1

সংসার

Share

কানিজ বিথী  

মাসুদ হুট করে যখন অফিসিয়াল ট্যুরের কথা বলে একেবারেই রুহির জীবন থেকে চলে গেলো,  সে সময়টাতে রুহি শোক করারও সময় পায় নি, মাসুদ তাকে ধোঁকা দিয়েছে  এই বিশ্বাসের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ালো বাকী জীবনটা কিভাবে পার করবে। কারণ রুহির মাথায় কখনোই এমন কিছু হতে পারে এই ধারণাই ছিলো না। নানা জনের  কানাঘুষাকে পাশ কাটিয়ে রুহি সবার আগে শাশুড়ি কে নিয়ে এলাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। অনেক দিনের গোছানো সংসারের প্রতিটি জিনিস বাক্স- পেটরায় বাঁধতে ব্যস্ত। শ্বাশুড়ি একপাশে বসে একটানা কয়েকদিন যাবত কেঁদেই যাচ্ছে। রুহির আপাতত সময় নেই শ্বাশুড়ির মাথায় হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার।

 রুহি তার বেডরুম লাগোয়া গাছভর্তি বারান্দায় গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। এখানে মাদুর বিছিয়ে কত বৃষ্টির রাতে একটানা বৃষ্টির শব্দ শুনেছে। হেঁড়ে গলায় গান গেয়েছে। হাত ফসকে ভেঙে যাওয়া চায়ের কাপ নিয়ে অকারণ হাসিতে দুজনেই লুটোপুটি খেয়েছে। রুহির বুক পাঁজর থেকে হঠাৎ মাসুদ শব্দটা এসেই তীব্র কান্নায় ওর চারপাশের সব ভেসে যেতে থাকে। মাসুদ ওর এতো সাধের সংসার ছেড়ে চলে গেলো। একটাবারও মাসুদের চলে যাওয়ার পায়ের শব্দ রুহি তার বুকের ভেতর অনুভব করতে পারলো না কেন, কেন পাশাপাশি ঘুমিয়েও রুহি বুঝতে পারেনি মাসুদের মনের ভেতর ঘুণপোকা ধীরে ধীরে মাকড়শার জ্বালের মতো বিস্তার লাভ করেছিলো। 

কুচকে যাওয়া বিছানার একটা কোনার চাদর ঠিক করে চুপচাপ বসে  থাকে রুহি। কি অসীম শূন্যতা রুহির চারপাশটা একটু একটু করে ওকে গিলে খাচ্ছে। পাশের রুম থেকে মায়ের কান্নার শব্দ এখনও পাওয়া যাচ্ছে। মাসুদ চলে গেছে এটাই ধ্রুব সত্য। চাইলেও আর মাসুদকে ফেরাতে পারবেনা রুহি।  অফিস থেকে ফেরার পথে কাঁচের চুড়ি কিংবা বেলীফুলের মালার জন্য আর বায়নাও ধরবে না। রুহি চোখ মুছে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়। কেউ চলে গেলে কি সবটাই নিয়ে চলে যায়? মনের ভেতর কি স্থায়ী শ্যাওলা জমে? মানুষটার নিঃশ্বাসের শব্দও কি আর  শোনা যায় না? মাসুদ চলে গিয়ে কি রুহি সব হারিয়ে ফেললো? 

নাহ খুব একটা ক্ষতি হয়নি। কেউ চলে গেলে কারোরই কিছু হয় না। বড়জোর দুএকদিন খালি খালি লাগে। শব্দের অপচয় হয় না। রাতজেগে চাঁদ দেখা হয় না। অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে রাখলে কপালে আদরের চুমু খাওয়া হয় না। ভাত বেড়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় না। খুব বেশি ক্ষতি হয় না। নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয় রুহি।

হঠাৎ রুহির শীত লাগে খুব।  বিড়বিড় করে নিজের মনে বলতে থাকে, মাসুদ!  মাসুদ!  তুমি কোথায়?  কার সাথে নতুন করে সংসার বাঁধছো? বিছানার পাশের সাইড টেবিলে ক্যাকটাস নাকি অর্কিড কোনটা থাকবে, এটা নিয়ে মিষ্টি ঝগড়া করছো কারো সাথে? হঠাৎ করে রুহির ভেতরের দৃঢ়তা এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো। নিজেকে ভাঙাচোরা কোনো বস্তুর মতো মনে হচ্ছে। 

রুহি একদম ভেঙে পড়ে নিজের  মনে আওড়াতে থাকে, মাসুদ  আমার ভীষণ শীত করছে, খুব খালি খালি লাগছে তোমায় ছাড়া। একটাবার আসো, শুধু একটাবার এসে আমায় জড়িয়ে ধরে যাও। শুধু একবার!!!!

রুহির বুকের ভেতরে শব্দহীনতার চিৎকার শুধু রুহিই শুনতে পায়, রুহির বুকে আজীবনের জন্য বাসা বাঁধে গভীর শূন্যতাবোধ।