1

ব্রিনজাল ফ্রিজে থাকে

Share

শাওন মাহমুদ

ধামরাই বেড়াতে যাওয়ার ঘটনা, বন্ধুবান্ধবসহ। সাথে ১২ বছরের বন্ধুকন্যা। সবাই মিলে বাগানে হাঁটছিলাম, বন্ধুকন্যা হঠাৎ বলে উঠল, মা, ব্রিনজাল গাছে ধরে? এগুলো তো ফ্রিজে থাকে, তাই না? ওর চোখে রাজ্যের বিস্ময়। মেয়ের কথায় আমার বন্ধুটা লজ্জা পেয়ে বলে উঠল, না মা, এগুলো সবই ভেজিটেবলস। গাছে ধরে, তারপর বিক্রির জন্যে বাজারে নিয়ে গেলে আমরা কিনে ফ্রিজে রাখি। হায়রে সবজি, তোমাদেরকে আমাদের আগামী প্রজন্ম শুধু ফ্রিজেই দেখে গেল। আমাদের ব্যর্থতা ওদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সমাধান খুঁজে পাওয়ার অদম্য চেষ্টা অহরহ করেই যাচ্ছি। আমরাই তো ওদের বাক্সবন্দী করেছি। উঠান ছাড়া বাড়ি, মাঠ রেখে টেলিভিশন, বাহনের জন্যে গাড়ি, যোগাযোগের জন্যে কম্পিউটার, এর সবগুলোর পরিধিই তো চতুষ্কোণ। চারটা লাইন দিয়ে আটকানো বাক্স দিয়ে ওরা আর পৃথিবীর কতটুকুই বা দেখাতে পারে, জানাতে পারে।

পরিপূর্ণ বয়সে এসে মনে হয় প্রতিটি শিশুরই অনেক বৃহৎ আয়তনে না হলেও ছোট পরিসরের যেকোনো সাংস্কৃতিক পরিবেশে কিছু সময় অতিবাহিত করা দরকার। পড়ালেখা করার পাশাপাশি ভাল বই পড়া, সিনেমা দেখা, গান শোনার অভ্যাস থেকে অনেক জানার আছে, অনেক কিছু শেখার আছে। যা কিনা পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে পরিবারের জন্য সুখকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। একাত্তরের পর থেকে আমার জীবন আরেকভাবে গড়ে উঠেছিল। বাবার জন্যে অপেক্ষা, মায়ের জীবনযুদ্ধ, নতুন ঠিকানায় নতুন করে পথচলা। ভাবতেই খুব অদ্ভুত লাগে। অনেক কঠিন কিন্তু সুমধুর কিছু স্মৃতি, যদিও বা অগোছালো, তার পরও আজকাল মাঝেমধ্যেই মাথার ভিতরে হানা দেয় বারবার প্রতিদিন কোনো না কোনো একসময়। একটা ব্যাপারে আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী এক মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা, শিল্পী, লেখক, নাট্যকর্মী এমন বিভিন্ন শাখার সাংস্কৃতিক কর্মীদের আনাগোনা ছিল আমাদের বাড়িতে। স্কুল থেকে এসে কখনো একলা ভাত খেতে হয়নি। মামা, খালারা তো ছিলই, সাথে তখনকার বেশির ভাগ উজ্জ্বল নক্ষত্রের আগমন হতো দিনের কোনো না কোনো সময়। এখনও এমন কারো সাথে দেখা হলে প্রথমেই বলে ওঠেন, তোদের বাসার ডাল-ভাত খাইনি এমন দিন কম গেছে। 

১৯৭২ সাল থেকেই আমাদের বাসার নিচতলায় বাবার নামে ‘শহীদ আলতাফ মাহমুদ সংগীত বিদ্যানিকেতন’ ছিল আর সপ্তাহে দুদিন ওখানে উচ্চাঙ্গ সংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, গণসংগীত, তবলা এবং গিটারের ক্লাস হতো এবং সেখানে আমার অবাধ বিচরণ করার সুযোগ ছিল। নিজের অজান্তেই বিখ্যাত সব গুরুজনের সাথে আমার সখ্য গড়ে উঠেছিল এবং এখন যখন চিন্তা করি, তখন নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগে যে, হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও ভুপেন হাজারিকার গণসংগীত কাছ থেকে বসে শুনেছি। কোনো কোনো বিশেষ বিকেলে হয়তো দেখা হয়ে যেত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কবি শামসুর রাহমান, কাইয়ূম চৌধুরী, শাহাবুদ্দিন, শেখ লুৎফর রহমান, সুধীন দাস, শাহাদাৎ চৌধুরীর মতো ব্যক্তিত্বের সাথে। তাঁদের আড্ডামুখর পরিবেশে ভরে উঠত শহীদ আলতাফ মাহমুদ সংগীত বিদ্যানিকেতন। তাঁদের দেখতে দেখতে আর তাঁদের মাঝে বেড়ে ওঠাতেই আমার সাহিত্য, চারুকলা, সঙ্গীত ইত্যাদির প্রতি প্রবল ভালবাসা জন্ম নেয়। আর একটু বড় হবার পর পরিচয় হয় নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের সাথে। তাঁর কাছ থেকে গল্পের মাঝেই কখন যেন গ্রহ, নক্ষত্র, গাছগাছালি, মাছেদের জীবন চক্র সম্পর্কে আমার ধারণা হয়ে যায়। এমনকি কোন ঋতুতে আকাশের রং, গাছের রঙ কেমন হয় সেটাও তাঁর কাছ থেকে শিখে ফেলি। নাট্যাচার্য সেলিম আল দ্বীন আমার কাছে আমার সেলিম বাবা, প্রকৃতি প্রেমিক।

ফিরে আসি মূল কথায়, প্রতিটি শিশুর ছেলেবেলায় এই ধরনের কিছু মানুষের সঙ্গে আনাগোনা খুব জরুরি মনে করি আমি। মানসিক বিকাশের জন্য এই মানুষগুলোর অনেক বেশি প্রয়োজন বলে মনে হয় আমার। শুধু দুঃখ লাগে এই ভেবে যে এই মানুষগুলোর সংখ্যা দিন দিন কমছে আর আমাদের শিশুরা ধাবিত হচ্ছে বাক্সবন্দী জীবনে, যেখানে ব্রিনজাল ফ্রিজে থাকে, গাছে নয়।

শাওন মাহমুদ, শহীদ আলতাফ মাহমুদ কন্যা/ কলামিস্ট