শারমিনুর নাহার
উপাচার্যের বৈঠক চলমান
আড়াইটায় মিটিং শুরু হলে তিনটায় শেষ হয়ে যেত। ক্লাসটা নেয়া যেতো। কিন্তু যথারীতি… .ফলে তিনটার ক্লাসটা পোস্টপন্ড করতে হল। মিটিং শুরু হল তিনটায়, শেষ চারটায়। আমরা ভেবেছিলাম জাতির ব্যাকবোন / মেরুদন্ড / শিরদাঁড়া/ শিরোচ্ছেদ হিসেবে আমরা মানে শিক্ষকরা মানে এই ছা-পোষা কেরানিরা কেনো ছাত্র আনতে পারলাম না কেন? তার জন্য বিপুল/ বিশাল ভর্ৎসনা শুনতে হবে। আগে শুনেয়াছি ঢের। বুঝিয়াছি অবাধ। ‘তবু বলিয়াছি মার গলা ধরে, “মাগো, সেই কথা বল/ রাজার দুলালে পাষাণ করিতে ডাইনী করে কি ছল/ সাতশত’ সাপের পাহারা কাটিয়ে পাতালবাসিনী মেয়ে/ রাজার ছেলেরে বাঁচায়ে কি করে পৌঁছিল দেশে যেয়ে”/ কল্পপূরীর স্বপনের কাঠি বুলাইয়া শিশু চোখে/ তন্দ্রদোলায় লয়ে যেত মোরে কোথা দূর ঘুমলোকে/ ঘুম হতে জেগে বৈশাখী ঝড়ে কুড়ায়েছি ঝরা আম/ খেলার সাথীরা কোথা আজ তারা? ভুলিয়াও গেছি নাম।’ দেখিয়াছি বিপুল জলরাশির কলকাকুলি কিচিকিচি। তবুও আমাদের যাবার কোন পথ নেই বলে কেবলি ঘুরে ফিরে এসব হায়েনা/ রক্ত চোষা সরীসৃপদের সঙ্গে সপ্তাহে একদিন দেখা হয়। আমরা প্রত্যেকে ঝকঝকে হাফ প্লেটে নিজেদের কালচে কলিজা নিয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকি। বিক্রির জন্য ব্যবহৃত প্ল্যাকার্ড। সারি সারি কাটা ছাগ মাথা ঠিক অগ্র দুপুরে মসজিদের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকে। এয়ারকন্ডিশন রুমে নিজেদের রক্তাক্ত কলিজা যা একটু করে কালচে হতে শুরু করেছে প্রায়- আগে দ্বিধাবাক্য আমাদের গ্রাস করত। ইদানিং অভ্যস্ত। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা- অর্ধসত্য। আর এই ‘করোনা’ শব্দটি ব্যবহার করে নানা অসুবিধাবাদিরা হয়েছে সুবিধাবাদি। ফলে আমরা ছাপোষাদের কেবল রক্তচোষাদের সহ্য করতে হয়েছে। শোষণ কতপ্রকার এবং কাহাকে বলে কর্তৃপক্ষ নির্বিবাদে চালাতে থাকে। তাহাদের ক্রন্দন থামে না। দিন দিন তারা আরো অধিকতর ক্রন্দনে সিদ্ধিদাতা/ সিদ্ধিহস্ত। কত মিষ্টি করে তিক্ত উপস্থাপন যায় তার নমুনা এই অডিটরিয়াম।
অডিটরিয়ামের কিছু স্মৃতি কিছু/ পিছু/ নেশা ছাড়ে না
- গন্যমান্যদের (তথাকথিত) অমান্য করা চকচকে কচকচে পিঠা উৎসব
- জব ফেয়ার
- বিউটি কেয়ার
- এডুকেশন বেয়ার
- এডমিশন পেয়ার
- কালচারাল ফেয়ার
- শব্দটা যদিও পরিভাষা হবে কালচারাল ফেয়ার। এত ছোট রুমে এত শব্দ ছাদ ব্লাস্ট করে আকাশ- মহাকাশে চলে যায়। তবু বিরাম নেই। আর নৃত্য হলে তো কথাই নেই গমগম, গমগম, গমগমগম, দৃম দৃম দৃম, ক্রিম ক্রিম..খাটি বাংলায় ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি।
কারোর তাতে ঘাম ঝরে কারো না শু শু মানে পি মানে প্রসাব ঝরে আর কারো বা ঘাম। আমরা থতমত খাই। এই না জাতির ব্যাকবোনের প্রকৃত কাজ। আমরা বরং প্রাকৃত ছেড়ে অপ্রাকৃত- চবিত- চর্বন। আমরাই জাতির ভবিষ্যত নির্মাতা।
বিকেল ৩টা, ২০.১১.২০২১
বিকেল/ গোধূলি/ সন্ধ্যা
‘শীতের বিকেলগুলো বড় তাড়াতাড়ি ফিকে হয়ে আসে এ সময় এত খারাপ লাগে.. মনে হয় পৃথিবীতে কেউ নেই’ টিচার্স রুমে মুনিয়ার কথাটা শুনে মোবাইলের স্ত্রিন থেকে তার দিকে চোখ ফেরালাম। হাসান আজিজুল হককে নিয়ে ‘মুয়াজ্জিন সুমন’ লিখেছেন, পড়ছিলাম। এমনটা আমি প্রায় প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করি। তাদেরও এমন মনে হয় কিনা। এত বিষন্ন শীতের বিকেল। এক মুহুর্তেই ফুরিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ হয়ত এমন সন্ধ্যা দেখেই ‘এখনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা’ লিখেছিলেন- মুনিয়া বলতে থাকে।
