শারমিনুর নাহার
মঙ্গলবার…
পিঠে থাবা থাবা করে যখন তিনি ঘুমালেন তখন ৫টা ১২ মিনিট। সেই তিনটা থেকে দুই ঘন্টার উপরে চলল এসব। হাসানের জন্য কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের আবেগ তীব্র হচ্ছে। কেউ কেউ বাকরুদ্ধ, কেউ বাকহীন- দুটো একই অর্থ। কেউ তাকে ভারতীয় বলে গালি দিলেন। কেউ তিনি বাংলাদেশের মাটির আলো হাওয়া খেয়ে বেড়ে উঠলেও কখনও বাংলাদেশের হতে পারেননি। কেউ তার মেজাজের প্রশংসা। কেউ তার ক্লাসের নিন্দা। কেউ ‘সক্রেটিস’এর সুনাম আবার কেউ বা তার অর্থের মানে লেখক সম্মানির জন্য ফোন দেবার কথাও বললেন। আমি ভাবতে থাকলাম, সাহিত্য সম্পাদনার সেই সময়গুলোর কথা বা পরে সম্পাদকীয় বোর্ডে কাজের সময়গুলোর কথা..
আবার কাশি..খুক খুক খুক ..আবার উঠে গেলাম..পাশে শুয়ে থাকলে ঘুমায়। সরে এলেই কাশি বাড়ে। এসময় ঘুমিয়ে পড়লে খুব খারাপ হবে। সাড়ে সাতটার মধ্যে বেরোতে হবে। ছেলেটা গতকাল সারাদিন খায়নি। ওর জন্য একটু খিচুড়ি করে রাখলে ভালো। কিছুটা করে রাখি – মেয়েটা সারাদিন কষ্ট করবে। দেখি যতটুকু পারি এগিয়ে দেই। খিচুড়ি বসাই..ছোলা সেদ্ধ করি, ডিম সেদ্ধ করি, বেগুন ভাজি। পানি ফুটাতে দেই।
সাতটা প্রায় বাজে, সাহায্যকারী মেয়েটাকে ডেকে রেডি হতে যাই। আরও একটা দিন শুরু হচ্ছে..না, তা তো নয়- দিন তো আগেই শুরু হয়েছে সেই রাতের ২টা থেকে। কেবল রাতের কতগুলো ঘুম পাওনা/বাকি রয়ে গেল। তারা কি আমায় রেহাই দেবে? চোখটা জ্বালা করছে… ছোটটাকে আর একটু খাওয়াই। সারাদিন আর তো খেতে পারবে না। চুক চুক..চুক চুক এই শুনছ..‘উপরে খাটে গিয়ে শোও’..হাত ধরতে গেলে টেনে জড়িয়ে ধরে..তার সঙ্গে সু সম্পর্ক আমার। কোন খেদ নেই, কোন ফাঁকি নেই। ..র্নিভেজাল নির্জলা প্রেম তার সঙ্গে আমার। পথে এবার নামো সাথি সব কিছুর জীবন্ত একটা উপস্থিতি ইদানিং তাড়িয়ে বেড়ায়।
প্রবাহিত রক্তের জীবন্ত উপস্থিতি। চারপাশের সবকিছুর সঙ্গে নিজের প্রাণের অস্তিত্ত্ব। নতুন করে উপলব্ধি করি। শিশুরা বড় হচ্ছে। ভীষণ দুরন্ত আর অভিমান নিয়ে। বাম হাতটা কেমন টেনে আসে ইদানিং- রবীন্দ্রনাথের অখণ্ড চিন্তাটা গাঢ় হবার পর থেকেই এমনটা হচ্ছে। ‘সীমার মধ্যে অসীম’- ‘ওই যে সূদুর নীহারিকা যারা করে আছে ভিড়, আকাশের নীড়/ ওই যারা দিনরাত্রি/ আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী…আহা কোন সুদূরে ধায়’। অরবিন্দ চক্রবর্ত্তীর বক্তৃতায় শুনেছিলাম-‘তুমি যত নিবিড় হবে ততো গভীর হবে। বিষয়ের সঙ্গে যত ঘনিষ্টতা গড়ে উঠবে তত তুমি কাছাকাছি পৌছবে। জ্ঞান- নির্বাণ- উপলব্ধি- মৌন হয়ে শুনতে ইচ্ছে করে। একটা গুহা যদি পেতাম-কী বিরক্তি বলো গুহা শুনলেই এখন নরেন্দ্র মোদীর গুহার কথাই মনে আসে।
