0

মায়ের ডায়েরি

Share

ঊর্মি চোধুরী

মঞ্চে আসবেন তনুজা রহমান, অপরাজিতার গল্প শুনাবেন তিনি।

তৃণা,তিতলী মাকে নিয়ে এসো মামণিরা।

তনুজা রহমানকে আজকের অপরাজিতা পুরস্কার তুলে দিবেন তাঁরই দুই কন্যা তৃণা আর তিতলী।

তৃণা তিতলী ক্রেস্ট তুলে দেয় মায়ের হাতে। এ যেন অধরা এসে ধরা দেয় তাদের কাছে,যেন এই সম্মানটুকুই তার মায়ের প্রাপ্য। 

“আলোকিত নারী” এই শিরোনামে পুরস্কার তুলে দিবেন আলোকিত নারীর কর্ণধার জনাব জাহিদ কবীর।

জাহিদ সাহেব কাঁপা কাঁপা হাতে তনুজাকে পুরস্কার তুলে দিলেন…কাঁধে ঝুলিয়ে দিলেন আলোকিত নারীর প্রতীকী চাদর।

তনুজা রহমান নির্বাক,জাহিদ কবীরও চুপচাপ ছিলেন। তিতলীর দিকে আঙুল তুলে বললেন তনু ও, ও আমার মেয়ে? কণ্ঠ চেপে গেলো। শব্দ হলো না। আমার মেয়ে তিতলী তনুজা। বাবা চিনে না। চায়ওনি।

তৃণা আর তিতলী একই বৃন্তের দুটো ফুল,নিঃসঙ্গ ফুলই বটে। আর কিছু বলবেন,জাহিদ সাহেব?

আশা করছি এমনিভাবে অনেক আলোকিত নারীর পাশে দাঁড়াবেন আপনি। ভালো থাকবেন। তৃণা,তিতলীর দিকে তাকিয়ে রইলেন জাহিদ কবীর, চোখে অনেক কথা জমে আছে,কিন্তু বলা হলো না। নিজের আসনে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়লেন।

এবার,তনুজা রহমান আপনার কণ্ঠে শুনতে চাই জীবনের গল্প,অপরাজিতা হওয়ার পেছনে ত্যাগ,প্রাপ্তি কিংবা প্রত্যাশার কথাগুলি। প্লিজ আসুন,মাইক্রোফোনে। প্রিন্সিপাল ম্যাডামের আহবান।

তনুজা রহমান,মা, ভাই,ভাবী সহ সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে নেন একবার। সবার চোখে হাসির ঝিলিক, করতালিতে মুখর সন্ধ্যার মঞ্চ। তনুজা দুই মেয়ে তৃণা আর তিতলীকে বুকে জড়িয়ে আদর করলেন চুমুতে চুমুতে ভরে দিলেন তাদের কপালে।

মাইক্রোফোন হাতে নিয়েই সালাম বিনিময়,তারপর ধন্যবাদ। তনুজা বলতে শুরু করলেন,

আমি একজন নারী,একজন একলা মা। যাকে আপনারা বলেন “সিঙ্গেল মাদার”। প্রতিটি মানুষের সফলতার পেছনে একটা গল্প থাকে। কারো গল্পটা দীর্ঘ, কারোটা খাটো,কারোটা সুখের,কারোটা সংগ্রামের। তেমনি আমার গল্পটাও দীর্ঘ সংগ্রামের। 

কারণ আমাদের তৈরি  এই সমাজ এখনও সিঙ্গেল মাদারদের অনুকূলে নয়। প্রতিকূলতায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূর থেকে দূরে,অথৈ সাগরের লোনাজলে অশ্রুগুলো বিসর্জনে উৎসাহিত করে। আমাদের সুশীল সমাজ এখনও কোথাও কোথাও নারী স্বাধীনতায় বাধা দেয় কারণ নারী স্বাধীনতার ভুল ব্যাখ্যা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। কিছুটা হয়তো একারণেই নারীদের কোণঠাসা করে থাকতে হয়। কখনও তৈরি করে আমাদের মতো সিঙ্গেল মাদার। আর আমরা হয়ে উঠি সমাজের বোঝা। আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়া হয় তুমি ভুল,ভুলের মাঝে বসবাস তোমার। কেউ বলেনা আড়ালের গল্পটা কী ছিলো,কারো শুনবারও আগ্রহ হয় না।