আমি আবার স্ত্রিনে চোখ রাখি.. ‘এর এক দশক পর ২০১৫ সালে আবার দেখলাম তাকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আয়োজিত..’- সন্ধ্যা শব্দটা, সম্প্রতি আমি যে সন্ধ্যাকে আরো একটু নতুন করে আবিস্কার করেছি এই কথাটা মুনিয়াকে বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। টিচার্স রুমে আমার টেবিলটা পূর্ব- পশ্চিম কোণ হতে পারে। ক্ষমা করবেন- দিকগুলো বা কৌণিক অবয়ব আমার আয়ত্বের বাইরে। হঠাৎই ঠাওর করতে পারিনা এটা পূর্ব না পশ্চিম নাকি উত্তর না দক্ষিণ। কেবল ডানে- বামে বুঝে চলি। মা বলেন ‘দিক না চিনলে চলাফেরা করিস ক্যামনে’ আমি চিনি না, কি করব তবে.. রুমে আমার ডান পাশে মাঝে ড্রয়ারের আলমারি মানে ক্যাবিনেট সম্ভবত যাদের বলে, যার সিলটা আবার বড় করে লেখা otobi। এর পরে মুনিয়ার টেবিল। সেখান নিয়ন/ পড়ন্ত/ সোনা রং একটা রোদ নিজের শেষ অস্তিস্ত্ব ! জানান দিতে ব্যস্ত। মুনিয়া হয়ত সেদিকে তাকিয়েই তার বিষন্নতার কথা বলতে চেয়েছিল বা বলেছিল। আমি কেবল ‘হয়ত সে তুমি শোন নাই সহজে বিদায় দিলে তাই’ গানের কথা বললাম। দিনের শেষ- রাতে শুরু এই ক্ষণ নিয়ে আমাদের আলাপ শুরু হল। আমরা বিষন্নতা পেরিয়ে গোধূলিতে থিতিয়ে গেলাম। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ওভার ব্রীজটা যেটা ট্রানজিট ওয়ে বলা হয় ওখানে সিএনজিতে উঠবার সময় একটা সন্ধ্যা প্রবল নাড়া দিয়েছিল একবার। সে দিনের বিশেষত কি ছিল এখন মনে করা কঠিন। তবে আমি যে ভীষণ সঙ্গীহীন ছিলাম তা বেশ মনে আছে। সেই একাকিত্ব আমাকে প্রায় পাগল করে দিতো। নিজেকে নিয়ে কি করব?? প্রবলভাবে কাগজ-কালি-মন আকড়ে ধরতে চাইতাম। পারতাম না। ওখানেই আমার জীবনের ব্যর্থতা শুরু। যা আজোও উৎরাতে পারিনি। তখন ফাল্গুনী রায়ের কবিতার মতো ‘মানুষগুলো সন্ধ্যা হতেই খোয়ারে ঢুকে পড়ে’ – তীব্রভাবে চাইতাম সন্ধ্যা না আসুক। বিকেল না হোক। পাঁচটা না বাজুক। অফিস শেষ না হোক। কি করব এখন। ‘আমি এক যক্ষ মহানগরীর, যারে ডাকি তার কেনো পাইনা সাড়া/ ছায়া ছায়া নিবু নিবু আলোর রেখা/ এসময় ভালো আর লাগেনা একা।
মুনিয়া তার চলমান-প্রাক্তন সব প্রেমিকার সন্ধ্যার ঝাঁপি খুলে বসে। আমি আর গ্রাহ্য করতে পারিনা। কেবল ‘গোধূলি গগনে মেঘে..হয়ত সে তুমি শোননাই সহজে বিদায় দিলে তাই.. আকাশ- কুসুমও ছিল..ঘন ঘন বারি ধারায়’ … .
পিয়ন (কামরুল) ম্যাম নামবেন না? গাড়ি চলে যাবে। ও আবারো পাঁচটার মামলা। এবার নিশ্চয় মুনিয়া থামবে..
‘লেখাটা যেমন শুরু হল তেমনটা শেষ হল না’ মুয়াজ্জিন সুমনকে ম্যাসেজ পাঠালাম.‘ভীষণ দুঃখিত এমনভাবে বলার জন্য। আপনার লেখা দেখেই পড়তে যাই। আশাভঙ্গ হল।’ তিনি বললেন, ‘অনেক ধন্যবাদ আপনি পড়েছেন’ তাড়াহুড়ো লেখা…
গাড়িটাই ৮ জন মানুষ, আচ্ছা এটা কি হাসান আজিজুল হককে চেনে? তার কোন লেখা এটা কি পড়েছে? এটা কি ‘আত্মজা ও করবী গাছের গল্পটা বুঝেছে’ এরা কি করবী গাছ চেনে? সবাইকে চিনিয়ে দিতে ইচ্ছা করে আমার। তাকে নিয়ে মনে কথার কলকাকুলি চলে কিন্তু বলবার লোক কই? এরাও শিক্ষক- সবাই উচ্চ শিক্ষিত- সবাই কথা বলতেও পছন্দ করেন। একটু পরে আমার দুপাশের দুজন নামাজ পড়তে শুরু করল। আমি পুরো থেমে মানে ভাবনা থেকে তাদের ভাবনায় প্রবেশ করতে লাগলাম।
( চলবে)