[এটা আমার সহজাত প্রবণতা বলে মনে হয় অহেতুক অবান্ত ভাবনা। যখন সেটার প্রয়োজন সেখানে দৃষ্টি না দিয়ে উল্টো দিকে ভাবনা ভাবা। কেবলি বিষয় ছেড়ে বিষয়ীর দিকে ভাবনা আমার।]
কী কী ছিল সেই গুহায়:
ক. হাগুখানা
খ. এটা কোন কথা বললে টাট্টিখানা? ওখানে ছিল কমোড
(নিউজে কিন্তু ছবিটা ছিল)
গ. শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত
ঘ. খাবার
ঙ. বাথরুম
মনে নেই বিশেষ তবে এই পাহাড়ের গুহাগুলো ভাড়া দেয়া হয় ধ্যান করবার জন্য। ভং ঢং রং সং। ‘ছিন্নপত্র’র মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যখন বলছেন, অনেক দিন পরে আবার এই বড়ো পৃথিবীটার সঙ্গে যেন দেখা-সাক্ষাৎ হলো। সেও বললে, ‘এই- যে! আমিও বললুম, ‘এই যে! তার পরে দুজনে পাশাপাশি বসে আছি-আর কোনো কথাবার্তা নেই, জল ছল ছল করছে এবং তার উপরে রোদ্দুর চিকচিক করছে.. (ছিন্নপত্র থেকে দেখে লিখলাম)
নিস্তরঙ্গ ধেয়ে চলা একটা শান্ত- সলিল- অরব উপস্থিতি পুরো ‘ছিন্নপত্র’কে এক তারে বেঁধেছে। আহা! ভীষণ কষ্ট হয়েছিল পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে। প্রত্যেকেরই কী হয়? উনি বলতে পেরেছেন অন্যরা পারে না। কোন মৃত্যু সামনে থেকে বসে দেখবার দুর্ভাগ্য আমার হয়নি। কেবল লোকের কাছে গল্প শুনেছি আমার হাতের উপরে মারা গেল। আয়তুলকুরশি পড়তে পড়তে চলে গেলে/ এক চামুচ পানি/ গঙ্গাজল দিলাম গলায় গেল না- সবটাই সিনেমার দৃশ্য। লোকে সিনেমার মতো বলে বা সিনেমা মানুষের কথা শুনে বলে। কত কথা কলকলিয়ে ওঠে- এত কথা আছে/ এত গান আছে/ এত প্রাণ আছে মোর। কাউকে বলতে পারিনি। কাউকে বলতে পারিনি। কাউকে না। ওহ্ কাকে বলব.. কে আমার কথা শুনবে? ৫.৫৯ মিনিট ভোর।
হাসান আজিজুল হককে নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিতে চাই। সবাই লিখছে। নিজেদের তার সঙ্গে সম্পর্কের বয়ান দিচ্ছে। আমারও ইচ্ছে করে এই সবুজ ঘাসে নিজেকে জানি, কিছু পাই বা না পাই অন্তত নিজেকে তাদের সময়ে বেঁচে আজি এটুকু অন্তত জানান দেই। আমি আছি.. আমাকে তোমরা মেরে ফেলো না। আমি এখনো আছি, অহনতরি বাইচা আছি, মরি নাই। মরলে ইচ্ছা ছিল লাশটা শহীদ মিনারে যাবে। একটা সময় আন্দোলন করেছি। প্রবল- প্রচন্ড.. ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ ভেবেই মাইলের পর মাইল হেঁটেছি.. শাহাবাগ থেকে হাজারিবাগ- শহীদনগর- কামরাঙ্গির চর- হাজারীবাগ- বউবাজার। একা প্রচন্ড একা। কিন্তু একা তো মনে হয়নি কখনো। আজ তবে কেনো..