আমার আপনার মনের মাঝেই বসতি গড়েছে ঘুণপোকা, তিলে তিলে গিলে খাচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক। বিশ্বাসে চিড় ধরেছে বহুকাল আগেই। আমরা বের হয়ে আসতে পারছিনা একটা কঠিন মিথ্যের বেড়াজাল থেকে। আমরা মানুষকে নয়, মনুষ্যত্বকে ভাগ করছি নারী আর পুরুষে। কাজে আর বিনোদনে। আমরা বাইরের ঠাঁট বজায় রাখছি ঠিকই অন্তরে পুষছি এক একটা বিষবৃক্ষ। আমাদের সমাজে পুরুষ নারীকে অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে চায়,হাতে পায়ে বেড়ি বেঁধে, বলছি না সবাই,ব্যতিক্রমও আছে। তার উদাহরণ আমার ঘরেই আছে,আমার ভাইদের পরিবার।

আমার চলার পথটা ভিন্ন গতিতে বয়ে যেতে পারতো,কিন্তু হয়নি। খোদাতায়ালাও হয়তো চেয়েছেন নিয়ম ভেঙে তুমি অনিয়মে নিয়ম বানাও। আর দশটা নারীর মতো খুব করে চেয়েছি স্বামী সোহাগী হয়ে সংসার বুনে যাই,তার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আলোকিত সভ্য সমাজ গড়ি। না বিধি বাম। আমার সব ইচ্ছেকে শূন্যে উড়িয়ে হাতে পায়ে লোহার বালা পরানোর ব্যবস্থা করা হয়। ধৈর্য ও পরীক্ষা নিতে থাকে। লেখাপড়া শেষ না করতেই নিয়তির নামে অরাজকতার শেকলে বেঁধে ফেলতে চায় আমার তথাকথিত পরিবার। চারপাশের বদ্ধ দেয়ালের ভেতর আমার শ্বাস প্রশ্বাসে গরম ভাপ আসে,আমি মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে চাই। ভুল বিশ্লেষণে বিশ্লেষিত করা হয় আমাকে,মেনে নিলাম সব।

তারপর একদিন কথাতে কথা হয় আমি মানুষ নই,মেয়ে মানুষ। হ্যাঁ ঠিকই তো,বিধাতা মেয়ে মানুষ করে পাঠিয়েছেন সংসারের সৌন্দর্য বর্ধনে,একটা সংসারকে আষ্টেপৃষ্টে গুছিয়ে বাঁধার জন্যে। তার মানে এটা নয়, মেয়ে মানুষ পুরুষের বাহুডোরে বাঁধা পণ্য,বিনোদনের খোরাক,হুকুমের গোলাম। না,আর পারলাম না। ইগোতে লাগছিলো খুব নিজেকে পণ্য ভাবতে। আরও তীর ছোঁড়া আঘাত পেয়েছিলাম যখন দেখলাম প্রথম সন্তানের নাম রাখার অধিকারটুকুও খর্বিত, আমি কখনই তার গার্ডিয়ান নই। আমার দৌঁড় হেঁসেলের দরজা কিংবা বারান্দা পর্যন্ত। সারারাত নিজের মনের সাথে যুদ্ধ।  তারপর কোনো এক আলো ফোটা ভোরে আমার অনন্তের পথে যাত্রা। কোনো পিছুটান আসেনি, আসলেও পিছু হঠার চাবিটা এঁটে দিয়েছি শক্ত করেই, আর ফেরা হবে না এই বলেই।

দুটো জিনিস,দুটো সম্পদ নিয়ে বেরিয়ে এলাম, একটা হাসিমুখের পুতুলসোনা জাইরা কবীর তৃণা। আর দ্বিতীয়টি আমার নির্যাস পান করে জানান দিচ্ছিলো আমি আসছি আম্মু…তিতলী তনুজা,যার স্মৃতিতে বাবার কোনো অস্তিত্ব নেই।

এত কথা বলছি,এজন্যে আমার মেয়েদেরও জানা দরকার আমার গল্পটা। কতকগুলো প্রশ্নবিদ্ধ চোখের উত্তর দিতে পারবে তারা,যা এতদিন শুধু গোপন ডায়েরীতে সংরক্ষিত ছিলো।