0

লাইফ ইজ নট এ বেড অব রোজেস (পর্ব-১)

Share

শারমিনুর নাহার

‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পটির সঙ্গে যখন সখ্য গড়ে উঠেছে তখন আমি ব্যক্তি হাসান আজিজুল হক থেকে অনেক দূরে। সংবাদপত্রে কাজের সুবাদে উনার সঙ্গে নানা কাজে আবদ্ধ হয়েছি। সে সময় ঢাকায় এলে কদিন থাকছেন, কোথায় উঠছেন, কি কি প্রোগ্রাম থাকবে সব জানা থাকত। উনার সিডিউলের মধ্যে থেকে আমরা কাজের সময় বের করে নিতাম। হয়ত নতুন কোন লেখা বা পুরাতন লেখা পাঠিয়েছেন সেটার এডিটিং বা ফোনে লেখা দিয়েছিলেন সেটা দেখে দিতে চাইতেন- ইত্যাকার নানা বিষয়। যদিও বেশিরভাগ সময়, সময়ের টানাটানি থাকত। কিন্তু তিনি না দেখে কোন লেখাই ছাড়তেন না। ভীষণ যত্ন নিয়ে লেখা এডিট করতেন, অন্য কাজ ফেলে। তাই আমিও উনার সঙ্গে কাজে মনোযোগ দিতাম বেশি। আবার লেখক সম্মানীর প্রসঙ্গ আছে। 

অনেক সময় হয়ত সে কারণে অনেকখানি পথ পেরোতে হয়েছে। যাই হোক, আজ মানুষটা চলে গেলেন। না, আজ নয় আরো দুদিন আগে ১৫ নভেম্বর, রাত ৯টা ১৫ মিনিট। তখন থেকেই কিছু লিখব-লিখব- ভীষণ তাড়না বোধ করছি। না, কেউ লেখা চায়নি বা কোথাও দেবার প্রতিশ্রুতিও নেই। অনেকদিন হলো ঢাকার সাহিত্য সমাজ-সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে আমার লেখার আবেদন ম্লান হয়ে গেছে। একটা সময় ছিল- কেউ কেউ চাইত, অপেক্ষায় থাকত। আজ সেসব নেই। নিজের অনেক অনেক না পারা, সময়মতো কথা না রাখতে পারার কারণে সবই শেষ হয়ে গেছে। আমিও চলে গেছি দূর নক্ষত্রের পথে। নিজেকে নিয়ে আর কোন সংকল্প নেই। প্রত্যাশা নেই। সবটাই ভঙ্গুর। কেবল টিকে থাকা- প্রাত্যহিকতা মেনে চলা।

এই লেখাটার প্রথম লাইন লিখেছি যেদিন, স্যার চলে গেলেন সেদিন – কাগজে নয়, কম্পিউটারে নয় কেবল মনে মনে। মনের কথাটা কালিতে পরিণত করতে করতে পৃথিবী দক্ষিণ মেরু থেকে উত্তর মেরুতে চলে গেছে। অনেকগুলো নক্ষত্রের পতন ঘটেছে, অনেক তেলাকুচা ফল এরই মধ্যে লাল হয়েছে, কেউ কেউ ঝরে গেছে। কোনো কোনো বীজের পরাগায়ন ঘটেছে কিন্তু আমি নিজেকে কি-র্বোড আর মনিটরের কাছে বন্দি করতে পারিনি। কেনো পারিনি, এখন হয়ত সে কথাটাই বলা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে হাসান আজিজুল হককে নিয়ে লেখার চেয়ে। 

সোমবার রাতে যখন বাংলা সাহিত্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বরপুত্রের পতনের খবর জানলাম তখন নিজের পুত্রকে রাতের খাবার খাওয়াচ্ছিলাম। আমার সঙ্গের মানুষটি খবর নিশ্চিতের জন্য দু/ চারটা ফোনের পরে নিজেই লিখতে বসলেন। আর আমি ৪ বছরের সন্তানকে খাইয়ে আরও দেড় বছরের একটিকে নিয়ে ঘুমিয়ে দিতে গেলাম। যদিও একজন গভর্নেস আছে কিন্তু রাতের ঘুমে সঙ্গী তাকে তারা কিছুতেই করবে না। দুটো দুদিকে চিৎকার করতে থাকবে। এসব বুঝে কোন বাক্য ব্যয়ের সুযোগ না দিয়ে তাদের বিছানায় নিয়ে গেলাম। সময়টা অন্তত নষ্ট না হোক। পাছে ওঠে দুটো অক্ষর লিখতে পারি। কাল আবার অফিসের প্যারা আছে। ওরাও সারাদিন আমাকে পাবে না। আধাঘন্টা বা তারও একটু সময় পরে কোন কাজে ঘরের বাইরে আসতেই তার লেখা শেষ হবার খবর পেলাম।