আবারও মঙ্গলবার (১৬/১১/২০২১)
৯টায় ক্লাস। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের বাংলা সাহিত্য পড়াতে হবে। কি পড়িয়েছিলাম, আজ কি পড়াবো..কি পড়াবো..ও ‘মাইকেল’ ‘বঙ্গভাষা’ ‘মাইকেল’ কো সাইকেল দো..মাইকেল মধুসূদন দত্ত ভার্সাই- ভেনিস একটা দ্রোহ একটা জেদ একটা রাগ একটা তেজ একটা মেজাজ একটা বদমেজাজ। বেয়াদবির মধ্যেই যে ভালো কিছু আছে তারই শুরুর উদাহরণ হয়ত মাইকেল কো সাইকেল দে..প্রত্যেকে যা করতে চায় তাকে তাই করতে দেয়া উচিত। পথ খুঁজে নিতে হয়। আবিষ্কার করতে হয় একা নিজে। একটা শেষ, পরের ক্লাস ‘সমালোচনা সাহিত্য’- প্রচন্ডভাবে গত তিনটা ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে চাইছি মৌলিকতার প্রসঙ্গ।
সমালোচনা সাহিত্যে একটা মৌলিক বোধ। যখন তুমি একটা কবিতা/ গল্প/ উপন্যাস/ প্রবন্ধ- মানে চিন্তাশীল- মননশীল সে যে লেখাই হোক না কেনো তার জন্য ভিন্ন একটি টেক্সট তৈরি করবে তার মধ্যেও মৌলিকতা আছে। তোমাকে কেবল লেখককে/ কবি চিন্তার-অনুভুতির- স্পর্শের যোগ পেতে হবে। নানা ইনিয়ে বিনিয়ে কেবল কতগুলো কথা বলে যাই। অনলাইন/ চোখ- নাক – মুখ – চুল বাদ দিয়ে একজন মুখ ও কান সর্বস্ব মানুষ। এটাই হয়ত ভবিষ্যতের এলিয়েন। যাদের শারীরিক অবয়বকে তুচ্ছ করে কেবল মস্তিষ্ক- মস্ত- মুন্ড দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। ওরা আমার কথা বুঝতে পারে কিনা, না, না আমি সত্যিই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলছি না। সামান্য আকাঙ্ক্ষা যে তারা একটু ধরতে পারুক অন্তত আমি যেটুকু দিতে চাইছি। জানিনা..দু/একজন পারে। যদি ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক গড়ে না ওঠে তাহলে কি হবে? আমি যদি ছাত্রের ভাবনার কাছাকাছি না পৌঁছাতে পারি তাহলে কেনো সে আমার ক্লাসে থাকবে?
সকাল ৯টা থেকে ১২টা বেজে গেল কেবল কথা বলতে বলতে..একটু চা পেলে মন্দ হতো না, কামরুল। কামরুল। না চাইলে কেউ নিজ থেকে এগিয়ে এসে কিছু দেবে, হায়! হয়ত প্রত্যাশা করাটাই ঠিক নয়। কিন্তু দেখো তার তো উচিত, যে মানুষটা সেই কাক ডাকা ভোরে এসে হকারি করে যাচ্ছে তাতে নুন্যতম একটু হাসি দেয়া? নাহ্ ও হয়ত ব্যস্ত.. চেয়ারম্যানরা আছেন। অফিসের এলএমএসদের উনারাই করাপ্ট করে রাখেন। আগের যিনি ছিলেন তিনি অযথা সিরাজকে বসিয়ে রাখতেন। বসিয়ে নয় দাঁড়িয়ে। পুঁজির কি অদ্ভুত দুনিয়া। যত পারো অন্যকে বিরক্ত করো, বিব্রত করো। ব্যস্ত রাখো। সাব্যস্ত করো। রিমান্ডে রাখো।
সদাই মরে ত্রাসে এই বুঝি কেউ হাসে। এক চোখে তাই পিটপিটিয়ে তাকাই আশেপাশে। কামরুল। আবার ডাকি। ও তো ডাক শুনবে না। বেল বাজাতে হবে। এই বেল বাজানোর কথা মনে হতেই ইভান পাভলভের সেই আচরণ তত্ত্বের কথা মনে পড়ে- বেল বাজালে খাবার আসবে- প্রথম দিন- দ্বিতীয় দিন- তৃতীয় দিনে দেখা গেল বেল বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে কুকুরের মুখ থেকে লালা ঝরছে। খাবার আসছে এই ভাবতেই মস্তিস্ক ক্রিয়া করছে।
মিটিং! মিটিং! মিটিং!
সিটিং! সিটিং! সিটিং
ইটিং! ইটিং! ইটিং!
গেটিং! গেটিং! গেটিং
নাথিং! নাথিং! নাথিং
(চলবে)