো কথা ‘জীবন মূল্যবান’। এটাকে নাকি আর পাওয়া যায় না। যদি তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কোন প্রশ্ন সমাধিত না হয় তাহলে কেন সে সবার মাঝে থাকবে না? তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভোরের আলো ফুটবার আগেই।
.
.
পাঠক অনিন্দিতা কী সুইসাইড করেছিল ভোরের আলো ফোটার আগেই নাকি অমূল্য জীবনের লোভে আরো কিছু কষ্ট স্বীকার করেছিল। সেজন্য আপনাদের ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে-
.
.
রাতের আঁধারে একটি ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেওয়া যত সহজ ভোরের আলোতে কী তেমন সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ! ভোর তো মায়া, ভোর তো শুরু, শেষ নয়…