 ‘পড়ে যাও একটু’- আহবানে সাড়াও দিলাম। পড়তে গিয়ে নিজের কিছু স্মৃতি ফালি ফালি করে ভেসে এলো। নিজেকে প্রবোধ দিলাম। একটা তো ঘুমাল এবার আর একটাকে ঘুমিয়ে এসেই যদি কম্পিউটারটা পাই..লাইট জ্বালানো থাকে.. আবার গেলাম বিছানায়, বড়টাকে সুসু করিয়ে ডায়াপার পরিয়ে। ‘মা আমরা কি কালকে পিকপিকে যাবো, আমাদের সবজি খিচুড়ি নিয়ে’? না বাবা, কাল সকালে আমি অফিস যাবো। তুমি ঘুম থেকে ওঠে আমাকে দেখতে পাবে না। ‘তাহলে কখন পিকনিক যাবো ডিসেম্বর মাসে?’ আচ্ছা.. শোন তুমি কিন্তু কাল ওদের বিরক্ত করবে না। লক্ষী বাচ্চা হয়ে থাকবে। আমি ফিরে এসে কোন কমপ্লেন শুনতে চাই না। আর সর্দি-কাশি নিয়ে স্কুলে যাবার দরকার নেই। বায়না করবে না।

বাচ্চা : তুমি কখন আসবে?

আমি: আমি তো সারাদিন অফিসে থাকব মা।

বাচ্চা: তুমি সারাদিন থেকো না।

মা : না থাকলে কি ওরা আমাকে বেতন দেবে বলো

বাচ্চা: আমাকে ধরে থাকো।

একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। আমিও আর পৃথিবীর দাবি পূরণ করতে পারি না। কোন ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়ি।

অতপর/ আরো রাতে/ মাঝরাত- সাজরাত। রাতের ১ টা বাজে (মোবাইলে সময় দেখে) ছোটটি ভীষণ কাশি দিচ্ছে। কোনভাবে সামাল দেয়া যায় না। বমি করে ফেলল। তাকে একটু জল খাইয়ে- ‘চুক চুক..তি তি..’।

একটু পরে লিখতে শুরু করলাম.. ‘আত্মজা ও করবী গাছের সঙ্গে যখন সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তখন আমি ব্যক্তি হাসান আজিজুল হক থেকে অনেক দূরে’। গায়ে পিঠে থাবু থাবু। না, সে এখন খেলছে। এই ফাঁকে আমি ফেসবুকে (মুখবুক) অন্যের ফেস (মুখ/বুক) দেখি। সবাই হাসান আজিজুল হককে নিয়ে লিখেছেন- কতক বড়- কতক ছোট। কতক উচ্চ কথন- কতক পতন। 

এরই মধ্যে ঘরের মানুষটির লেখা ঝুলে আছে। যা আমি ঘুমাতে যাবার আগে পড়ে এসেছিলাম। তবুও শংকা জাগে। আর না হয় কিছুই রহিত বাকি। তুমি তুমি তুমি মিলে সভা করেছিলাম..আমরা অপেক্ষা করেছিলাম..[সবচেয়ে প্রিয় গল্প] আমিই কেবল আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী। সত্যিই আমি কাউকে দায়ী করি না। নিজেই নিজের কবর রচনা করেছি। প্রচন্ড কাশির শব্দ আসছে। এখুনি যেতে হবে। ফিরে এলাম। আজান হচ্ছে। একটু একটু করে পাখি ডাকছে। টুই টুই টুই.. অদ্ভুত লাগে এটা সময়টা, কেবল অন্য প্রাণির সাড়া পাওয়া যায়।

 বাকি সময়গুলোতে পৃথিবীতে মানুষের মহোৎসব চলে। পাখি- ফুল- ফল- দেবদারু- আচ্ছা এরা মানুষকে কি ভাবে? তারাও তো জীবনের শুরু থেকে তাদের বয়স পর্যন্ত মানব জাতির পতন দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আমিই কি কেবল পতন দেখি, পতনের শব্দ শুনি। সেই মায়া হরিণটা- অন্তত চিড়িয়াখানা গেলে প্রথমেই যার সাক্ষাৎ মেলে। রাজা দুষ্মন্ত যাকে বধ করতে গেলে আশ্রমের ওরা নিষেধ করেছিল- হরিণরা কি জানে এ জাতির এখনো কত পতন বাকি? আবারও ছোটটার কাশি শোনা যাচ্ছে। খুক খুক খুক, না আজ আর নয়। বিদায়!! 

(চলবে)